কলকাতা: শ্রী শ্রী চণ্ডিতে (Shri Shri Chandi) বলা হয়েছে, মহালয়া হচ্ছে পুজো বা উৎসবের আলয়। এখানে আলয় শব্দটির একটি অর্থ হচ্ছে আশ্রয়। পিতৃপক্ষের শেষ এই দিন মহালয়া (Mahalaya) দুর্গাপূজার (Durga Puja) সঙ্গে যুক্ত কোনো মহোৎসব নয়, বরং এটা পিতৃপুরুষের মহোৎসব— কোনো সময় তর্পণ না করলেও মহালয়ার তর্পণে সর্বসিদ্ধি, মনে করা হয় এমনটাই।
দুর্গাপূজার সঙ্গে তার বাস্তব সম্পর্ক এইটুকুই যে, এই দিনেই দুর্গার মূর্তি-কারিগরেরা অনেকেই দুর্গামূর্তির চক্ষুদান করেন। হয়তো বা এইজন্যেই যে মা জননী চোখ খুলেই দেখবেন— তাঁর সন্তানেরা পিতা-মাতা পিতৃপুরুষকে ভোলেনি, মহালয়ার তর্পণ সেরেই তারা বিশ্বাত্মিকা জগজ্জননীর পূজা-আরাধনায় মন দেবে— পাঁচ দিনের সাড়ম্বর মাতৃতন্ত্র যেন পনেরো দিনের পিতৃতান্ত্রিকতাকে আগলে নিয়ে চলতে পারে।
অনেকে বলেন, দেবলোকের তলায় তলায় একটা পিতৃলোকের ব্যবস্থা করেছেন শাস্ত্রকারেরা। এই পিতৃলোকেই প্রয়াত মাতা-মাতামহীরাও থাকেন। মহালয়া সেই অর্থে এমনই একটা নির্দিষ্ট দিন, যেদিনে সমস্ত প্রয়াত জনের স্মরণ-তর্পণ করা যায়। মহালয়া সম্বন্ধে আরও একটা শাস্ত্রপ্রসিদ্ধ কথা হল— এটা সেই রকম একটা দিন যখন সমস্ত পিতৃ-মাতৃ পুরুষেরা নিজেদের আবাস পিতৃলোক ছেড়ে নেমে আসেন অধস্তন পুরুষের কাছাকাছি। পিতৃপুরুষ-মাতৃপুরুষদের এই সমাবেশটুকু যে মহান আবাস বা আলয় তৈরী করে দেয়। সেটাই মহালয়া অর্থাৎ মহালয়া তিথি। আর মহালয়া তিথির সবচেয়ে বড়ো বিশেষত্ব হল তর্পণ। এটা পিতৃপক্ষের শেষ দিন এবং এই তিথির আসল স্বরূপ হল অমাবস্যা।
অমাবস্যা পিতৃকার্যের জন্য সবচেয়ে প্রশস্ত তিথি। এমনিতে যেদিন শ্রাদ্ধশান্তির দিন পড়ে, তখন যদি প্রবাসী ছেলে বাড়িতে কোনো মতে উপস্থিত না হতে পেরে থাকে, কিংবা অন্য কোনো অ-নিবার্য কারণে সে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান না করতে পেরে থাকে, তাহলে তিথি পরবর্তী অমাবস্যায় অথবা যে কোনো অমাবস্যায় পিতৃ-মাতৃকার্যের সাধারণ নিয়ম আছে।
সেখানে পিতৃপক্ষের শেষ দিনে এই মহালয়া-চিহ্নিত অমাবস্যা, এই তিথিতে শ্রাদ্ধ তর্পণের ফল অধস্তন পুরুষেরা যেন প্রত্যক্ষ শান্তির মহিমায় অনুভব করেন। বহু মানুষ যদি একত্রে একই বিরহানুষ্ঠান করে, তাহলে শ্রাদ্ধ-তর্পণের শাস্তিটুকু সর্বজনীন বিশ্বাসে পরিণত হয়। আর তর্পণ এমনই এক অনুষ্ঠান, যেখানে সামান্য পরিশ্রম সাধিত কর্মও মহালয়ার মন্ত্রগুণে অসামান্য হয়ে ওঠে; পিতৃমাতৃপুরুষের শান্তি এবং অধস্তনের শান্তি যেন একই সম্পর্ক সেতুতে বাঁধা পড়ে।
অন্য তিথিগুলির সঙ্গে মহালয়া তিথির একটা তফাত আছে। পিতা-মাতা কিংবা যাঁরাই প্রয়াত হয়েছেন, তাঁদের শ্রাদ্ধ, সপিণ্ডকরণের পরের বৎসর থেকে নির্দিষ্ট প্রয়াণ-তিথিতে তর্পণ করাটা শাস্ত্রমতে বিষেয় ছিল। যে বাড়িতে প্রয়াত জনের সংখ্যা বেশী ছিল সেখানে অধস্তন বংশধরের পক্ষে অনেকগুলি তিথিতে স্নান-তর্পণ করাটা অনেক সময়েই বেশ কঠিন হয়ে পড়ত। এইসব সমস্যায় মহালয়া তিপিটা ছিল শাস্ত্রীয় কৃপা-করুণার নিঃশর্ত ছাড়পত্র। মহালয়া তিথিতে সমস্তরকম শ্রাদ্ধ তর্পণ করা যায়। যে মানুষ কোনো নির্দিষ্ট তিথিতে তর্পণ করার সময় সুযোগ পায় না, সে মহালয়ার তিপিতে তর্পণ করে দোষমুক্ত হতে পারে। এটাই মহালয়ার বিশেষত্ব।
তর্পণ মানে তৃপ্ত করা। এই তৃপ্তির উপাদান সামান্য তিল আর জল। মহালয়ার দিন পিতৃ-মাতৃপুরুষের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপক তর্পণটুকু যেন ব্যক্তিকেন্দ্র থেকে বিশ্বজনীন হয়ে পড়ে।
তথ্য সূত্র-
দুর্গায়ৈ সপরিবারায়ৈ,
পুরাণকোষ, ২ খণ্ড
শ্রী শ্রী চণ্ডি