Hidimbaa and Bheema: মহীয়সী রমণী, ভীমজায়া বীরপুত্রের জননীও, শুধুমাত্র রাক্ষসকুলে জন্ম বলেই মহাভারতে উপেক্ষিত হিড়িম্বা!
মূলত রাজনৈতিক রচনা বলেই গন্য হয় ‘মহাভারত’। তবে সমাজ, দর্শন, প্রেম, বিয়ের, পরকীয়া, সবকিছুরই মিশেল রয়েছে এই মহাকাব্যে। মহাভারতের প্রেমকাহিনির কথা ধরলে একাধিক আখ্যান উঠে আসে। সেই আখ্যানের তালিকায় রয়েছে কৃষ্ণ-রুক্মিনী, গঙ্গা-শান্তনু, অর্জুন-উলুপি, অর্জুন-সুভদ্রা, দ্রৌপদী-পঞ্চপাণ্ডব, গান্ধারী-ধৃতরাষ্ট্র, পরাশর ঋষি-সত্যবতী, অর্জুন-চিত্রাঙ্গদা, শান্তনু-সত্যবতী, হিড়িম্বা-ভীমের প্রেমকাহিনি।
Download ABP Live App and Watch All Latest Videos
View In Appএর মধ্যে আলাদা করে হিড়িম্বা এবং ভীমের প্রেমকাহিনীর কথা বলতেই হয়। কারণ রাক্ষসী হিড়িম্বার সঙ্গে ভীমের সম্পর্ক নানা ওঠাপড়ার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। ভীমের প্রথমা স্ত্রী হয়েও উপেক্ষিতই রয়ে গিয়েছেন হিড়িম্বা।
জতুগৃহ থেকে রক্ষা পাওয়ার পর পাণ্ডবরা যখন নদী পার হয়ে জঙ্গলে প্রবেশ করেন, সেই সময়ই হিড়িম্বার আগমন ঘটে। সকলে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তাঁদের পাহারা দিচ্ছিলেন ভীম। ওই জঙ্গলেই বাস ছিল হিড়িম্ব রাক্ষসের। ভীমের ভয়ে সরাসরি পঞ্চপাণ্ডবের উপর আক্রমণ চালাতে পারছিল না হিড়িম্ব। তাই বোন হিড়িম্বাকে সুন্দরী রমণীর রূপ ধারণ করিয়ে সেখানে পাঠায়, যাতে কৌশলে ভীমকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু হিড়িম্বা নিজেই ভীমকে দেখে মুগ্ধ হন। সরাসরি প্রেম নিবেদন করেন। দাদার অভিসন্ধির কথাও ভীমকে জানান।
কিন্তু হিড়িম্বা রাক্ষসী জেনে চটে যান ভীম। প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এর পর হিড়িম্বের সঙ্গে যুদ্ধ বাধে তাঁর। তাতে বাকি পাণ্ডবদেরও ঘুম ভেঙে যায়। হিড়িম্বের মৃত্যুতে শোকে বিহ্বল হিড়িম্বাকেও হত্যা করতে উদ্যত হন ভীম। জঙ্গলে পাণ্ডবদের পিছু পিছু হিড়িম্বাকে চলতে দেখে ক্ষুব্ধ হন ভীম। কিন্তু হিড়িম্বা কুন্তীকে জানান, তিনি ভীমকে ভালবাসেন, বিয়ে করতে চান। কৌশলী কুন্তী জানতেন, কৌরবদের সঙ্গে যুদ্ধে পঞ্চপাণ্ডব পেরে উঠবেন না। ভীম এবং হিড়িম্বার সন্তান হলে, অত্যন্ত বলশালী হবে। যুদ্ধে পাণ্ডবদের সাহায্য করতে পারবে। সেই মতো ভীমের সঙ্গে হিড়িম্বার বিয়েতে মত দেন তিনি।
তবে এই বিয়ে ছিল শর্তসাপেক্ষে। যুধিষ্ঠিরের বক্তব্য ছিল, শর্তসাপেক্ষেই হিড়িম্বা এবং ভীম মিলিত হতে পারবেন। স্নান-আহ্নিক শেষ করে সারাদিন হিড়িম্বার সঙ্গে থাকতে পারবেন ভীম। সূর্যাস্তের পর পঞ্চপাণ্ডবদের কাছে ফিরে যাবেন তিনি। হিড়িম্বা গর্ভে সন্তানধারণ না করা পর্যন্তই তিনি হিড়িম্বার সঙ্গে থাকবেন বলে পণ নেন ভীমও। বিয়ের এক বছরের মধ্যেই হিড়িম্বা এবং ভীমের সন্তান ঘটোৎকচের জন্ম হয়। ঘটের মতো চকচকে কেশহীন মাথার জন্য এমন নামকরম। এর পর হিড়িম্বা এবং ঘটোৎকচক জঙ্গলে রেখেই প্রস্থান করেন পাণ্ডবরা। ভীম জানিয়ে যান, তিনি তিনবার নাম নিলে সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সামনে উপস্থিত হতে হবে ঘটোৎকচকে।
ফলে হিড়িম্বার একার কাঁধেই সন্তান লালনপালনের দায়িত্ব এসে পড়ে। এর পর দ্রৌপদীকে বিবাহ করেন ভীম। তাতে ক্ষুব্ধ হলেও, রাগ, দুঃখ, অভিমান চেপে রাখেন হিড়িম্বা। ছেলে ঘটোৎকচের কাছেই তা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন তিনি। তাই দ্রৌপদীর সঙ্গে সাক্ষাতে তাঁকে দু’চার কথা শুনিয়ে দেন ঘটোৎকচ। তাতে তিনি দীর্ঘায়ু হবেন না বলে অভিশাপ দেন দ্রৌপদীও। হিড়িম্বা যাতে কখনও প্রাপ্য অধিকার দাবি করতে না পারেন, সেই মতো ভীমের থেকেও প্রতিশ্রুতি নেন দ্রৌপদী।
তবে পাণ্ডবদের প্রতি বরাবরই নরম ছিলেন ঘটোৎকচ। বাবার প্রতি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। অর্জুন এবং সুভদ্রার ছেলে অভিমন্যূ ছিলেন তাঁর বন্ধু। অত্যন্ত সহানুভূতিশীল ছিলেন ঘটোৎকচ। কিন্তু হিড়িম্বা এবং ঘটোৎকচের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন ভীম। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় কৃষ্ণই ভীমকে ঘটোৎকচের কথা স্মরণ করান। সেই মতো ঘটোৎকচকে তলব করেন ভীম। যুদ্ধের ১৪তম দিনে অর্জুনকে বাঁচাতে গিয়ে কর্ণের ছোড়া শক্তিশেলে বিদ্ধ হয়ে প্রাণ দেন ঘটোৎকচ।
অভিমন্যূর মৃত্যুর পর মারা যান ঘটোৎকচ। কিন্তু অভিমন্যূর জন্য যেভাবে সন্তাপ করতে দেখা যায় পাণ্ডবদের, ঘটোৎকচের জন্য তেমন শোকার্ত হতে দেখা যায়নি কাউকেই। বরং সমাজ-সংসার থেকে উপেক্ষিত হিড়িম্বা একাই পুত্রশোকে বিহ্বল হয়ে পড়েন। জঙ্গলের মধ্যে তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কেউ ছিল না। শোকের সেই মুহূর্তেও স্বামীকে বিব্রত করতে চাননি হিড়িম্বা। যেহেতু দ্রৌপদীর কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন ভীম, স্বামীর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে হস্তিনাপুরেও ছুটে যাননি তিনি।
তাই পরবর্তী কালে হিড়িম্বার চরিত্রটি সমালোচকদের সহানুভূতি কুড়িয়েছে। ভালবাসার জন্য রাক্ষসকুল ত্যাগ করেছিলেন হিড়িম্বা। একাহাতে নিজের এবং সন্তানের দায়-দায়িত্ব পালন করেছিলেন। যে স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ি তাঁকে গ্রহণ করেনি, তাঁদের জন্য সন্তানের প্রাণ চলে গেলেও, একটি কুকথাও শোনা যায়নি তাঁর মুখে। ধর্ম এবং ন্যায়ের দর্শন শেখায় মহাভারত। কিন্তু মহাভারতে হিড়িম্বা দুই থেকেই বঞ্চিত বলে মনে করেন সমালোচকরা।
তৎকালীন সমাজে সাধারণ পরিবারের নারীদের কী স্থান ছিল, হিড়িম্বার চরিত্র দিয়েই তা বোঝা যায় বলে মত সমালোচকদের একাংশের। তাঁদের মতে, হিড়িম্বা ছিলেন স্বয়ংসম্পূর্ণা, স্বামীর প্রতি নিবেদিতা, সৎ এবং আত্মমর্যাদাসম্পূর্ণ নারী। কিন্তু শুধুমাত্র রাক্ষসকুলে জন্ম বলে পাণ্ডবরা তাঁকে গ্রহণ করেননি। তাই শুধু মহাভারত হিড়িম্বার সঙ্গে অন্যায় করেছে বলেই মত তাঁদের।
- - - - - - - - - Advertisement - - - - - - - - -