Life Insurance Corporation of India: পরাধীন ভারতে গড়ে ওঠে ভিত, এত বছর ধরে নিশ্চয়তার ঠিকানা, LIC-কে ঘিরে আজ আশঙ্কার মেঘ
‘জিন্দেগী কে সাথ ভি, জিন্দেগী কে বাদ ভি’, কর্পোরেট অফিসে বসে সাজানো শব্দবন্ধ বলে দাগিয়ে দেওয়া যায় অনায়াসে। কিন্তু আম ভারতীয়, কেটে খাওয়া ভারতীয়, সুস্থ জীবনের স্বপ্ন দেখে ভারতীয়র ভরসা হয়ে উঠেছিল এই পঙক্তি।
Download ABP Live App and Watch All Latest Videos
View In Appজীবন বিমার কথা উঠলেই তাই সবার আগে কানে বাজে দূরদর্শনের পর্দায় ভেসে ওঠা, বেতারে শোনা সেই সৃষ্টি, ভারতীয় জীবন বিমার (LIC) হাত ধরে আম ভারতীয়র জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে যা। অনিশ্চিত জীবনে যুগ যুগ ধরে মানুষকে নিশ্চয়তার আশ্বাস জুগিয়ে এসেছে এই মন্ত্র।
দেশের বৃহত্তম IPO হিসেবে বাজারে প্রথম বার শেয়ার ছাড়ার সময়ও (IPO) LIC-র উপর মানুষের বিশ্বাস টাল খায়নি। কিন্তু দেশের প্রথম সারির শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ওঠা কারচুপি এবং জালিয়াতির অভিযোগের সঙ্গে নাম জড়ানোয় বর্তমানে সেই বিশ্বাস এবং নিশ্চয়তাই এখন খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে।
আদানি গোষ্ঠীতে সব মিলিয়ে ৩৬ হাজার ৪৭৪ কোটি ৭৮ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করেছে LIC. সেই নিয়ে আশঙ্কার মধ্যে LIC জানিয়েছে, আম নাগরিকের বিনিয়োগ তাদের কাছে সুরক্ষিতই রয়েছে। তা সত্ত্বেও আতঙ্ক কাটছে না। ইতিহাসের এই সন্ধি ক্ষণে দাঁড়িয়ে তাই ফিরে দেখা LIC-র দীর্ঘ যাত্রাপথ।
১৮১৮ সালে ব্রিটেন থেকে প্রথম ভারতে আমদানি হয় জীবন বিমার। কলকাতায় ইউরোপীয়দের হাতে সূচনা হয় ওরিয়েন্টাল লাইফ ইনস্যুর্যান্স কোম্পানির, ভারতের মাটিতে গড়ে ওঠা প্রথম বিমা সংস্থার। সেই সময় ইউরোপীয়দের জীবনের নিশ্চয়তা স্বরূপ জীবন বিমার প্রবর্তন ঘটে ভারতে। সেই সময় আরও যে সমস্ত বিমা সংস্থা গজিয়ে ওঠে, তারা ভারতীয়দের জীবনের নিশ্চয়তা প্রদানে আগ্রহী ছিল না মোটেই।
ভারতীয়দের জন্য প্রথম বিমা সংস্থার পত্তন ঘটে ১৮৭০ সালে। নাম ছিল, বম্বে মিউচুয়াল লাইফ অ্যাসিওর্যান্স সোসাইটি। সেই সময় স্বদেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদের আবেগ ছড়িয়ে পড়েছে জনমনে। ১৮৯৬ সালে ভারত ইনস্যুর্যান্স কোম্পানি গড়ে ওঠে। এর পর ১৯০৫ থেকে ১৯০৭ সালের মধ্যে আরও একাধিক বিমা সংস্থার পত্তন হয়।
১৯০৬ সালে মাদ্রাজে দ্য ইউনাইটেড ইন্ডিয়া, কলকাতায় ন্যাশনাল ইন্ডিয়ান অ্যান্ড ন্যাশনাল ইনসিওর্যান্স, লাহৌরে কেঅপারেটিভ অ্যাসিওর্যান্স গড়ে ওঠে। ১৯০৭ সালে হিন্দুস্তান কোঅপারেটিভ ইনসিওর্যান্স কোম্পানির পত্তন ঘটে কলকাতার জোড়াসাঁকোয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতে। এ ছাড়াও আরও একাধিক বিমা সংস্থার সূচনা হয় ওই সময়।
১৯১২ সাল পর্যন্ত বিমা ব্যবসা নিয়ে ভারতে সুনির্দিষ্ট কোনও আইন ছিল না। ১৯১২ সালে লাইফ ইনস্যুর্যান্স কোম্পানিজ অ্যাক্ট এবং প্রভিডেন্ট ফান্ড অ্যাক্ট পাস হয়। কিন্তু তাতে ইউরোপীয় এবং ভারতীয়দের মধ্যে বৈষম্যমূলক আচরণ ছিল। ভারতীয় বিমা সংস্থাগুলির জন্য কোনও সুবিধাই বরাদ্দ ছিল না। এর পর ১৯২৮ এবং ১৯৩৮ সালে আরও দু’টি আইন আনা হয়,যার আওতায় বিমা সংস্থার যাবতীয় তথ্য সরকারের কাছে থাকা এবং জীবন বিমা বাদেও অন্য ধরনের বিমা সিলমোহর পড়ে।
জীবন বিমা ব্যবসার জাতীয়করণের দাবিও উঠতে থাকে পাশাপাশি। তবে ১৯৪৪ সালে সেই দাবি জোর পায়। সেই নিয়ে সংশোধনী আইনও বিলও তৈরি হয়। কিন্তু তার বাস্তবায়ন ঘটে আরও আনেক পরে। ভারতীয় জীবন বিমা আইনের আওতায় ১৯৫৬ সালে জাতীয়করণ ঘটে, অর্থাৎ জাতীয় সম্পত্তিতে পরিণত হয় LIC. সেই সময় ১৫৪টি ভারতীয় বিমা সংস্থা, ১৬টি ভারত বহির্ভূত বিমা সংস্থা এবং ৭৫টি প্রভিডেন্টের একত্রীকরণ ঘটিয়ে LIC-র পত্তন হয়। তদানীন্তন ভারত সরকার LIC-তে ৫ কোটি টাকা ঢালে।
LIC-র জাতীয়করণের নেপথ্য কারণ ছিল, ১৯৫৬ সালের শিল্প নীতি। তার আওতায় দেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ১৭টি ক্ষেত্রের উপর সরকার নিয়ন্ত্রণ কায়েমের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, যার মধ্যে নাম ওঠে LIC-রও।
২০২২ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে শাখাবিস্তারকারী সংস্থাগুলির মধ্যে LIC-ই বৃহত্তম। তাদের আটটি জোনাল, ১১৩টি বিভাগীয়, ৭৪টি গ্রাহক দফতর রয়েছেয় শাখা দফতর রয়েছে ২০৪৮টি এবং স্যাটেলাইট দফতর রয়েছে ১৫৪৬টি। LIC-র ৪২ হাজার পয়েন্টে বিনিয়োগ করতে পারেন গ্রাহক। সংস্থার ১৩.৫ লক্ষ এজেন্ট পলিসি বিক্রির কাজে নিযুক্ত।
সব মিলিয়ে LIC-র গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ২৫ কোটি। HDFC-র পর জীবন বিমা ব্যবসায় LIC-ই দ্বিতীয় বৃহত্তম সংস্থা। যদিও HDFC-র শাখার সংখ্যা ৪২১টি, গ্রাহক সংখ্যা ৬ কোটি এবং ৯৮০ শহরে তাদের উপস্থিতি রয়েছে। LIC-র মূল মন্ত্র হল ‘যোগক্ষেমং বহাম্যহম’, বাংলায় তর্জমা করলে অর্থ দাঁড়ায়, ‘আপনার কল্যাণের দায়িত্ব আমার’, ‘ভগবত গীতার’ নবম অধ্যায় থেকে সংগৃহীত।
বিলগ্নিকরণ নীতির আওতায় ২০২২ সালের মে মাসে বাজারে LIC-র IPO ছাড়ে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকার। তাতে দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরুতেই ২০ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা রাজকোষে ঢোকা নিশ্চিত হয়ে যায়। কিন্তু যত সময় এগোয় শেয়ারের দরে পতন দেখা যায়। IPO আনার সময় যেখানে LIC-র মূলধন ছিল প্রায় ৬ লক্ষ ২৪১ কোটি টাকা, তা নেমে আসে ৪ লক্ষ ৬০ হাজার কোটিতে।
LIC-র দাবি, আদানি গোষ্ঠীর শেয়ারে ৩৬ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করলেও, বর্তমান সময়ে তার মূল্য ৫৬ হাজার কোটি টাকা। ফলে ক্ষতির সম্ভাবনা নেই, সম্ভাবনা নেই লাভেরও। মূলধনের মাত্র ১ শতাংশই আদানি গোষ্ঠীতে বিনিয়োগ করা হয়েছে বলে দাবি LIC-র। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সাহারা গোষ্ঠীর উদাহরণ তুলে আনছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাঁদের যুক্তি, আজও সাহারা থেকে বিনিয়োগ এবং লাভের টাকা ফেরত পাননি সাধারণ মানুষ। সাহারার IPO-র আবেদন খতিয়ে দেখতে গিয়ে খোঁজ মেলে জালিয়াতির। দেখা যায়, বেআইনি ভাবে বাজার থেকে টাকা তোলার ভূরি ভূরি অভিযোগ রয়েছে। তাই সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত টাকা এ ভাবে ঝুঁকিপূর্ণ ভাবে কেন বিনিয়োগ করল LIC, প্রশ্ন উঠছে। এমনকি আদানিকে টাকার জোগান দিতেই LIC-তে সাধারণ মানুষের বিনিয়োগ ঢেলে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করছেন বিরোধীরাও।
- - - - - - - - - Advertisement - - - - - - - - -