সঞ্চয়ন মিত্র, কলকাতা : রাত পোহালেই রথ। যুগ যুগ ধরে লক্ষ লক্ষ ভারতবাসীর আকর্ষণ পুরীর রথযাত্রা। কিন্তু কবে শুরু এই রথযাত্রার ? শুরুর গল্পটাই বা কেমন ? পুরীর মন্দির ও রথ-উৎসব ঘিরে রয়েছে নানা ইতিহাস ও কিংবদন্তী। সে-সব মানুষের মুখে মুখে ফেরে। 


কীভাবে শুরু এই রথযাত্রা উৎসবের ?


ওড়িশায় লোকমুখে ফেরে এমনই একটা গল্প। একবার আদরের বোন সুভদ্রা  তাঁর দাদার কাছে বাইরে ঘুরতে যাবার বয়না ধরেন। তখন দাদা জগন্নাথ তাঁকে রথে চড়ে ঘোরাতে নিয়ে যাঁন। তাঁদের সঙ্গী হন আরেক ভাই বলরাম বা বলভদ্র। সেই থেকেই রথযাত্রার সূচনা। যুগে যুগে মানুষ জগন্নাথ, সুভদ্রা এবং বলরামের এই ত্রিমূর্তির নানা ব্যখ্যা করেছেন। অন্যতম জনপ্রিয় ব্যখ্যা হল জগন্নাথদেব হলেন ব্রহ্ম স্বরূপ। আর বলরাম হলেন জাগতিক ভক্তকুল। এই দুয়ের সংযোগ হলেন সুভদ্রারূপী মহামায়া। আসলে এ হল ভক্ত ও ভগবানের মিলন উৎসব। ভক্তকে দর্শন দিয়ে কৃপা করতে ভগবান স্বয়ং পথে নেমে আসেন।


রথ - পরিচয়


রথযাত্রায় জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলরামের তিনটি রথের আলাদা নাম রয়েছে। জগন্নাথের রথ হল নন্দীঘোষ। এটি উচ্চতায় সবচেয়ে বড়। বিষ্ণু অবতারের কথা মাথায় রেখেই জগন্নাথের রথের রং করা হয় লাল-হলুদ। নন্দীঘোষ রথে ১৬টি চাকা থাকে। জগন্নাথের রথের সামনে থাকে চারটি সাদা রঙের ঘোড়া। জগন্নাথের রথের চারটি ঘোড়ার নাম শঙ্খ, বলহাকা, শ্বেতা ও হরিদশ্ব।


বলরামের রথটির নাম তালধ্বজ।  বলরামের রথের রং লাল-সবুজ। এই রথে চাকার সংখ্যা ১৪। বলরামের রথের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় কালো রঙের ঘোড়া। বলরামের চারটি ঘোড়ার নাম তীব্র, ঘোড়া, দীর্ঘশর্মা ও স্বরনাভ।


সুভদ্রার রথের নাম দর্পদলন। এটি উচ্চতায় সবচেয়ে কম। সুভদ্রার রথের রং লাল ও কালো। দর্পদলন রথের চাকার সংখ্যা ১২।সুভদ্রার রথে ঘোড়ার রঙ লাল। সুভদ্রার চারটি ঘোড়ার নাম রুচিকা, মোচিকা, জিতা ও অপরাজিত।


রথযাত্রায় জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা রথে একা থাকেন না। তাঁদের সঙ্গে সহযাত্রী হিসেবে একজন করে অন্য দেব-দেবীও থাকেন। যেমন, জগন্নাথের সঙ্গে থাকেন মদনমোহন, বলরামের সঙ্গে থাকেন রামচন্দ্র, সুভদ্রার সঙ্গে থাকেন সুদর্শন।


জগন্নাথদেবের ৫৬ ভোগ


জগন্নাথদেব বিষ্ণুর আরেক রূপ। বিষ্ণু পালন কর্তা। তাই তাঁর ভোগও রাজসিক। রথে জগন্নাথদেবের ভোগে ছাপ্পান্ন ধরনের পদ দেওয়া হয়। সেগুলো হল-
(১) উকখুড়া অর্থাৎ মুড়ি, (২) নাড়িয়া কোড়া অর্থাৎ নারকেল নাড়ু, (৩) খুয়া অর্থাৎ খোয়া ক্ষীর, (৪) দই, (৫) পাচিলা কাঁদালি অর্থাৎ টুকরো কলা, (৬) কণিকা অর্থাৎ সুগন্ধী ভাত, (৭) টাটা খিঁচুড়ি অর্থাৎ শুকনো খিঁচুড়ি, (৮) মেন্ধা মুন্ডিয়া অর্থাৎ বিশেষ ধরণের কেক, (৯) বড়া কান্তি অর্থাৎ বড় কেক, (১০) মাথা পুলি অর্থাৎ পুলি পিঠে, (১১) হামসা কেলি অর্থাৎ মিষ্টি কেক, (১২) ঝিলি, (১৩) এন্ডুরি অর্থাৎ নারকেল দিয়ে তৈরি কেক, (১৪) আদাপচেদি অর্থাৎ আদা দিয়ে তৈরি চাটনি, (১৫) শাক ভাজা, (১৬) মরীচ লাড্ডু অর্থাৎ লঙ্কার লাড্ডু, (১৭) করলা ভাজা, (১৮) ছোট্ট পিঠে, (১৯) বারা অর্থাৎ দুধ দিয়ে তৈরি মিষ্টি, (২০) আরিশা অর্থাৎ ভাত দিয়ে তৈরি মিষ্টি, (২১) বুন্দিয়া অর্থাৎ বোঁদে, (২২) পাখাল অর্থাৎ পান্তা ভাত, (২৩) খিড়ি অর্থাৎ দুধভাত, (২৪) কাদামবা অর্থাৎ বিশেষ মিষ্টি, (২৫) পাত মনোহার মিষ্টি, (২৬) তাকুয়া মিষ্টি, (২৭) ভাগ পিঠে, (২৮) গোটাই অর্থাৎ নিমকি, (২৯) দলমা অর্থাৎ ভাত ও সবজি, (৩০) কাকারা মিষ্টি, (৩১) লুনি খুরুমা অর্থাৎ নোনতা বিস্কুট, (৩২) আমালু অর্থাৎ মিষ্টি লুচি, (৩৩) বিড়ি পিঠে, (৩৪) চাড়াই নাডা মিষ্টি, (৩৫) খাস্তা পুরি, (৩৬) কাদালি বারা, (৩৭) মাধু রুচি অর্থাৎ মিষ্টি চাটনি, (৩৮) সানা আরিশা, (৩৯) পদ্ম পিঠে, (৪০) পিঠে, (৪১) কানজি অর্থাৎ চাল দিয়ে বিশেষ মিষ্টি, (৪২) দাহি পাখাল অর্থাৎ দই ভাত, (৪৩) বড় আরিশা, (৪৪) ত্রিপুরি, (৪৫) সাকারা অর্থাৎ সুগার ক্যান্ডি, (৪৬) সুজি ক্ষীর, (৪৭) মুগা সিজা, (৪৮) মনোহরা মিষ্টি, (৪৯) মাগাজা লাড্ডু, (৫০) পানা, (৫১) অন্ন, (৫২) ঘি ভাত, (৫৩) ডাল, (৫৪) বিসার অর্থাৎ সবজি, (৫৫) মাহুর অর্থাৎ লাবরা, (৫৬) সাগা নাড়িয়া অর্থাৎ নারকেলের দুধ দিয়ে মাখা ভাত।