Utpal Dutt Birthday: আগে কেউ ছিলেন না, পরে কেউ আসেনওনি, শ্রেণিহীন সমাজের স্বপ্ন দেখতেন উৎপল
অভিনেতা, পরিচালক, নাট্যকার, সামাজিক পরিচয়ের সংজ্ঞায় তাঁকে বেঁধে ফেলা কঠিন। নিজে কূপমণ্ডূক হয়ে থাকেননি, চারপাশের কাউকে হতেও দেননি। সরাসরি রাজনীতিতে না থেকেও, রাজনৈতিক টিপ্পনি করা থেকে বিরত করতে পারেনি কেউ। বরং বাঙালির চেতনার উন্মেষ ঘটাতে বরাবর সূচ ফুটিয়ে গিয়েছেন উৎপল দত্ত। জন্মবার্ষিকীতে ফিরে দেখা তাঁকে।
Download ABP Live App and Watch All Latest Videos
View In App১৯২৯ সালের ২৯ মার্চ অবিভক্ত ভারতের (অধুনা বাংলাদেশ) বরিশালের কীর্তনখোলায় জন্ম। পরিবারের আদি বাসস্থান ছিল কুমিল্লায়। আবার শিলংয়ে মামার বাড়িতে জন্ম বলে তাঁর নিজের লেখায় উল্লেখ রয়েছে। এ নিয়ে ধন্দ রয়েছে আজও।
গিরিজারঞ্জন দত্ত এবং শৈলবালা দত্তের পাঁচ সন্তানের মধ্যে উৎপল ছিলেন চতুর্থ। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত গিরিজারঞ্জন তৎকালীন সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণির মানুষ ছিলেন। ইংরেজ সরকারের কারাগারের ভারপ্রাপ্ত প্রশাসক হিসেবেও নিযুক্ত থেকেছেন।
শিলংয়ের সেন্ট এডমন্ডস স্কুলে প্রথমে ভর্তি হন। বাবা বদলি হলে বহরামপুর কৃষ্ণনাথ কলেজিয়েট স্কুলে। পরে কলকাতার সেন্ট লরেন্স থেকে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে শিক্ষালাভ। বাড়িতে পাশ্চাত্য শিক্ষার পরিবেশেই বড় হয়েছেন। ছোটবেলাতেই শেক্সপীয়রের নাটকের সংলাপ গড়গড় করে বলে দিতে পারতেন।
তবে নাটক বা চলচ্চিত্র জগৎ নয়, ছোট থেকে পিয়ানোর সুর আকর্ষণ করত উৎপল দত্তকে। পিয়ানো বাদক হওয়া স্বপ্ন ছিল তাঁর। কিন্তু হাতের আঙুলের দৈর্ঘ্য কম হওয়ায় সেই স্বপ্ন ত্যাগ করতে হয়। তবে কলকাতায় থাকার সময় মা-বাবার সঙ্গে থিয়েটার দেখার শুরু।স্কুলের ইংরেজি ভাষার নাটকেও চুটিয়ে অভিনয় করতে শুরু করেন। আর নাটক না থাকলে স্কুলের গ্রন্থাগারই ছিল তাঁর জগৎ। কলেজজীবনে এসে ইরেজি ভাষাতেই নাটক লেখায় হাতেখড়ি।দেশ-বিদেশের সঙ্গীতের অনুরাগীও ছিলেন। কলেজের পর সাউথ পয়েন্ট স্কুলে চাকরি পান। যদিও পরে তা ছেড়েও দেন তিনি। প্রেমিকা জেনিফার পের শশী কপূরকে বিয়ে করেন। দু’জনে পরে ‘সপ্তপদী’ ছবিতে দেখানো ‘ওথেলো’ নাটকের দৃশ্যের ডাবিং করেন।
একাধিক বার নিজের নাটকের দলের নাম বদলেছেন উৎপল। ১৯৪৯ সালে প্রথমে ‘কিউব’ নাম রাখলেও, পরে নামকরণ হয় ‘লিটল থিয়েটার গ্রুপ’, যাতে যোগ দেন রবি ঘোষ, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়রা। হেনরিক ইবসেনের বাংলা অনুবাদ ‘গোস্টস্’ নাটকটি দিয়ে বাংলা নাটকে হাতেখড়ি তাঁর দলের। মাঝে গণনাট্য সংঘেও যোগ দেন উৎপল। কিন্তু অভ্যন্তরীণ সংঘাতের জেরে বেরিয়ে আসেন কয়েক মাস পরেই।
এর পর মিনার্ভা থিয়েটার লিজ নিয়ে নাটক মঞ্চস্থ করতে শুরু করেন। আর্থিক সঙ্কটে মিনার্ভার তিনতলার ঘরেই সংসার পেতে ফেলেন। অভিনেত্রী শোভা সেনের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে শোভার প্রথম পক্ষের স্বামীর সঙ্গে টানাপোড়েন শুরু হয়। অনেক পরে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন দু’জনে। তাঁদের এক কন্যা, বিষ্ণুপ্রিয়া।
মিনার্ভায় নাটক চলাকালীনই সেইসময় ধানবাদে কয়ালাখনিতে দুর্ঘটনা ঘটে। বহু শ্রমিক মারা যান। খবর পেয়েই কয়লাখনিতে ছুটে যান উৎপল, রবি এবং সকলে। সেই নিয়েই ‘অঙ্গার’ নাটকটি লেখেন। এর পর একে একে ‘ফেরারি ফৌজ’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘প্রফেসর মামলক’, ‘কল্লোল’-এর মতো সাড়া জাগানো নাটক মঞ্চস্থ করেন, যা থেকে সূচনা হয় গণ আন্দোলনের। ‘কল্লোল’-এর জন্য গ্রেফতার এবং জেলবন্দি হন উৎপল।
নকশাল আন্দোল নিয়ে ‘তীর’ নাটকটি মঞ্চস্থ করেন উৎপল। তাতেও তাঁর নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। মুম্বইয়ের তাজ হোটেল থেকে স্বেচ্ছায় ধরা দেন উৎপল। আর কখনও কোনও রাজনৈতিক নাটক লিখবেন না বলে মুচলেকা দিয়ে জামিন পেলেও, রাজনৈতিক নাটক লেখা এবং তা মঞ্চস্থ করা থেকে সরে আসেননি তিনি।
‘লিটল থিয়েটার গ্রুপ’ থেকে বহিষ্কৃত হয়ে ‘মানুষের অধিকার’ নাটকটি মঞ্চস্থ করেন। মিনার্ভা ছেড়ে বেরিয়ে এসে গড়ে তোলেন ‘বিবেক নাট্যসমাজ’। ১৯৭১ সালে রবীন্দ্র সদনে অভিনীত হয় দলের প্রথম নাটক ‘টিনের তলোয়ার’। এর পর ‘ব্যারিকেড’, ‘টোটা’, ‘দুঃস্বপ্নের নগরী’, ‘তিতুমীর’, ‘স্তালিন ১৯৩৪’, ‘লালদুর্গ’-এর মতো নাটক মঞ্চস্থ করেন। ‘একলা চলো রে’ নাটকেই শেষ বার মঞ্চে অভিনয়। নাটকের পাশাপাশি যাত্রার মঞ্চ থেকেও গ্রামে গঞ্জের মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক বোধের সঞ্চার করেন।
অসংখ্য বাংলা এবং হিন্দি ছবিতে অভিনয় করেছেন উৎপল। এক দিকে, অজয় কর, তরুণ মজুমদার, তপন সিংহ, হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়, শক্তি সামন্তের পরিচালনায় চুটিয়ে অভিনয় করেছেন, আবার মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, গৌতম ঘোষের ছবিতেও অন্য ভাবে তাঁকে পেয়েছেন দর্শক।
সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় ‘আগন্তুক’ ছবিতে তাঁর অভিনয় আজও দাগ কাটে দর্শকের মনে। উৎপল রাজি না হলে ছবি বানাতেনই না বলে পরে জানান সত্যজিৎ। ১৯৯৩ সালের ১৯ আগস্ট উৎপলের জীবনাবসান হয়।
- - - - - - - - - Advertisement - - - - - - - - -