কলম্বো : ঘটনাবহুল ২০২২। একাধিক উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে কাটতে চলল বছরটা। বিশ্বের একাধিক দেশের নানা ঘটনা পরম্পরার সাক্ষী রইলাম আমরা। বিশেষ করে শ্রীলঙ্কায় (Sri Lanka) অস্থিরতা। বর্তমানে চরম আর্থিক সঙ্কটের (Economic Crisis) মধ্যে দিয়ে চলছে এই দ্বীপরাষ্ট্রটি। ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ডের (IMF) ২.৯ বিলিয়ন আমেরিকান ডলারের (প্রায় ২৪ হাজার কোটি) প্যাকেজের অপেক্ষায় রয়েছে সনৎ জয়সূর্য-অজুর্না রণতুঙ্গাদের দেশ। বছর শেষের আগেই যদি তার অনুমোদন মিলে যায়, তবে সমস্যার সুরাহা হয় বৈকি।


শ্রীলঙ্কার আর্থিক সঙ্কটের মধ্যেই পয়লা সেপ্টেম্বর চার বছরের একটি চুক্তিতে পৌঁছয় ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ড ও শ্রীলঙ্কা প্রশাসন। তাতে এই দ্বীপরাষ্ট্রের আর্থিক নীতির পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দেয় IMF। প্রায় ২.৯ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার সাহায্যের কথা বলা হয়। এমনই খবর দ্য ডেইলি মিরর সূত্রের। IMF-এর তরফে বলা হয়েছে, শ্রীলঙ্কার আর্থিক সঙ্কট কাটাতে ঋণদাতাদের কাছ থেকে ঋণ-মুক্তি এবং একাধিক বন্ধু রাষ্ট্রের অতিরিক্ত আর্থিক সহায়তার প্রয়োজন পড়বে। এই দ্বীপরাষ্ট্রকে সেক্ষেত্রে আর্থিক সহায়তার আশ্বাস দেবে আইএমএফ। শ্রীলঙ্কাকে ঋণপ্রদানকারী দেশগুলি হল- জাপান, চিন ও ভারত।


দেখে নেওয়া যাক কীভাবে ছোট্ট ও অপূর্ব এই দেশটি ঋণের জালে জর্জরিত হয়ে পড়ল বা এই পরিস্থিতির উৎস কোথায় ?


শ্রীলঙ্কার অন্যতম জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম The Daily Mirror বলছে, "এই দ্বীপরাষ্ট্রটির আর্থিক সঙ্কটের কারণ, বহু বছরের অব্যবস্থা, দুর্নীতি, দূরদৃষ্টিহীনতা এবং সর্বোপরি সুপ্রশাসনের ঘাটতি।" সাম্প্রতিককালে শ্রীলঙ্কার সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কে বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার তলানিতে গিয়ে ঠেকে। আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজারে প্রবেশাধিকার হারানোয় স্বাধীনতার পর প্রথমবার সবথেকে খারাপ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হয় এই দ্বীপরাষ্ট্রের। এর পাশাপাশি অনিয়ন্ত্রিত হারে বাইরে থেকে ঋণ নেওয়া, কর ছাড়ের কারণে বাজেটে ঘাটতি বৃদ্ধি, রাসায়নিক সার আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ এবং শ্রীলঙ্কার মুদ্রার ক্রমাগত পতনের জেরে চরম দুরবস্থা তৈরি হয় দেশটিতে। এর পাশাপাশি যোগ হয় করোনা অতিমারি পর্ব। পর্যটন ক্ষেত্র শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি। অতিমারির জেরে সবকিছু স্তব্ধ হয়ে যাওয়ায় শ্রীলঙ্কার আর্থিক সঙ্কট চরমে ওঠে।


দেশের আর্থিক পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হতে থাকায় দেখা দেয় জনরোষ। তাঁদের আন্দোলনের জেরে স্তব্ধ হয়ে পড়ে গোটা দেশ। রাস্তায় নেমে আসেন আন্দোলনকারীরা। আর এই প্রতিবাদের জেরেই তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। তাঁর সরকারি বাসভবনে ঢুকে পড়েন আন্দোলনকারীরা। কারণ, সেই সময় দেশজুড়ে শুরু হয়ে গেছে খাদ্য, জ্বালানি-সহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিসের সঙ্কট। দেশবাসী প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষে এবং প্রধানমন্ত্রী মহিন্দা রাজাপক্ষের পদত্যাগ দাবি করেন। কারণ, তাঁরা মনে করেন, এই সরকারের অব্যবস্থার কারণে শ্রীলঙ্কায় অর্থ-সঙ্কট তৈরি হয়েছে।


মার্চের গোড়ার দিকে, বিদ্যুতের ঘাটতি এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অভাবের জেরে শ্রীলঙ্কার হাজার হাজার মানুষ মিরিহানায় প্রেসিডেন্টের নিজস্ব বাসস্থানের কাছে প্রতিবাদ শুরু করেন। বিক্ষুব্ধদের হাতে দেখা যায় প্ল্যাকার্ড। তাতে লেখা, "গোতা গো হোম।"  সরকারের বিরুদ্ধে রব ওঠে। প্রেসিডেন্টের বাসভবনে যাতে আন্দোলনকারীরা ঢুকতে না পারেন, তার জন্য নিরাপত্তার কড়াকড়ি শুরু হয়। তা সত্ত্বেও বাড়তে থাকে আন্দোলনের ঝাঁঝ। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস এবং গ্যাস ও জ্বালানির দামবৃদ্ধি, বিদ্যুতের ঘাটতি-সহ বিভিন্ন সমস্যার বিরুদ্ধে ওঠে স্লোগান। 


এই পরিস্থিতিতে ৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী মহিন্দা রাজাপক্ষে ছাড়া ২৬ জন মন্ত্রিসভার সকলেই ইস্তফা দেন। 


৫ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া চার মন্ত্রীকে সংসদে স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য নিয়োগ করেন। যদিও ক্ষুব্ধ জনতা তখন প্রেসিডেন্টের ইস্তফার দাবিতে সোচ্চার। আরও বেশি মানুষ আন্দোলনে যোগ দেওয়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত টিকে থাকে এই সরকার। তার আগে জরুরি আর্থিক সহায়তার জন্য আইএমএফের কাছে আবেদন জানায় শ্রীলঙ্কার অর্থমন্ত্রক। সঙ্গী দেশগুলির কাছ থেকেও আর্থিক সাহায্য চায় তারা। এরপর ১৮ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট ১৭ জনের মন্ত্রিসভা গঠন করেন। সরকার পরিচালনার জন্য। কলম্বোয় সরকারের পক্ষে থাকা মানুষ ও সরকার-বিরোধীদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। ক্ষোভের আঁচ দেশের অন্যত্রও ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাওয়ায়, ৯ মে পদত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী মহিন্দা রাজাপক্ষে। সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণে আনতে গোটা দেশজুড়ে কার্ফু জারি হয়। ১৩ মে শ্রীলঙ্কার ২৬ তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন রণিল বিক্রমসিঙ্ঘে। অপ্রয়োজনে গাড়িতে যাতায়াত করা বা পেট্রোল ভরা সাময়িক বন্ধ রাখার জন্য দেশবাসীর কাছে আবেদন জানান শ্রীলঙ্কার বিদ্যুৎ ও শক্তিমন্ত্রী। ২০ জুন সেই আবেদন জানানোর সময়ই তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন, ২৩ জুন একটি পেট্রোল ট্যাঙ্কার ও ২৪ জুন একটা ডিজেল ট্যাঙ্কার দেশে পৌঁছে যাবে বলে তিনি আশা করছেন।


আন্দোলনকারীরা ৯ জুলাই কলম্বোয় তাঁর সরকারি বাসভবনে ঢুকে পড়ায় সেখান থেকে পালান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে। সেইসময় সোশ্যাল মিডিয়ায় একাধিক ছবি ছড়িয়ে পড়ে। তাতে দেখা যায়, আন্দোলনকারীরা, সরকারি বাসভবনে ঢুকে স্যুইমিং পুলে সাঁতার কাটছেন, কেউ আবার রান্নাঘরে রান্নায় এবং শোওয়ার ঘরে শুতে ব্যস্ত। স্ত্রী এবং নিরাপত্তাকর্মীদের নিয়ে ১৩ জুলাই মলদ্বীপের উদ্দেশে পাড়ি দেন প্রেসিডেন্ট। সেখান থেকে ১৪ জুলাই সিঙ্গাপুর পৌঁছে যান। 


এরপর ১৫ জুলাই শ্রীলঙ্কার সংসদের অধ্যক্ষ মহিন্দা ইয়াপা আবেওয়ার্দনে ঘোষণা করেন, তিনি প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের ইস্তফাপত্র পেয়েছেন। তাঁর ইস্তফার পর দায়িত্বপ্রাপ্ত-প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী রণিল বিক্রমসিঙ্ঘে। এরপর ১৮ জুলাই তিনি দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। ২১ জুলাই প্রেসিডেন্ট-ইলেক্ট রণিল বিক্রমসিঙ্ঘে শ্রীলঙ্কার ৮ম এক্সিকিউটিভ প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন । এরপর ২০ জুলাই সংসদীয় ভোটে জিতে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনি।


ছোট এই দ্বীপরাষ্ট্রটিতে আর্থিক হাল ফিরিয়ে আনা এখন বড় চ্যালেঞ্জ।