কলকাতা: বল হাতে তাঁর দক্ষতা দেখে মুগ্ধ প্রাক্তন ক্রিকেটারেরা। আইপিএলে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্য়াঙ্গালোরের জার্সিতে ডেথ ওভারে তাঁর বোলিং দাপট দেখে লক্ষ্মীপতি বালাজি তাঁকে যশপ্রীত বুমরার সঙ্গে তুলনা করেছেন। প্রতিপক্ষের উইকেট দরকার হলেই বিরাট কোহলি বল তুলে দিচ্ছেন তাঁর হাতে। আর কখনও অভ্রান্ত বাউন্সারে, কখনও নিখুঁত ইয়র্কারে অধিনায়কের মুখে হাসি ফোটাচ্ছেন তিনি, মহম্মদ সিরাজ। চরম আর্থিক অনটনের সঙ্গে লড়াই করে ভারতীয় ক্রিকেটের মূল স্রোতে জায়গা করে নেওয়া, দলের ভরসা হয়ে ওঠা। নিউজ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল ও জো রুটদের বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজ খেলতে ২ জুন ইংল্যান্ড উড়ে যাবেন। আপাতত মুম্বইয়ের হোটেলে কোয়ারেন্টিনে রয়েছেন ২৭ বছরের ডানহাতি পেসার। শনিবার সন্ধ্যায় টিমহোটেল থেকে মোবাইল ফোনে এবিপি লাইভ-কে দীর্ঘ, একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন ভারতীয় পেস বোলিংয়ের নতুন তারা।
প্রশ্ন: অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে টেস্টে স্বপ্নের অভিষেক হয়েছিল। এবার সামনে ইংল্যান্ড সফর। অস্ট্রেলিয়ার পিচে গতি আর বাউন্স থাকলে ইংল্যান্ডে রয়েছে সুইং। কীভাবে প্রস্তুত হচ্ছেন?
মহম্মদ সিরাজ: আমি খুবই উত্তেজিত। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালের দলে রয়েছি। যে কোনও ক্রিকেটারের কাছে স্বপ্নের মতো। অস্ট্রেলিয়ার পিচে গতি ও বাউন্স ছিল। তাই আমি ব্যাক অফ গুড লেংথে বল করেছিলাম। তাতেই সাফল্য পেয়েছি। ২০১৮ সালে ইন্ডিয়া এ-র হয়ে ইংল্যান্ডে গিয়েছিলাম। দুটো ম্যাচ খেলেছিলাম। ওখানে লাইন-লেংথ অ্যাডজাস্ট করতে হয়েছিল। ৬-৮ মিটারের মধ্যে বল করতে হচ্ছিল। ইংল্যান্ডের মাটিতে ব্যাটসম্যানকে যত সামনের পায়ে খেলানোর প্রলোভন দেখাব, তত উইকেট তোলার সম্ভাবনা বাড়বে।
প্রশ্ন: বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ভারতের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী হবে বলে মনে করেন?
সিরাজ: আমরা আইপিএল খেলে যাচ্ছি। এখন সকলে কোয়ারেন্টিনে আছি। প্রস্তুতির বেশি সুযোগ পাব না আমরা। নিভৃতবাসে থাকাকালীন নেট প্র্যাক্টিস করতে পারছি না। তাই দ্রুত পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে নিজেদের সেরা ক্রিকেট বার করে আনাটা বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে।
প্রশ্ন: টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান কেন উইলিয়ামসনকে বল করতে হবে। নিউজ়িল্যান্ডের অধিনায়কের বিরুদ্ধে গেমপ্ল্যান কী হবে?
সিরাজ: আমার লক্ষ্য থাকবে টানা এক জায়গায় বল করে যাওয়া। তাতে সব ব্যাটসম্যানেরই সমস্যা হয়। উইলিয়ামসনকে রান করতে দিলে হবে না। টানা ডট বল করে চাপ তৈরি করতে হবে। আমি উইকেট না পেলেও চাপ তৈরি করতে পারলে অন্য প্রান্ত থেকে উইকেট পড়বেই।
প্রশ্ন: নিউজ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালের পরই ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে পাঁচ ম্য়াচের টেস্ট সিরিজ। নিউজ়িল্যান্ডের উইলিয়ামসন থাকলে ইংল্যান্ডের রয়েছে জো রুট। দুজনই বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান। কী হবে আপনার কৌশল?
সিরাজ: প্রত্যেক ব্যাটসম্যানের ভিডিও দেখি। তাদের শক্তি কী, কোথায় দুর্বলতা, তা নিয়ে পর্যালোচনা করি। জানি, ব্যাটসম্যানের দুর্বল জায়গায় বল করলে দলেরও লাভ, আমারও। পাশাপাশি ব্যাটসম্যান যে সমস্ত জায়গায় শট খেলতে স্বচ্ছন্দ, সেখানে বল দেওয়া উচিত না। আর রুটের কথা বললে বলতে পারি, কিছুদিন আগেই ভারত-ইংল্যান্ড টেস্ট সিরিজে রুটকে আউট করেছি। ভিতরের দিকে ঢুকে আসা বলে রুটের দুর্বলতা রয়েছে। রুটকে তাই ইনসুইঙ্গিং ডেলিভারি করতে হবে।
প্রশ্ন: আইপিএল অর্ধসমাপ্ত। তবে যে'কটা ম্যাচ হয়েছে, তাতে নজর কেড়েছে ডেথ ওভারে আপনার দুরন্ত বোলিং। প্রাক্তন ক্রিকেটারেরা প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কী পরিবর্তন এনেছেন বোলিংয়ে?
সিরাজ: আমি একটাই লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নামি। সুযোগ পেয়েছি আর সেটাকে কাজে লাগাতে হবে। আগে খেলতে নেমে একটু নার্ভাস থাকতাম। তবে ম্যাচ খেলতে খেলতে সেটা কেটে গিয়েছে। এখন আমি অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে টেস্ট সিরিজ খেলে নিজের লাইন-লেংথকে অভ্রান্ত করে তুলেছি। তারই সুফল পাচ্ছি। ইংল্যান্ডেও সেই ছন্দ বজায় রাখাই লক্ষ্য। আর সিনিয়র ক্রিকেটারেরা প্রশংসা করলে আত্মবিশ্বাস বাড়ে।
প্রশ্ন: আইপিএলে, জাতীয় দলে, দু'জায়গাতেই বিরাট কোহলির নেতৃত্বে খেলেছেন। আপনার কেরিয়ারে ক্যাপ্টেন কোহলির ভূমিকা কী?
সিরাজ: আমি আজ যে জায়গায় দাঁড়িয়ে, তার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব বিরাট কোহলির। আইপিএলে যখন রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের হয়ে খুব একটা ভাল কিছু করতে পারিনি, তখনও আমার পাশে ছিল। উৎসাহ দিয়েছে। দলে ধরে রেখেছে। আমার সংগ্রামটা জানে।
প্রশ্ন: জাতীয় দলের কোচ রবি শাস্ত্রীর কাছে কতটা সমর্থন পান?
সিরাজ: অস্ট্রেলিয়া সফর চলাকালীন যখন আমার বাবা মারা যান, রবি স্যার ও বোলিং কোচ ভরত অরুণ স্যার ভীষণভাবে আগলে রেখেছিলেন। রবি স্যার বলেছিলেন, তুই টেস্ট ম্যাচ খেললে ৫ উইকেট পাবি। তোর বাবার আশীর্বাদ থাকবে সঙ্গে। আমার মনের মধ্যে বিশ্বাসটা গেঁথে দিয়েছিলেন। পাঁচ উইকেট নেওয়ার পর রবি স্যার বলেছিলেন, কীরে, তোকে বলেছিলাম না পাঁচটা উইকেট নিবি! হেড কোচ ও বোলিং কোচেরা এরকম কথা বললে আত্মবিশ্বাস অনেকটাই বেড়ে যায়। এতটাই আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছি যে, বিপক্ষে কোন ব্যাটসম্যান রয়েছে সেটার পরোয়া করি না। নিজের সেরাটা দিই।
প্রশ্ন: অস্ট্রেলিয়া সফর চলাকালীন বাবার মৃত্যু, ভারতে না ফিরে দলের সঙ্গে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত, এবং পরে দেশে ফিরে বিমানবন্দর থেকে সরাসরি বাবার সমাধিস্থলে গিয়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন, যে ছবি দেখে অনেকের চোখে জল এসে গিয়েছিল, কতটা কঠিন ছিল সেই অধ্যায়?
সিরাজ: খুব কঠিন সময় ছিল। বাবার স্বপ্নই ছিল তাঁর ছেলে দেশের হয়ে খেলবে, দেশের নাম উজ্জ্বল করবে। আমি ফিরে এলে বাবার স্বপ্নপূরণ হতো না। মায়ের সঙ্গে কথা বলি। মা বলে, বেটা, তুই আসিস না। বাবার ইচ্ছে পূরণ কর। সেই জন্যই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত। আমার বাগদত্তাও সেই সময় ভীষণভাবে পাশে ছিল।
প্রশ্ন: বাবার কোন জিনিসটা সব সময় মনে রাখতে চান?
সিরাজ: বাবা সব সময় আগলে রাখতেন। ফোন করে খোঁজ নিতেন, তুই খেয়েছিস? বাড়ি ফিরতে একটু দেরি হলে ফোন করে খোঁজ নিতেন, খেয়েছি কি না জানতে চাইতেন। সব সময় মনে পড়ে সেগুলি।
প্রশ্ন: বায়ো বাবল নিয়ে এত চর্চা হচ্ছে, জৈব সুরক্ষা বলয়ে টানা অনেকদিন আছেন। এত কড়া বিধিনিষেধ মানা কতটা কঠিন?
সিরাজ: ক্রিকেটারদের জন্য এটা ভীষণই কঠিন। আগে আর যাই হোক একটু বাইরে বেরনো যেত। বায়ো বাবলে ভীষণ কড়াকড়ি। তবে শুধু খেলার ওপর মনোনিবেশ করা যায়। ক্রিকেটার হিসাবে চারিত্রিক দৃঢ়তা আরও বেড়ে যায় এতে।
প্রশ্ন: অবসর সময়ে কী করেন? জৈব সুরক্ষা বলয়ে তো ঘরবন্দি থাকতে হয়। সময় কাটান কীভাবে?
সিরাজ: ওটিটি প্ল্যাটফর্মে সিনেমা বা সিরিজ দেখি। তাতেই সময় কেটে যায়।
প্রশ্ন: প্রিয় অভিনেতা কে?
সিরাজ: টলিউডে (দক্ষিণী সিনেমায়) প্রভাস আমার প্রিয় অভিনেতা। আর বলিউডে রণবীর সিংহ।
প্রশ্ন: আর প্রিয় অভিনেত্রী?
সিরাজ: জ্যাকলিন ফার্নান্ডেজকে খুব ভাল লাগে। এছাড়া নোরা ফতেহি ও দীপিকা পাডুকোনকে ভাল লাগে।
প্রশ্ন: বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালের কারা এগিয়ে থাকবে?
সিরাজ: নিউজিল্যান্ড সুবিধাজনক জায়গায় থাকবে। ওরা আমাদের চেয়ে প্রায় একমাস আগে ইংল্যান্ডে পৌঁছে গিয়েছে। টেস্ট সিরিজ খেলে আমাদের বিরুদ্ধে ফাইনালে নামবে। ওরা আত্মবিশ্বাসী থাকবে। পরিবেশ-পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। আমাদের গিয়ে মানিয়ে নিতে হবে।
প্রশ্ন: পেসারদের কাছে ফিটনেস ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। নিজেকে ফিট রাখার জন্য কী করেন?
সিরাজ: ফিটনেস নিয়ে ভীষণ পরিশ্রম করি। জিমে অনেকটা করে সময় কাটাই। পেসারদের ফিটনেস ধরে রাখাটা খুব জরুরি। পাশাপাশি টেস্ট ম্যাচ খেলাটা খুব একটা সহজ নয়। লম্বা স্পেলে বল করতে হয়। দীর্ঘক্ষণ মাঠে ফিল্ডিং করতে হয়। তাই ফিটনেস ধরে রাখা ও শরীরের নমনীয়তা বজায় রাখায় বিশেষ গুরুত্ব দিই।
প্রশ্ন: প্রবল দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে রঞ্জি ট্রফি, আইপিএল, জাতীয় দলে সুযোগ, মহম্মদ সিরাজের জীবন কতটা পাল্টেছে?
সিরাজ: আমি ভীষণ অভাবী পরিবার থেকে উঠে এসেছি। একটা সময় আমার কোনও গাড়ি ছিল না। একটা বাজাজ প্লাটিনা বাইক ছিল। সেই বাইকের সেলফ স্টার্ট তো দূরের কথা, কিকও ছিল না। ধাক্কা মেরে স্টার্ট করতে হতো। হায়দরাবাদের হয়ে যারা রঞ্জি ট্রফি খেলত, প্রত্যেকে গাড়িতে আসত। আমার ওই প্লাটিনা বাইকে চড়ে আসতে খুব অস্বস্তি হতো। লজ্জা লাগত। মাঠ থেকে সকলে চলে যাওয়ার পর তারপর বাইকটা ধাক্কা মেরে স্টার্ট করে বেরতাম। বাবা অটো চালাতেন। সংসারে অনটন ছিল। খুব লড়াই করতে হয়েছে। তবে বিশ্বাস করি, লড়াই করে গেলে পুরস্কার পাবই। এখন জীবনে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য এসেছে। তবে ওই বাইকটাকে এখনও রেখে দিয়েছি। ওটা দেখলে নিজের লড়াইটা মনে পড়ে যায়। আরও এগিয়ে চলার, পরিশ্রম করার তাগিদ পাই।