হুগলি: মন্দিরের গঠন একেবারে সাদামাটা। । মূল মন্দিরের গর্ভগৃহে রয়েছে একটি শ্বেত পাথরের বেদি। নিত্যদিনের পুজো অর্চনা চলে সেখানেই। আড়ম্বরহীন এই মন্দিরে পূর্ণ হয় লক্ষ লক্ষ ভক্তদের মনস্কামনা। স্থানীয় বিশ্বাস, মা কখনই তাঁর সন্তানদের ফেরান না। ভক্তরা মানত করলে তা পূরণ করেন মা শকুন্তলা। 


মা এখানে দেবী দক্ষিণা কালিকার নাগরিক রূপ। বিশ্বাস করা হয়, লোকালয়ের রক্ষাকর্ত্রী তিনি। তাই সেই হিসাবে দেবী দক্ষিণা কালীকেই রক্ষাকালী হিসাবে পুজো করা হয় এখানে। কোন্নগরকে রক্ষা করেন তিনি, তাই রাস্তার তিনমাথার মোড়ে মাকে পুজো করার রেওয়াজ রয়েছে বলে জানা যায়। 


তবে এর ইতিহাস বলে, ১৮৩৬ সালের সময় কোন্নগর-নবগ্রাম ছিল ঘন বনজঙ্গলে ঢাকা এলাকা। জঙ্গলের মধ্যে এলাকা ভাগ-ভাগ করে ছিল বিভিন্ন ডাকাত আর ঠগীদের ডেরা। এই এলাকায় ডাকাতদেরও আনাগোনা ছিল। প্রাপ্ত সূত্র থেকে জানা যায়, বৈশাখ মাসের কৃষ্ণা তৃতীয়া বা তার ঠিক পরের শনিবারের রাতে এই ডাকাতে কালীকে পুজো দিয়ে সারা বছরের মতো ডাকাতির ব্যবসা শুরু করত ডাকাত ও ঠগীর দল। মস্ত অশ্বত্থ গাছের নীচেই ছিল মায়ের থান। সেই সময় এই থানেই পড়ে থাকত রক্তমাখা হাঁড়িকাঠ। গাছের ওপরে বাস করে দলে দলে শকুন, তাই এই থানের আরেক নাম শকুন্তলা মায়ের থান, সেই থেকে মায়ের নামও শকুন্তলা রক্ষাকালী মা।


শকুন্তলা কালী মন্দিরের পুজোর রীতি ও নিয়ম কিন্তু বেশ প্রাচীন। কথিত আছে দেবী সূর্যের মুখ দেখেন না। তাই নিয়ম মতো মূর্তি বানানো হয় সূর্যাস্তের পর, দ্বিতীয় প্রহর শেষ হলে পুজো শুরু আর সূর্যোদয়ের আগেই দেবীর বিসর্জন দেওয়া হয়। নিয়মমত মূর্তি বানানো হয় সূর্যাস্তের পর, দ্বিতীয় প্রহর শেষ হলে পুজো শুরু আর সূর্যোদয়ের আগেই মায়ের বিসর্জন দেওয়া হয়। এখানকার মানুষের বিশ্বাস মায়ের কাছে যে যা চান তাই পান। অমাবস্যা তিথির সন্ধ্যের পর দেবী মূর্তি কাঁধে করে নিয়ে আসা হয় মন্দিরে। সন্ধ্যে সাড়ে ছটা থেকে সাড়ে সাতটার মধ্যে মন্দিরে প্রবেশ করে প্রতিমা। এরপর মূল্যবান সোনা ও রুপোর গয়নায় সাজানো হয় মা রক্ষাকালীকে। শুরু হয় পুজো , চলে সারা রাত।


এই মন্দিরে সারা বছর শুধু বেদিতেই পুজো হয়। সর্বশক্তিমান মহামায়াকে একই সঙ্গে সাকার ও নিরাকারে পুজো করার এই রীতি বাংলার আর কোথাও দেখা যায় কি না জানা নেই।  ভক্তের উপলব্ধি মা যেন কৃপা করার জন্য সদাই রয়েছেন, তাই তো তাঁর মুখ থেকে উচ্চারিত হয় অভয় মন্ত্র ---
   " ওঁ করালবদনাং ঘোরাং মুক্তকেশীং চতুর্ভুজাম্।/
    কালিকাং দক্ষিণাং দিব্যাং মুন্ডমালাবিভূষিতাম্।।/


....সুখপ্রসন্নবদনাং স্মেরানন সরোরুহাম্।


/এবং সঞ্চিন্তেয়ৎ কালীং সর্বকাম- সমৃদ্ধিদাম্" ।।


এই পুজোর আগের দিন থেকেই অগণিত মানুষের ভিড় করেন বেদিতে জল ঢালার জন্য। গঙ্গায় ডুব দিয়ে জল নিয়ে এসে বেদীতে জল ঢালা চলে সারা রাত জুড়ে। দণ্ডি কেটে চলে মানতপর্ব। এই মন্দির পশুবলির রীতিও রয়েছে প্রথম থেকেই। এক সময়ে কয়েক হাজার হাজার ছাগ বলি হত। বর্তমান সময়ে অবশ্য সে সংখ্যা কমেছে অনেকটাই। বলি শেষে শুরু হয় যজ্ঞ আহুতি। এরপর সূর্য ওঠার আগেই মা কে বিসর্জন দেওয়া হয় গঙ্গায়। 


তথ্য অনুযায়ী, কোন্নগরের শকুন্তলা কালী পুজো সাড়ম্বরে শুরু হয় ১২৯৭ বঙ্গাব্দে। যেখানে মায়ের মন্দির, সেইখানেই ১২৯৭ বঙ্গাব্দে বৈশাখ মাসের কৃষ্ণপক্ষে শনিবার দিন প্রথম পুজো অনুষ্ঠিত হয়েছিল। পরবর্তীতে এই পুজো বারোয়ারিভাবেই হয়ে আসছে। 


জানা যায় ডাকাতরা আগে পুজো করত তো বটেই। তবে দেবেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী পৌরহিত্যের কাজ সেরে ফেরার সময় এলোকেশী শ্যামলা এক অপরূপা নারী মূর্তিকে ওই স্থানে দেখেন ও মিলিয়ে যেতেও দেখেন। এরপর স্বপ্নে দেখা রূপের আদলে মাটির মূর্তি গড়ে পুজো শুরু হয়। অনেক ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হওয়ায় মায়ের মাহাত্ম্য চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
 


 


তথ্যসূত্র- 
১। হুগলী জেলার ইতিহাস, সুধীরকুমার মিত্র বিদ্যাবিনোদ
২। কোন্নগর পরিচিতি, কোন্নগর রবীন্দ্র পরিষদ, হুগলি 


 
আপনার পছন্দের খবর আর আপডেট এখন পাবেন আপনার পছন্দের চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম হোয়াটস অ্যাপেও। যুক্ত হোন ABP Ananda হোয়াটস অ্যাপ চ্যানেলে