সঞ্চয়ন মিত্র, কলকাতা: গুরু পূর্ণিমা মূলত গুরুকে কেন্দ্র করে প্রচলিত একটি বিশেষ সনাতন ধর্মীয় উৎসব যা ঐতিহ্য অনুসারে যুগ যুগ ধরে পালিত হয়ে আসছে। শিব আদিগুরু হিসেবে জগৎ বিখ্যাত। এই উৎসবে জগতের সমস্ত আচার্য তথা গুরুদের শিব জ্ঞানে পুজো করা হয়।
'গুরু' শব্দটিতে রয়েছে 'গু' যার অর্থ অন্ধকার বা অজ্ঞান এবং 'রু' শব্দের অর্থ অন্ধকারকে দূর করা। অর্থ্যাৎ, 'গুরু' অর্থে বোঝায় এমন এক ব্যক্তি যিনি মনের অন্ধকার বা অজ্ঞানতা দূর করেন। গুরু আমাদের মনের সব সংশয়, সন্দেহ, অন্ধকার দূর করেন এবং নতুন পথের দিশা দেখান।
গুরু পূর্ণিমা হল একটি বৈদিক প্রথা, যার মধ্য দিয়ে শিষ্য তাঁর গুরুকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে থাকেন। আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা তিথিতে পালিত হয় গুরু পূর্ণিমা। হিন্দু ধর্ম বা সনাতন শাস্ত্র অনুসারে, গুরু পূর্ণিমা তিথিতে মহাদেব দক্ষিণামূর্তি ধারণ করেন এবং ব্রহ্মার চার মানসপুত্রকে বেদের গুহ্যজ্ঞান প্রদান করেন। আবার পুরাণ অনুসারে আদিযোগী শিব এই বিশেষ তিথিতে আদিগুরুতে রূপান্তরিত হয়ে তাঁর শিষ্যগণ, সপ্তর্ষির সাত ঋষি – অত্রি, অঙ্গীরা, বশিষ্ঠ, পুলহ, পুলস্ত্য, মরীচি এবং ক্রতু -কে মহাজ্ঞান প্রদান করেন। তাই এই তিথি গুরুপূর্ণিমা নামে পরিচিত।
এই বিশেষ তিথিতে মুনি পরাশর ও মাতা সত্যবতীর ঘরে 'মহাভারত' রচয়িতা মহর্ষি বেদব্যাস জন্মগ্রহণ করেন। তাই এটি 'ব্যাস পূর্ণিমা' বলেও পরিচিত। ব্যাস ঋষির জন্ম বৃত্তান্ত নিয়ে এক গল্প রয়েছে। পৌরাণিক কালে যমুনা নদীতে খেয়া নৌকার মধ্যে পরাশর মুনি সত্যবতীর সাথে মিলিত হন এবং যমুনার একটি দ্বীপে বেদব্যাসের জন্ম হয়। তিনি গুরু পূর্ণিমার বিশেষ দিনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। যমুনার দ্বীপে জন্ম হয়েছিল বলে তাঁর নাম রাখা হয় দ্বৈপায়ন। ব্যাসের গায়ের রং কালো ছিল বলে, পুরো নাম হয় কৃষ্ণ-দ্বৈপায়ন।
শৈশব থেকেই মহর্ষি বেদব্যাসের আধ্যাত্মিকতার প্রতি গভীর আগ্রহ ছিল। ভগবানের ধ্যানে মগ্ন হওয়ার জন্য তিনি বনে গিয়ে তপস্যা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রথমে তাঁর বাবা-মা তাঁকে এর জন্য অনুমতি দেননি। পরে তিনি মা সত্যবতীর অনুমতি নিয়ে তপস্যার জন্য যাত্রা করেন। তাঁর তপস্যার স্থানটি ছিল বদরিকাশ্রম। পরবর্তীতে কৃষ্ণ-দ্বৈপায়ন তপস্যাবলে মহর্ষিত্ব লাভ করেন।
হিন্দু ধর্ম অনুযায়ী, তিনি বেদবিন্যাস করে চার ভাগে ভাগ করেছিলেন। বেদ বিভাজনের কৃতিত্বের জন্য তাঁর নাম হয় বেদব্যাস। ১৮টি পুরাণ ছাড়াও তিনি মহাভারত রচনা করেন।
হিন্দুধর্মে মহর্ষি বেদব্যাসকে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশের রূপ হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। কথিত আছে যে মহর্ষি বেদ ব্যাস আষাঢ় মাসের এই দিনেই তাঁর শিষ্য ও ঋষিদের ভাগবত পুরাণের জ্ঞান দান করেছিলেন। সেই থেকে মহর্ষি বেদ ব্যাসের পাঁচজন শিষ্য এই দিনটিকে গুরু পূর্ণিমা হিসাবে গুরুর পুজো করার প্রথা শুরু করেন।
বৌদ্ধ ধর্মেও গুরুপূর্ণিমার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। তাঁদের মতে, বোধিজ্ঞান লাভের পরে আষাঢ় মাসের পূর্ণিমায় সারনাথে প্রথম শিষ্যদের উপদেশ দেন গৌতম বুদ্ধ।
শাস্ত্রে দেবতাদের থেকেও গুরুর মর্যাদা বেশি। গুরু সম্পর্কে বলা হয়েছে, ভগবান ক্রুদ্ধ হলে গুরুর শরণাপন্ন হওয়া যায়, কিন্তু গুরু রাগ করলে কোথাও আশ্রয় হয় না। তাই জীবনে গুরুর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এটি বিশ্বাস করা হয় যে আপনি যাকে আপনার গুরু হিসাবে বিবেচনা করেন, গুরু পূর্ণিমার দিন তাঁর পুজো করা বা তাঁর আশীর্বাদ গ্রহণ করা উচিত তাহলে জীবনের বাধাগুলি দূর হয়।