মুম্বই: কেরিয়ারে এরকম সঙ্কটে তিনি বড় একটা পড়েননি।


বিশ্বের সর্বকালের সেরা মনে হয় তাঁকে। অথচ পরপর পাঁচ ইনিংসে তাঁর রান কি না ০, ১, ৩৭, ০ ও ৪৪! সাকুল্যে ৮২! তাও আবার অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে। যে দেশে ব্যাটারের অগ্নিপরীক্ষা হয়। অজি-ভূমে রান করলে তবেই তো ক্রিকেটবিশ্বে কুলীনের তকমা পাওয়া যায়। সেই দেশেই এরকম অভূতপূর্ব বিপর্যয়। বিশেষজ্ঞরা তাঁর সমালোচনায় মুখর। সংবাদমাধ্যমে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলল বলে।


সচিন রমেশ তেন্ডুলকর (Sachin Tendulkar) তাঁর তখনও পর্যন্ত ১৫ বছরের কেরিয়ারে এরকম বিপন্ন অবস্থায় খুব কমই পড়েছেন। তখনও পর্যন্ত কারণ, ঘটনাটি ২০০৪ সালের গোড়ার দিকের। অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়েছে ভারতীয় দল। টেস্ট সিরিজ তখন ১-১ অবস্থায় আর সিডনিতে চতুর্থ ম্যাচ খেলতে নামছে ভারতীয় দল।


ভেতর ভেতর অদ্ভুত এক দ্বন্দ্ব যেন কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে মাস্টার ব্লাস্টারকে। কোথায় ভুল হচ্ছে, সংশোধনের রাস্তাি বা কী, ভেবে অস্থির হচ্ছেন সচিন। তার মধ্যেই আবার নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে হাজির হলেন অজিত তেন্ডুলকর। সচিনের দাদা। সচিনকে ক্রিকেটার করার স্বপ্নে বুঁদ হয়ে যিনি নিজের কেরিয়ার বিসর্জন দিয়েছেন। ছোট ভাইকে প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল অজিতের ধ্যান-জ্ঞান। সচিন নিজেও সবসময় স্বীকার করে নিয়েছেন যে, তাঁর ব্যাটিংয়ের সবচেয়ে বড় সমালোচক ছিলেন দাদা অজিতই। নাহলে কি আর কেরিয়ারের শেষ টেস্ট ইনিংসে আউট হওয়ার পরেও কোথায় ভুল হয়েছিল তা নিয়ে বিশ্লেষণ করতে বসতে হয়!


সিডনি টেস্টের আগে চ্যালেঞ্জের সুরে ভাইকে অজিত বলেন, খারাপ ফর্ম চলছে। কিন্তু তোমার টেকনিকে কোনও ভুল হচ্ছে না। সমস্যাটা হয়তো মানসিকতায়। এক কাজ করো। ক্রিজে পড়ে থাকো। আউট না হয়ে দেখাও তো দেখি।


দাদার চ্যালেঞ্জ যেন সচিনকেও তাতিয়ে দিল। একসময় শিবাজি পার্কে কোচ রমাকান্ত আচরেকর স্টাম্পের ওপর কয়েন রেখে সচিনকে ব্যাট করতে পাঠাতেন। বোলাররা প্রাণান্তকর চেষ্টা করেও সচিনকে আউট করতে পারত না। সেই ব্যাটার কী করে দাদার চ্যালেঞ্জে না বলেন। অতএব, যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত মাস্টার ব্লাস্টার। দাদাকে আত্মবিশ্বাসী সুরে বললেন, ঠিক আছে, এই টেস্টে আমাকে কেউ আউট করতে পারবে না।


কিন্তু বলা এক। আর তা কাজে করে দেখানো আর এক। তার ওপর প্রতিপক্ষ বোলিং আক্রমণে যদি থাকে ব্রেট লি-জেসন গিলেসপির মতো ক্রিকেট বিশ্বের বোলিংয়ের সব রথী-মহারথীরা, তাহলে তো লক্ষ্যপূরণ আরও কঠিন।


ভাবতে বসলেন সচিন। আত্মসমীক্ষা করে ছন্দ ফিরে পাওয়ার রাস্তাও খুঁজে বার করলেন। নিজেই। ঠিক করলেন, সিডনি টেস্টে তিনি কভার ড্রাইভ খেলবেন না। কিন্তু এ কী সিদ্ধান্ত! এ যেন অর্জুনকে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়ে বলা যে, হে বীর, তুমি গাণ্ডীব (অর্জুনের ধনুক) স্পর্শ করতে পারবে না, কিন্তু যুদ্ধজয় করে ফিরতে হবে। সচিনকে সারা বিশ্ব কুর্নিশ করে ড্রাইভের জন্য, তাঁর কভার ড্রাইভ তামাম ক্রিকেট দুনিয়া তাজ্জব হয়ে দেখে, সেই তিনি কি না নিজের আস্তিনের সেরা তাস মাঠের বাইরে রেখে বাইশ গজের দ্বৈরথে নামবেন!


কিন্তু সচিন মনঃস্থির করে ফেলেছেন। আত্মপর্যালোচনায় দেখেছেন যে, প্রত্যেক ইনিংসে অফস্টাম্পের বাইরের বল তাড়া করে উইকেট খুইয়েছেন। সুতরাং, দরকার নেই প্রতিভা ও দাপটের ঝলকানি, সঞ্জীবনী হোক বড় রান। তার জন্য প্রিয়তম শটকে বাদ দিতে হলে তাই সই।


সিডনিতে প্রথম ইনিংসে সচিন যখন ব্যাট করতে নামলেন, পরপর দু'উইকেট হারিয়ে চাপে ভারত। আগুন ঝরাচ্ছেন ব্রেট লি-গিলেসপিরা। তিনি ক্রিজে যেতেই শুরু হয়ে গেল অফস্টাম্পের ঠিক বাইরে বোমাবর্ষণ। সচিন এলেন, দেখলেন, এবং পোড়খাওয়া সেনা নায়কের মতো অফস্টাম্পের বাইরের বল ছাড়তে শুরু করলেন।


অস্ট্রেলিয়ার সমস্ত কৌশল ব্যর্থ হল। প্রথমে সেঞ্চুরি। পরে ডাবল সেঞ্চুরি। শেষ পর্যন্ত অপরাজিতই রইলেন সচিন। দাদার দেওয়া চ্যালেঞ্জ জিতে নিয়ে। ৪৩৬ বলে ২৪১ রানে। সঙ্গী ভি ভি এস লক্ষ্মণও বড় সেঞ্চুরি করেছিলেন। তবু দুঁদে অধিনায়ক স্টিভ ওয় তাজ্জব হয়ে দেখেছিলেন যে, সচিন তাঁর সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়ে নতুন রূপকথা তৈর করছেন। পরে কিংবদন্তি ওয় বলেন, 'আমরা ভেবেছিলাম ভেতরে ঢুকে আসা বলে ওর দুর্বলতা রয়েছে। আগের কয়েকটা ইনিংসে সেই বলেই ওর উইকেট এসেছিল। সিডনিতেও আমাদের সেই পরিকল্পনা ছিল আর দেখলাম যে একটাও কভার ড্রাইভ না মেরে ২৪১ করে দিল সচিন।'


যে ইনিংস দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন ব্রায়ান চার্লস লারাও। সেই লারা, ক্রিকেট কেরিয়ারে যিনি সচিনের শ্রেষ্ঠত্বকে বারবার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তি সচিনের ইনিংসে এতটাই মোহিত হন যে, কয়েকদিন আগেও সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই ইনিংসে সচিনের সংযমের উদাহরণ তুলে ধরে করোনার বিরুদ্ধে সকলকে লড়াইয়ের আহ্বান করেন। লারা বলেন, সচিন সেদিন ওই সংযম দেখাতে পারলে করোনার বিরুদ্ধে আম আদমিই বা পারবে না কেন!


আর সচিন? তিনি নিজে জানিয়েছিলেন, দাদাকে জবাব দিতে পেরে ভেতর ভেতর খুশি হয়েছিলেন। আর চাপ কাটানোর জন্য ব্রায়ান অ্যাডামসের 'সামার অফ ৬৯' গানটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার শুনেছিলেন।


টেস্ট ম্যাচটি ড্র করেছিল সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের ভারত। কিন্তু সচিনের ২৪১ চিরকালীন জায়গা করে নিয়েছিল ক্রিকেট-রূপকথায়।