পায়েল মজুমদার, কলকাতা: গাঙের গানে এত নেশা? দিন কেটে রাত আসে, রাত পেরিয়ে দিন, পদ্মানদীর মাঝিদের বৈঠা আর গান চলতেই থাকে। কান পেতে শোনে ছোট্ট মেয়েটা। ফরিদপুরের (Faridpur) জমিদারবাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে থেকেও ভাটিয়ালি শুনলেই মন কেমন করে উঠত গীতার। তখনও কি সে জানত, একদিন গানের সরণী বেয়ে এত খ্যাতি ও সম্মান আসবে? পিতৃদত্ত ঘোষ রায়চৌধুরী পদবী বদলে হয়ে উঠতে হবে গীতা দত্ত (Geeta Dutt)? ভারতীয় চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী, গুরু দত্তের (Guru Dutt) সঙ্গে সম্পর্কের এমন চড়াই-উতরাই পেরোতে হবে যার উপান্তে অপেক্ষা করে থাকবে বিষণ্ণ মৃত্যু (Tragic Death)? তবে এসবের নেপথ্যে গান নাকি গীতা দত্ত নিজে নাকি অন্য কোনও বিষয়, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। আজও আছে। মুম্বইয়ের চলচ্চিত্র জগৎ অবশ্য এসব বাদ দিয়ে এক কথায় মেনে নেয়, গীতা দত্তের অবিশ্বাস্য সঙ্গীত-প্রতিভার কথা। শোনা যায়, একমাত্র ফরিদপুরের এই কন্যাকেই কিছুটা সমীহ করতেন ভারতের 'নাইটিংগল' লতা মঙ্গেশকর (Lata Mangeshkar)। 



জন্ম ও প্রথম জীবন ...
জন্ম ১৯৩০ সালের ২৩ নভেম্বর। অবিভক্ত ভারতের ফরিদপুরে। সেখানকার জমিদার ঘোষ রায়চৌধুরী পরিবারের দশ সন্তানের পঞ্চম ছিলেন গীতা। ছোট থেকেই অসম্ভব সুরেলা গলা। মা-বাবার নজর এড়ায়নি। শ্রী হরেন্দ্রনাথ নন্দীর কাছে মেয়ের তালিমের ব্যবস্থা করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু জমিদারি তথা আর্থিক অবস্থা পড়ে যাওয়ায় ফরিদপুর ছেড়ে চলে আসতে হয় ঘোষ রায়চৌধুরীদের। চেতলা এলাকায় সামান্য কিছুদিন কাটিয়ে মুম্বই পাড়ি দিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু সেখানে আর কিশোরী গীতার গানের তালিমের ব্যবস্থা করতে পারেননি মা-বাবা। তাতে কী? কিশোরী গীতা নিজের মতো করে চর্চা করে যেতেন। আর তাতেই একদিন হঠাৎ পণ্ডিত হনুমান প্রসাদের নজরে পড়ে যান। মুম্বইয়ে তাঁদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন পণ্ডিত  হনুমান প্রসাদ। কানে আসে মধুর স্বর। বাড়ির বাসিন্দাদের জিজ্ঞাসা করেন গায়িকা সম্পর্কে। তার পর, 'ভক্ত প্রহ্লাদ'ছবিতে গান করার প্রস্তাব দেন ষোড়শী গীতাকে। সালটা ১৯৪৬। সেই শুরু। বাকিটা ইতিহাস...


 


নক্ষত্রের উত্থান...      
'ভক্ত প্রহ্লাদ'ছবিতে তাঁর গান মুগ্ধ করেছিল শচীন দেব বর্মনকে। পদ্মাপাড়ের কন্যাকে 'দো ভাই' ছবির প্রধান গায়িকা করেন তিনি। শোনা যায়, অনেকে মানা করেছিলেন তাঁকে। কিন্তু শচীনকর্তা টের পেয়েছিলেন 'মেরা সুন্দর সপনা বিত গ্যয়া'-র বুকভাঙা আর্তি স্রেফ ওই কিশোরীর হৃদয় থেকেই বেরোতে পারে। গান শুনে চমকে উঠেছিল মুম্বই তথা পুরো ভারত। কে ইনি? দেখতে দেখতে গীতা ঘোষ রায়চৌধুরীর জনপ্রিয়তা মুম্বইয়ের আকাশ ছেয়ে ফেলে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৯ সালের মধ্যে জনপ্রিয়তার শিখর ছুঁয়ে ফেলেন গায়িকা। আর সেই গানের ছায়াপথ ধরেই জীবনে আসেন নায়ক, গুরু দত্ত।



'তদবির সে বিগরি হুই তকদির বনা লে... '
'বাজি' ছবির এই গান বহু দশক পেরিয়েও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। মুম্বইয়ের বিখ্যাত মহালক্ষ্মী স্টুডিওয় গানটি যখন তরুণী গীতা রেকর্ড করছেন, সামনে বসে শুনছিলেন ছবির পরিচালক গুরু দত্ত। এত সাবলীলভাবে এই গানটিকে কী ভাবে গাইছেন তরুণী? অজান্তেই মুগ্ধ হয়ে যান ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রবাদপ্রতিম নায়ক ও পরিচালক। এর পর থেকেই ধীরে ধীরে, গুরু দত্তের বাড়িতেও যাতায়াত শুরু হয় গীতার। তরুণীর প্রেমে পড়ে যান গুরু দত্ত। টানা তিন বছরের পত্রালাপ ও দেখাশোনার পর বিয়ে করেন। গীতা হয়ে ওঠেন গীতা দত্ত। সালটা ১৯৫৩। বিয়ের সময়ে বাংলার শিকড়ের কথা ভোলেননি গায়িকা। নিজে লাল বেনারসি ও গয়নায় সেজেছিলেন। আর ধুতি-সিল্কের পাঞ্জাবি পরেছিলেন গুরু  দত্ত। 



চড়াই-উতরাই...
দাম্পত্যে প্রেম মানেই কি শান্তি? বোঝা যায় না। মুম্বই চলচ্চিত্র জগৎ তাই বোধহয় আজও এই দুইয়ের কথা মনে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তবে এমন একটা কিছু যে হতে পারে, সে কথা ঘনিষ্ঠদের কেউ কেউ আন্দাজ করেছিলেন। তাঁদের মতে, গুরু-গীতা দু'জনেই ছিলেন অসম্ভব জেদি। তার উপর,বিয়ের সময় গীতার খ্যাতি মধ্যগগনে, গুরু দত্ত তখনও পায়ের তলার জমি শক্ত করার লড়াই করছেন। তবে এই বিষয়টি হয়তো খুব একটা সমস্যা তৈরি করেনি কারণ উপার্জন নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত ছিলেন না ভারতীয় চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি। গণ্ডগোল শুরু হয় অন্য বিষয়ে। ঘনিষ্ঠমহলের অনেকের দাবি, গুরু দত্ত চাইতেন তাঁর ব্যানার ছাড়া অন্য কোনও ব্যানারের জন্য গান করবেন না গীতা। তাতেও যেমন কিছু অসামান্য গান উপহার দিয়েছেন বাঙালি কন্যা, ঠিক তেমনই হারিয়েছেন বেশ কিছু সুযোগও। অনেকে মনে করেন, গীতা দত্তের যে বিভিন্ন ধরনের গান করার সাবলীল ক্ষমতা ছিল, এর ফলে তা অনেকটাই ধাক্কা খায়। তাও লুকিয়ে টুকটাক পারফর্ম করতেন তিনি। কিন্তু গোলযোগ চরমে পৌঁছয়  C.I.D ছবির পর।



ওয়াহিদা রহমান...
 C.I.D ছবিতে ওয়াহিদা রহমানের সঙ্গে চলচ্চিত্র জগতের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন গুরু দত্ত। শোনা যায়, ওয়াহিদার সঙ্গে তাঁর সমীকরণ জটিল দাম্পত্যকে জটিলতর করে তোলে। শুরু হয় টানাপড়েন। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তীব্র বাদানুবাদ হত প্রায়ই, আর তার পর ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যেতেন গায়িকা। কিন্তু গুরু দত্ত ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য, গীতার প্রতি নায়কের ভালোবাসা ছিল অটুট। তাই স্ত্রীকে একাধিক বার ফিরিয়ে আনতেন। কিন্তু 'প্যায়াসা', 'কাগজ কা ফুল' এবং 'সাহেব বিবি অওর গুলাম'ছবিতে গীতা দত্তের কণ্ঠ শুনে মনে হওয়ার জো নেই যে নেপথ্যে দানা বাঁধছে বিচ্ছেদের মেঘ। দর্শক-শ্রোতাদের মুখে মুখে তখন শুধুই, 'না যাও সাঁইয়া, ছুড়াকে বাঁইয়া', 'আজ সজন মুঝে অঙ্গ লগালো', 'বাবুজি ধীরে চলনা'...আর কত গান।



পূর্ণচ্ছেদ...
নড়বড়ে সম্পর্ক সন্দেহের তুফান নিতে পারেনি। তার উপর 'কাগজ কা ফুল' ফ্লপ। শোনা যায়, অবসাদে ভুগতে শুরু করেন গুরু দত্ত। দু'বার আত্মঘাতীও হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। ১৯৬৩ সালে আলাদা হয়ে যান নায়ক-গায়িকা। গীতা থাকতে শুরু করেন সান্তাক্রুজে। গুরু দত্ত ছিলেন পেডার রোডের তিন কামরার ফ্ল্যাটে। বছরখানেক পর একদিন দরজা ভেঙে ঢুকতে হয়েছিল সেই ফ্ল্যাটেই। কারও ডাকে  আর কখনও দরজা খোলেননি গুরু। স্লিপিং পিল ও মদের কম্বিনেশন বড় বেশি হয়ে গিয়েছিল। ৩৯ বছর বয়সে চলে যান নায়ক-পরিচালক। অন্তিম যাত্রায় তাঁকে নিয়ে যাওয়ার আগে ডুকরে কেঁদে ওঠেন গায়িকা। বলেছিলেন, 'ওঁকে নিয়ে যেও না।' বিচ্ছেদ নাকি অভিমান? কী ছিল ওঁদের মধ্যে?


একই পথে...
গুরু দত্ত চলে যাওয়ার পর আর্থিক দিক থেকে বেশ কিছুটা কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়েন গায়িকা। গান করার চেষ্টা করেন। এমনকি বাংলা ছবি 'বধূবরণ'-এ অভিনয়ও করেন। কিন্তু তত দিনে লতা মঙ্গেশকর এবং আশা ভোঁসলে কণ্ঠে মুগ্ধ ভারত। আর পদ্মাপাড়ের কন্য়ার হাতে উঠে এসেছে মৃত্যু-নেশা। গান করবেন কি? কিন্তু প্রতিভার ছটা নেশার মেঘে ঢাকা পড়তেও সময় লাগে। বাসু ভট্টাচার্যের 'অনুভব' ছবিতে তাঁর কণ্ঠে গাওয়া সবকটি গান হিট। হায় ভাগ্য। 'এভাবেও ফিরে আসা যায়' বলে যখন গানের পথে আবার হাঁটতে শুরু করবেন তিনি, তখনই ধরা পড়ল 'সিরোসিস অফ লিভার।'  শেষের দিনগুলি অসহ্য যন্ত্রণায় কাটত। নাকেমুখে নল গোঁজা। কখনও কান বা নাক দিয়ে রক্ত বেরোত। বেশিরভাগ সময়ই বেহুঁশ থাকতেন পদ্মাপাড়ের কন্যা। তবে সব যন্ত্রণার শেষ হয়। তাঁরও হয়েছিল। সালটা ১৯৭২। ২০ জুলাই। চলে গেলেন গীতা দত্ত। শেষ হল এক অধ্যায়। 

    তবে ঘনিষ্ঠরা বলেন, সে দিন শুধু প্রাণবায়ু বেরিয়েছিল তাঁর। মৃত্যুঘণ্টা বেজেছিল আরও আগেই। কিন্তু কবে? যে দিন তাঁর গানের চৌহদ্দি বেঁধে দেওয়া হয়েছিল? নাকি যে দিন থেকে গুরু দত্তের সঙ্গে ওয়াহিদা রহমানের সম্পর্ক নিয়ে সন্দেহ করতে শুরু করেছিলেন? নাকি সে দিন, যখন রেকর্ড করেছিলেন সেই বিখ্যাত গান---'ওয়ক্ত নে কিয়া, ক্যায়া হসি সিতম, তুম রহে না তুম, হমে রহে না হম'?
উত্তর নেই। আছে শুধু মরমী গান, মর্মান্তিক মৃত্যু আর পদ্মার জল।       


আরও পড়ুন:উপার্জন কোটি টাকার বেশি, উত্তরপ্রদেশের ইউটিউবারের বাড়িতে অভিযান আয়কর দফতরের