মুম্বই: একবার এক সাক্ষাৎকারে মদন লাল বলছিলেন যে,''আমরা ইন্টারভিউতে যা কিছুই বলি না কেন, সব কিছুই কম পড়বে ওই ইনিংসটার সামনে। উফফ! কি মারটাই না সেদিন মেরেছিল কপিল। ওইরকম আর কেউ খেলতে পারত কি না আমার জানা নেই। প্রতিটা শট যেন চোখের সামনে ভেসে আসছে। কিন্তু ওই ইনিংসটা যারা দেখেনি, তাঁদের জন্য আফসোস হয়।''
সত্যিই তো, আফসোসই বটে। নইলে ওই নির্দিষ্ট দিনেই বিবিসির স্ট্রাইক হয়! ভারতীয় ক্রিকেটের তথা বিশ্ব ক্রিকেটের কালজয়ী ইনিংসগুলোর একটা। তার এতটাই মাহাত্ম্য যে, তা এবার পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে চলেছেন পরিচালক কবীর বেদি। অথচ ৩৮ বছর পরেও সেই ইনিংসের কোনও ক্লিপিংস নেই। কিন্তু যখনই সেই ম্যাচের প্রসঙ্গ ওঠে, নস্টালজিক হয়ে যান কপিল। বিশ্বকাপজয়ী ভারত অধিনায়কের কথায়, 'সেদিন টস জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। এরপর ড্রেসিংরুমে ফিরে ওয়াশরুমে চলে যাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজায় ধাক্কা। সতীর্থরা চিৎকার করে বলতে থাকেন, একের পর এক উইকেট পড়ছে, তোমাকে নামতে হবে ক্যাপ্টেন। আমি কোনওমতে বাথরুম থেকে বেরােতেই দেখি দলের ৪ উইকেট পড়ে গিয়েছে। প্যাড পায়ে গলিয়ে দ্রুত মাঠে নেমে পড়ি।'
১৯৮৩ সালে টানব্রিজে হওয়া সেই ম্যাচে তারকাখচিত ভারতীয় ব্যাটিং লাইন আপকে একপ্রকার গলি ক্রিকেটের পর্যায় নামিয়ে এনেছিলেন কেভিন কারান ও পিটার রসেন। বডি লাইন থেকে স্যুইং। নাস্তানাবুদ সুনীল গাওস্কর, মহিন্দর অমরনাথ, শ্রীকান্ত, সন্দীপ পাটিলরা। জিম্বাবোয়ের মতো খাতায়-কলমে দুর্বল দল। রান রেটে এগিয়ে থেকে সেমিতে যাওয়াই ছিল লক্ষ্য। কিন্তু একি! খেলার ২০ মিনিটের মধ্যে মাঠ পুরো ফাঁকা প্রায়। ৫-৭ জন গুটিকয়েক ভারতীয় সাংবাদিক সেই ম্যাচে উপস্থিত ছিলেন প্রেসবক্সে। তাঁরাও ম্যাচ রিপোর্ট লেখা শুরু করে দিয়েছেন ভারতের হার ধরে। তবে অন্যরকম ভেবেছিলেন কপিল নিজে। প্রথমে রজার বিনি, যশপাল শর্মা ও পরে সৈয়দ কিরমানিকে সঙ্গে নিয়ে ১৩৮ বলে অপরাজিত ১৭৫ রানের মহাকাব্যিক ইনিংস। যা ওয়ান ডে ক্রিকেটে ভারতের প্রথম শতরানও। ১৬টি বাউন্ডারি ও ৬টি পেল্লাই ছক্কা আছড়ে পড়েছিল মাঠের চারধারে। একবার নাকি বলও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
কিন্তু কোন জাদুমন্ত্রে এমনটা সম্ভব হল? কপিল পরবর্তীতে বলছিলেন, 'আমি ছোট ছোট লক্ষ্য নিয়ে এগােচ্ছিলাম। নন স্ট্রাইকার এন্ডে যে আসছিল তাঁকে বলছিলাম যে ক্রিজে টিকে থাকতে। শেষ ৭-৮ ওভার যখন তখন কিরমানিকে বললাম যে এবার আমি চালিয়ে খেলব। ব্যস এই পরিকল্পনাটাই কাজে লেগে গিয়েছিল। ওই ম্যাচটা আমাদের বিশ্বাস করতে শিখিয়েছিল পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে যে কোনও পরিস্থিতিতে আমরা জিততে পারি।'
সেদিন প্রথমে ব্যাটিং করতে নেমে খাতা খোলার আগেই ফিরে যান গাওস্কর। এরপর কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত, মহিন্দর অমরনাথ, সন্দীপ পাটিল ও যশপাল শর্মা ফিরে যান যথাক্রমে ০,৫, ১, ৯ রানে। ১৭ রানে ৫ উইকেট থেকে নির্ধারিত ৬০ ওভারে দলের স্কোর হয় ২৬৬/৮। লোয়ার অর্ডারে কপিলকে যোগ্য সঙ্গ দেন রজার বিনি (২২), মদন লাল (১৭) ও সৈয়দ কিরমানি (২৪)। জবাবে ব্যাট করতে নেমে ২৩৫ রানেই অল আউট হয়ে যায় ডানকান ফ্লেচারের দল। ব্যাটে সেঞ্চুরির পর বল হাতেও ১ উইকেট তুলে নেন কপিল। স্বাভাবিকভাবেই ম্যাচের সেরাও নির্বাচিত হয়েছিলেন। ৩১ রানে ম্যাচ জিতে নেয় ভারত।
কপিলের ঐতিহাসিক ১৭৫ রানের ইনিংসটির মধ্যে দিয়েই ভারতীয় ক্রিকেটের নবজাগরণ হয়েছিল। চোখে চোখ রেখে যে ২২ গজে যে কোনও দলের বিরুদ্ধে, যে কোনও আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে টিম ইন্ডিয়া, তা সামনে থেকে সবার সামনে উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন কিংবদন্তি এই অলরাউন্ডার। একইসঙ্গে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিলেন পরবর্তী প্রজন্মকেও। সেদিন খেলা দেখতে আসা এক জৈনিক ইংল্যান্ড সমর্থকের কাছে নাকি ম্যাচের কিছু ছবি ছিল। আর তা পাওয়ার জন্য ম্যাচের পর সেই সমর্থকের পিছুও নিয়েছিলেন কপিল। যদিও পরে সেই খবর নিজেই ভুয়ো বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন 'হরিয়ানার হ্যারিকেন'।
আরও পড়ুনঃ দাদার চ্যালেঞ্জ সামলে ২৪১, সচিনের ইনিংসে মুগ্ধ হয়েছিলেন চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী লারাও