কমলকৃষ্ণ দে, বর্ধমান: একদিকে নিষ্ঠার সঙ্গে রীতি-রেওয়াজ পালন, পাশাপাশি সম্প্রীতির পরিবেশ রক্ষা, সেই মধ্যযুগ থেকে রাঢ়বঙ্গের সামাজিক ছবি ছিল এমনই (Kali Puja Special)। একদিকে চিরাচরিত নীতি-নিয়ম, অন্য দিকে আধুনিক চিন্তাভাবনার প্রতিফলন, আজও দুইয়ের সংমিশ্রণ চোখে পড়ে বর্ধমানের সমাজ জীবনে। সোনার কালীবাড়ির পুজোকে ঘিরেও সেই রীতি চোখে পড়ে। (Kali Puja 2023)
রানি নারায়ণী দেবী স্বপ্নাদেশ পাওয়ার পর, ১৮৯৯ সালে বর্ধমানের রাজা মহতাব চাঁদ ভুবনেশ্বরী মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন। এই মন্দির সোনার কালীবাড়ি নামে পরিচিত। মন্দিরে দেবীর সোনার মূর্তি ছিল এক সময়, সেই থেকেই এমন নামকরণ। তবে সাতের দশকে সেই সোনার মূর্তি চুরি হয়ে যায়। পরে অষ্টধাতুর দেবীমূর্তি স্থাপন করা হয়। তবে সোমার কালীবাড়ি নামটি রয়ে গিয়েছে আজও। (Bardhaman Sonar Kalibari)
এই সোনার কালীবাড়িকে ঘিরে প্রচলিত রয়েছে নানা কথা। জানা যায়, মন্দির প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রতি অমাবস্যায় নিয়ম করে ঘটের আম্রপল্লব এবং ডাব পরিবর্তন করা হয়। কিন্তু ঘটের জল কখনও শুকোয় না সেখানে। প্রায় ১২৪ বছর পরও জল ভর্তি রয়েছে ঘটের। শুধু দীপান্বিতা কালীপুজোতেই নয়, প্রতি অমাবস্যাতেই বিশেষ পুজোর আয়োজন হয় মন্দিরে।
আরও পড়ুন: Kali Puja 2023: জড়িয়ে বহু লোককথা! মানিকোড়ায় বলির সময় ঢাকা থাকে দেবীমূর্তির মুখ
এই সোনার কালীবাড়ির প্রতিমাও একেবারে আলাদা। সোনার কালীবাড়ির প্রতিমার বিশেষত্ব হল, এখানে প্রতিমার জিভ বাইরে বেরিয়ে নেই। প্রতিমার পায়ের নীচে নেই মহাদেব, দেবীর গলায় নেই মুণ্ডমালাও। প্রতিমার চার হাত রয়েছে। উপরের দিকের বাম হাত ধারণ করে রয়েছে খড়্গ, উপরের ডান হাতে রয়েছে পদ্ম, নীচের ডান হাত অভয় মুদ্রার।
মন্দিরের ভিতরের তিনটি ঘরের একেবারে মধ্যিখানে, গর্ভগৃহে, রুপোর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত দেবী ভুবনেশ্বরী। ডান দিকে রয়েছেন দক্ষিণা কালী, বাম দিকে মঙ্গলচণ্ডীর মূর্তি। গর্ভগৃহের পূর্ব দিকের ঘরের, ঈশান কোণে পঞ্চমুণ্ডির আসন রয়েছে। ভুবনেশ্বরী মূর্তির নাক বরাবর, নাটমন্দিরের উল্টো দিকের গেট পেরোলে, চোখে পড়ে দু'টি শিবমন্দির। দু'টি শিবলিঙ্গই সাদা পাথরে তৈরি।
দেবীর পায়ের কাছে রাখা থাকে বৃহৎ একটি শঙ্খ। সান্ধ্যকালীন পুজোয় সেটি বাজানো হলে, মুখরিত হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। রানি বেড়াতে গিয়ে ওই শঙ্খ নিয়ে আসেন বলে জানান মন্দিরের পুরোহিত। মন্দিরে প্রবেশ করার আগে নহবৎ খানা পেরিয়ে আসতে হয় পুণ্যার্থীদের। রাজাদের আমলের দু'টি কূপও রয়েছে সেখান, একটি মন্দিরের ভিতরে, অন্যটি বাইরে।
আজও ওই কূপ জলে টলটল করছে। এমনকি ওই জল কখনও শুকোয় না বলেও শোনা যায়। মন্দিরের যাবতীয় পুজো-অর্চনায় ওই কূপের জলই ব্যবহৃত হয়। শ্বেতপাথরে তৈরি এই মন্দিরের দেওয়ালে রয়েছে বাহারি কারুকাজ। নিপুণ হাতে খোদাই করা নকশা নজর কাড়ে সকলের। শুধু তাই নয়, পুজোর ভোগেও বিশেষত্ব রয়েছে এখানে। বৃহস্পতিবার ছাড়া সপ্তাহের অন্য দিনগুলিতে ভোগে থাকে মাছ। কালীপুজোর সময় খিচুড়ির সঙ্গে পাতে পড়ে মাছের টকও। আগে পশুবলির চল থাকলেও, বর্তমানে চালকুমড়ো বলি দেওয়া হয় এই কালীপুজোয়।