নয়াদিল্লি: অতিমারির প্রকোপ কাটিয়ে সুস্থ হয়ে উঠেছেন মানুষ। কিন্তু মানুষের নিরাপদ আশ্রয় পৃথিবীই এখন শয্যাশায়ী হওয়ার পথে। নিরাপত্তার সব সীমারেখা পার করে ‘গুরুতর অসুস্থ’ হয়ে পড়েছে পৃথিবী (Science News)। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নিরাপত্তা এবং বিপদের মধ্যে যে  আটটি পর্যায় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে সাতটি পর্যায়ই ইতিমধ্যে পেরিয়ে গিয়েছে। এই মুহূর্তে ‘বিপজ্জনক’ জায়গায় দাঁড়িয়ে পৃথিবী (Earth Science)।


পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্র এবং তার সীমারেখার উপর নজরদারি চালানোর দায়িত্বে আন্তর্জাতিক স্তরের ৪০ জনের বেশি বিজ্ঞানীদের নিয়ে তৈরি ‘আর্থ কমিশন’।  সম্প্রতি তাঁরা একটি রিপোর্ট জমা দিয়েছেন, যা প্রকাশিত হয়েছে ‘নেচার জার্নাল’-এ। তাতেই পৃথিবীকে ‘গুরুতর অসুস্থ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।  এতকাল ধরে মানুষ তথা জীবজগতের আশ্রয়স্থল যে পৃথিবী, তারও ন্যায়বিচার প্রাপ্য বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।


এই প্রথম পৃথিবীকে সুস্থ করে তোলার ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার শব্দটি ব্যবহার করলেন বিজ্ঞানীরা। পৃথিবীকে সুস্থ করে তুলতে হলে, বিভিন্ন দেশের মধ্যে পারস্পরিক হানাহানি, নির্দিষ্ট কিছু জাতির ক্ষতিসাধন এবং লিঙ্গবৈষম্যের মতো সামাজিক ব্য়াধি থেকে বেরিয়ে আসার নিদান দিয়েছেন তাঁরা। কারণ বিজ্ঞানীদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তন, উষ্ণায়নের জেরে শুধুমাত্র পৃথিবী তার নিজস্বতা হারাচ্ছে না, পৃথিবীতে বসবাসকারী মানুষের জীবনেও বিপদ ঘনিয়ে আসছে।


পৃথিবীকে সুস্থ রাখতে, বিপদের মুখে ঠেলে না দিতে আটটি সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল, যথা- জলবায়ু, বায়ুদূষণ, কৃষিকার্যে অত্যধিক হারে ব্যবহৃত সার থেকে নির্গত ফসফরাস এবং নাইট্রোজেন দ্বারা জলদূষণ, ভূগর্ভস্থ জলের সরবরাহ, বিশুদ্ধ জলের জোগান, কৃত্রিমতার ছোঁয়া মুক্ত প্রকৃতি, প্রাকৃতিক ভাবে গড়ে ওঠা পরিবেশ এবং মনুষ্যগঠিত পরিবেশ।


আরও পড়ুন: Quasi Moon: শুরু থেকেই ন্যাওটা, একসঙ্গেই ঘোরাফেরা, পৃথিবীর আরও একটি আধা উপগ্রহের হদিশ মিলল


এর মধ্যে শুধুমাত্র বায়ুদূষণের ক্ষেত্রেই এখনও বৈশ্বিক ভাবে সীমা লঙ্ঘিত হয়নি বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এখনও পর্যন্ত কিছু জায়গা এবং অঞ্চলেই বায়ুদূষণ বিপদসীমা পার করে গিয়েছে। মানুষের জীবনধারণের নিরিখে জলবায়ুও বিপদসীমা পার করে গিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে পূর্ব ইউরোপ, দক্ষিণ এশিয়া, মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকার কিছু অংশ, ব্রাজিলের বিস্তীর্ণ অঞ্চল, মেক্সিকো, চিন এবং পশ্চিম আমেরিকায়। সেখানে বেশ কিছু ‘হটস্পট’ও চিহ্নিত করেছেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু সার্বিক ভাবে পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রকে ধরলে, এখনও ফিরে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।


বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, পৃথিবীর দুই তৃতীয় অংশেই জলের যে জোগান রয়েছে, তা বিশুদ্ধতার মাপকাঠিতে ব্যর্থ। ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনের জলবায়ু এবং জনস্বাস্থ্য বিষয়ের অধ্যাপক তথা গবেষক দলের অন্যতম সদস্য ক্রিস্টি এবি-র বক্তব্য, “পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রের যে নিরাপদ সীমারেখা রয়েছে, তার অধিকাংশই লঙ্ঘন করে ফেলেছি আমরা।” ইউনিভার্সিটি অফ আমস্টারড্যামের পরিবেশ বিষয়ের অধ্যাপক তথা ‘আর্থ কমিশনে’র কো-চেয়ারপার্সন জয়িতা গুপ্তের মতে, “চিকিৎসক দেখাতে পারলে, তিনি বলতেন, আমাদের পৃথিবী গুরুতর অসুস্থ। পৃথিবী নিজে শুধু অসুস্থই নয়, এই অসুস্থতা কাবু করে ফেলছে পৃথিবীবাসীকেও।”


তবে বিজ্ঞানীদের মতে, ‘গুরুতর অসুস্থ’ হলেও, মৃত্যুশয্যায় এখনও ওঠেনি পৃথিবী। ছোট ছোট পরিবর্তন ঘটিয়ে সুস্থ করে তোলা যেতে পারে। তার জন্য কয়লা, তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহারে রাশ টানতে হবে। জল, বাতাসের প্রতি হতে হবে আরও যত্নশীল।  কিন্তু বর্তমানে গোটা বিশ্বই ভুল পথে এগোচ্ছে বলে মত বিজ্ঞানীদের। গবেষণার রিপোর্টে বলা হয়, “এই মুহূর্তে বিরাট ঝুঁকি নিচ্ছি আমরা। ভবিষ্যত প্রজন্ম তো বটেই, পৃথিবীতে বসবাসকারী জীবজগৎকে ভয়ঙ্কর বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছি। এমন চললে আর রোগ নিরাময়ের উপায় থাকবে না।”


বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, শুধুমাত্র গ্রহস্বাস্থ্য়ের অবস্থার মূল্যায়ন নয়, পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রের স্থিতিশীল অবস্থার, মানবসভ্যতার কল্যাণ এবং মঙ্গল কামনা করছেন তাঁরা। পৃথিবী এইটুকু ন্যায়বিচারের অধিকারী বলে মত তাঁদের।