কলকাতা: অর্ধেক আকাশ যাঁরা, তাঁদের ওড়ার জন্য সত্যিই কি সমাজ অর্ধেক আকাশ ছেড়ে রাখে? এই সময়ে দাঁড়িয়েও বারবার প্রশ্ন ওঠে নারী স্বাধীনতা, নারী সুরক্ষা, নারী অধিকার (Women Right) এবং বেতনের বৈষম্য নিয়ে। ইতিহাস বলে ১৯০৯ সালে আমেরিকায় কাজের অধিকার, সম বেতনের দাবি এবং ভোট দেওয়ার অধিকারের দাবিতে যে নারী আন্দোলন হয়েছিল তার হাত ধরেই সূচনা হয়েছিল আন্তর্জাতিক নারী দিবসের। কোথাও আবার উল্লেখ করা হয় ফ্যাসিস্ট-বিরোধী আন্দোলনের নেত্রী ক্লারা জেটকিনের লড়াইয়ের কথা। ভারতে সাবিত্রীবাই ফুলে,অরুণা আসফ আলি, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন থেকে ভানওয়ারি দেবী, রূপ কানোয়ারের মতো অসংখ্য প্রণম্যা নারীদের লড়াইয়ের কাহিনীও জ্বলজ্বল করছে। 


প্রতিবছরই ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস (International Women's Day 2024)v হিসেবে পালিত হয়। এই দিনটিকে ঘিরে নানা আলোচনা সভা, মিটিং-মিছিলও আয়োজিত হয়। ২০২৪ সালের ৮ মার্চ দিনটির আগে বরং একবার ফিরে দেখা যাক এক নারীর কাহিনি। যিনি লড়াই করে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন, যাবতীয় প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে লড়ে বিজয়ীর মতো পড়েছেন সাফল্যের মুকুট। শুধু নিজে সফল হয়েই থেমে যাননি এখন অনুপ্রাণিত করে যাচ্ছেন তাঁর মতো অসংখ্য মানুষকে, তাঁকে দেখে মনের জোর পাচ্ছেন অসংখ্য নারী।


যে নারীর কথা বলা হচ্ছে- তাঁর নাম ভিরালি মোদি (Virali Modi Profie)। ভারতের প্রথম মডেল যিনি হুইলচেয়ার ব্যবহার করেন (India's 1st Wheelchair Using Model)। শুধুমাত্র একজন মডেলই নন। ভিরালি কাজ করেন বিশেষভাবে সক্ষম নাগরিকদের অধিকার (disability Rights Activist) নিয়ে। মোটিভেশনাল স্পিকার হিসেবেও তিনি পরিচিত। কিন্তু আজকের উজ্জ্বল দিনের ছবিগুলির পিছনে রয়েছে বহুদিন ধরে দাঁতে-দাঁত চেপা লড়াই। রয়েছে অসম্ভব যন্ত্রণা এবং তা থেকে উত্তরণের কাহিনি।


ভিরালি মোদি ছোট থেকেই ছিলেন আমেরিকায়। তখন তার ১৪ বছর বয়স। সালটা ২০০৬। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। জ্বরের জন্য ওষুধ দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বাড়িতে। কিন্তু পরদিনই আরও বিপদ। কোমরের নীচ থেকে সাড় হারাতে থাকেন তিনি, নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকে মূত্র বিসর্জনেও। ফের দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে মেরুদণ্ডে কোনও সমস্যা রয়েছে মনে করে চিকিৎসকরা চিকিৎসা করতে যান। তখনই হঠাৎ খিঁচুনি শুরু হয় ভিরালির এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট। ফুসফুসেও সমস্যা ধরা পড়ে। ডাক্তাররা মনে করেছিলেন তিনি মারাই গিয়েছেন। প্রায় ২০ দিন কোমায় ছিলেন তিনি। ভেন্টিলেটর থেকে ভিরালিকে বের করে দেওয়া হবে এমনটা প্রায় সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিলেন চিকিৎসকরা। কিন্তু তাঁদের অবাক করেই ফের চোখ মেলেন ভিরালি। কিন্তু তারপর বছর চারেক ধরে বারবার অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন ভিরালি। তাঁকে 'ক্লিনিকালি ডেড'-ও বলা হয়েছিল।


তারপরে ভিরালির পরিবার শেষ চেষ্টা করে। তাঁকে নিয়ে আসে মুম্বইয়ে। ২০১০ সালে মুম্বইয়ে NeuroGen Brain and Spine Institute-এ শুরু হয় Transverse Myelitis-এ আক্রান্ত ভিরালির চিকিৎসা। ২০১০, ২০১৩ এর দুইবার সেল থেরাপি (Cell Therapy) হয় ভিরালির। ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু করে। পায়ে জোর ফিরতে থাকে ভিরালির। এরপর আর পিছনে নয় সামনে তাকাল ভিরালি। 


২০১৪ সালে Miss Wheelchair India-এর ফার্স্ট রানার আপ হন তিনি। তারপরেই যেন আরও বেশি করে ফিরে পেয়েছিলেন আত্মবিশ্বাস। ২০১৪ সালে আরও একবার সেল থেরাপি করা হোল তাঁর। NeuroGen Brain and Spine Institute-এর ওয়েবসাইট অনুযায়ী  তারপরেই শরীরে নীচের দিকের অংশ তুলনায় অনেকটাই সহজ হয়। 


লেখা প্য়াশন তাঁর। মডেলিং স্বপ্ন। মডেলিংয়ের জন্য় অডিশনও দিয়েছেন তিনি। বেশ কিছু রিপোর্ট অনুসারে বহু জায়গায় ঠোক্কর খেতে হয়েছে। অপমানিত হতে হয়েছে। কিন্তু মা এবং পরিবারের সদস্যরা সবসময় তাঁর হাত শক্ত করে ধরেছিলেন। ২০১৮ সালে প্রথম ব্রেক পান তিনি। সলমন খানের সংস্থা Being Human-এর বিজ্ঞাপনে কাজের সুযোগ পান তিনি। সেইসময় মুম্বইয়ে নানা জায়গায় হোর্ডিংয়ে ছেয়ে গিয়েছিল তাঁর ছবি। সেই বছরেই আরও Ethnicity নামের একটি ব্র্যান্ডের জন্য কাজ করার সুযোগ আসে তাঁর। তারপর পরপর সুযোগ, Tailor and Circus, Nykaa, WeWork থেকে Unilever, Bank of America-এর মতো একাধিক প্রথম সারির সংস্থার সঙ্গে কাজ করে ফেলেছেন তিনি।


 






মডেলিংয়ের মাধ্যমে বিশেষভাবে সক্ষমদের জন্য সচেতনতা তৈরি করার লক্ষ্যের কথা বারবার বলেছেন। তৈরি করেছেন #MyTrainToo, #RampMyRestaurant, #FlyWithDignity.-এর মতো সোশ্যাল মিডিয়া ক্যাম্পেইন। সেগুলো কী? সেই কথার আগে আরও একটি বিষয়ে বলা প্রয়োজন। সম্প্রতি একটি গাড়ি প্রস্তুতাকারী সংস্থার আলোচনা সভায় নিজের একাধিক অভিজ্ঞতার কথাও তুলে ধরেছেন। এই অভিজ্ঞতাগুলির জন্যই সোশ্যাল মিডিয়া ক্যাম্পেন (Virali Social Media Campaign) শুরু।


২০১২ সালে ভারতে ট্রেনে ওঠার জন্য সমস্যায় পড়েছিলেন চিনি। কামরায় ওঠার সিঁড়ি তাঁর পক্ষে ব্যবহার সম্ভব ছিল না। সেই সময় এক পোর্টারের সাহায্য চাইতে গিয়ে তিনি নিগৃহীত হয়েছিলেন বলে অভিযোগ। তিনি বিষয়টি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর দফতরে এবং রেলমন্ত্রকে চিঠি লিখেছিলেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় সমর্থনের আভাস পেয়ে, ভারতের রেল স্টেশনে বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের সুবিধার জন্য পরিকাঠামো গড়ে তোলার দাবিতে তিনি শুরু করেন  #MyTrainToo- প্রচার। সাড়াও মেলে সরকারে। এখন তাঁর উদ্যোগে এবং রেলের সাহায্যে দেশের একাধিক স্টেশনে তেমন পরিকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। আরও কাজ চলছে।


মুম্বইয়ে এমন সমস্যা দেখেছিলেন যে অনেক রেস্তরাঁতেই বিশেষ ভাবে সক্ষমদের যাতায়াতের জন্য কোনও ব্যবস্থা নেই। যাঁর ফলে অনেকে পরিবারই সমস্যায় পড়েন। তিনি নিজেও পড়েছিলেন। তাই রেস্তরাঁগুলিতে ব়্যাম্প লাগানোর দাবিতে শুরু হয় এই সোশ্যাল ক্যাম্পেন। বিশ্ব পর্যটন দিবসের দিন শুরু করেছিলেন এই ক্যাম্পেন। শুধু ব়্যাম্পই নয় আরও নানা পরিকাঠামোর প্রয়োজনীয়তার কথাও তুলে ধরেছেন তিনি।


বিশেষ ভাবে সক্ষমদের বিমানে চড়া নিয়েও নানা অভিযোগের ঘটনা সামনে আসে। কখনও পরিকাঠামোর অভাব। কখনও বিমানকর্মীদের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ। এমনই একটি ঘটনার পরে ভিরালি মোদি সোশ্যাল মিডিয়ায় শুরু করেন #FlyWithDignity প্রচার।


২০২৩ সালেও একটি অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সামনে পড়তে হয় তাঁকে। সেদিনটি ছিল তাঁর বিয়ের দিন। মুম্বইয়ে রেজিস্ট্রার অফিসে গিয়েছিলেন বিয়ের রেজিস্ট্রির জন্য। কিন্তু সেই অফিসে লিফট ছিল না। এদিকে ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের অফিস ছিল তিন তলায়। তিনি অভিযোগ করেছিলেন, পরিস্থিতি বুঝিয়ে বলার পরেও সরকারি আধিকারিক নীচে নেমে সইসাবুদের কাজ করতে চাননি। বাধ্য হয়ে তাঁকে ধরে তিনতলায় ওঠানামা করতে হয় পরিজনদের। এত কাণ্ড করে বিয়ের পরে X হ্যান্ডেলে পোস্ট করেন তিনি। গোটা ঘটনা জানিয়ে ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন। দেশের বিশেষভাবে সক্ষম নাগরিকদের কেন বারবার এমন অপমানের মুখে পড়তে হবে সেই প্রশ্নও তুলেছিলেন। লিখেছিলেন, 'আমি কোনও জিনিসপত্র নই যে দুটো তলা বয়ে নিয়ে যেতে হবে। আমি মানুষ এবং আমার অধিকার রয়েছে।' সেই পোস্ট ভাইরাল হয়। দ্রুত উত্তর দেন মহারাষ্ট্রের তৎকালীন উপ মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়ণবীশ। তাঁকে বিয়ের জন্য শুভেচ্ছা জানিয়ে সরকারি অসুবিধার জন্য় দুঃখপ্রকাশ করে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষের করার আশ্বাস দিয়েছিলেন তিনি। এই বছরেই Hyundai-এর জন্য় শাহরুখ খানের সঙ্গে কাজও করেন তিনি। 


 






ভিরালি মোদি তাঁর একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন তাঁর এই লড়াইয়ের কথা। বিষয়টি যে সামগ্রিক, গোটা দেশ যাতে বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের জন্য সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে, তাঁদেরকেও সমান সুযোগ দিতে পারার মতো জায়গায় ওঠে সেই জন্য়ই এই লড়াই বলে জানিয়েছেন তিনি। আর এই কাজে দেশের সব নাগরিকের সচেতন যোগদানের আশাও প্রকাশ করেছেন বারবার। বারবার চেষ্টা করেও মৃত্যু যাঁকে ছুঁতে পারেনি, এই লড়াই তাঁর কাছে নিশ্চয়ই তুচ্ছ। হয়তো শুধু প্রয়োজন বাকি নাগরিকদের সহমর্মিতা।


আরও পড়ুন: নার্সের চাকরি করেও প্রস্তুতি! সময় মেপে পড়েই আজ বিডিও মৃণ্ময়ী