সন্দীপ সরকার, কলকাতা: গলি থেকে রাজপথের কাহিনি মনে পড়ে যেতে পারে তাঁর উত্থান দেখে। দুবেলা অন্ন সংস্থান করতে যাঁর কালঘাম ছুটত, তাঁর জন্য এখন গোটা গ্রামে মিষ্টি বিতরণ চলছে।


অচিন্ত্য শিউলির (Achintya Sheuli) সাফল্য অবশ্য একদিনে আসেনি। কমনওয়েলথ গেমসে (Commonwealth Games) ভারোত্তোলনে ৭৩ কেজি বিভাগে রেকর্ড ৩১৩ কেজি ওজন তুলে সোনা জিতেছেন হাওড়ার দেউলপুরের অ্যাথলিট। তাঁর স্বপ্নপূরণের নেপথ্যে রয়েছে কঠোর থেকে কঠোরতর পরিশ্রম। যা শুনলে চমকে উঠতে হয় বৈকি!


বার্মিংহাম থেকে মোবাইল ফোনে এবিপি লাইভকে সেই গল্প শোনাচ্ছিলেন ২০ বছর বয়সী ভারোত্তোলক। গোটা দেশে তাঁকে নিয়ে উৎসব হচ্ছে। অভিনন্দন জানিয়ে একের পর এক বার্তা ভেসে উঠছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। কখনও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, তো পরক্ষণেই রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু বা বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যা দেখেশুনে অচিন্ত্য বলছেন, 'আমি খুব খুশি। স্বপ্ন সফল হয়েছে। আন্তর্জাতিক মঞ্চে দেশের হয়ে সোনা জিতব, স্বপ্ন দেখতাম। আজ সেটা বাস্তব। শুনলাম গ্রামে উৎসব হচ্ছে। সকলে রাত জেগে খেলা দেখেছেন। আমি সকলকে ধন্যবাদ জানাতে চাই।'


ছোটবেলায় দেখতেন, দাদা অলোক স্থানীয় প্রশিক্ষক অষ্টম দাসের কাছে ভারোত্তোলনে তালিম নিচ্ছে। সেই থেকে ভারোত্তোলক হওয়ার ইচ্ছে তৈরি হয়। দাদার হাত ধরেই অষ্টম স্যারের শিবিরে যোগ দেওয়া। কিন্তু বিধি বাম। অচিন্ত্য ভারোত্তোলন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান বাবা। যিনি পেশায় ছিলেন ভ্যানচালক।


'বাবা মারা যেতে অথৈ জলে পড়েছিলাম। আমি, মা ও দাদা মিলে খুব কঠিন সময় কাটিয়েছি। অভাবের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে। পুষ্টিকর কিছু খেতে পেতাম না। তবে লড়াই ছাড়িনি', বলছিলেন অচিন্ত্য। প্রতিযোগিতায় মাথার ওপর তুলে ধরা ওজনের ভারে যখন গোটা শরীর থরথর করে কাঁপে, আর চোয়াল আরও শক্ত হয়ে ওঠে, অচিন্ত্য তখন যেন মানসচক্ষে সেই অনটনের দিনগুলোয় ফিরে যান। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেন, হাল ছাড়লে চলবে না। বলছেন, 'দারিদ্রর সঙ্গে লড়াই করতে করতে মানসিকভাবে আমি আরও কঠিন হয়ে উঠেছি।'


কেমন ছিল কমনওয়েলথ গেমসের প্রস্তুতি? অচিন্ত্য বলছেন, 'আমরা প্রায় এক মাস আগে বার্মিংহামে পৌঁছে গিয়েছিলাম। রোজ প্রায় ৭ ঘণ্টা করে অনুশীলন করতাম। সকালে ৭.৩০-এ প্রাতঃরাশ। তারপর সকাল ৯.৪০ থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ট্রেনিং। দুপুরে লাঞ্চ ও সামান্য বিশ্রাম নিয়ে ফের বিকেল ৪.৪০ থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ট্রেনিং। এই ছিল রোজনামচা।'


২০১৫ সালে পুণেতে ইয়ুথ কমনওয়েলথ চ্যাম্পিয়নশিপে পদক অচিন্ত্যকে বিশ্বাস করতে শিখিয়েছিল যে, চেষ্টা করলে সবই সম্ভব। বাংলার অ্যাথলিট বলছিলেন, '২০১৫ সালে সেনাবাহিনীতে যোগ দিই। সেনাবাহিনীর ট্রায়ালে নির্বাচিত হওয়ার পরই সেনা শিবিরে চলে যাই। সেনাবাহিনীতে থেকে শৃঙ্খলা শিখেছি। পরিশ্রম করার ক্ষমতা আরও বেড়েছে।'


সাফল্য কাকে উৎসর্ব করবেন? বিন্দুমাত্র না ভেবে অচিন্ত্য বলছেন, 'দাদা ও কোচকে উৎসর্গ করছি। ওরা না থাকলে এখানে পৌঁছতেই পারতাম না।'


পদকের লড়াইয়ে নামার আগে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন মীরাবাঈ চানু। যিনি নিজে বার্মিংহামে রেকর্ড গকড়ে সোনা জিতেছেন। 'আমি সোনা জেতায় চানু দিদি খুব খুশি। স্টেজ থেকে নামতেই অভিনন্দন জানিয়েছে,' বলছিলেন অচিন্ত্য।


প্রধানমন্ত্রী ট্যুইট করে জানিয়েছেন, এবার সিনেমা দেখুন। প্রসঙ্গ তুলতেই হেসে অচিন্ত্য বলছেন, 'কমনওয়েলথ গেমসে আগে মোদিজীর সঙ্গে কথা হয়েছিল। আমি বলেছিলাম, সিনেমা দেখতে খুব ভালবাসি। কিন্তু কমনওয়েলথের প্রস্তুতির জন্য সিনেমা দেখা হচ্ছে না। তাতে উনি বলেছিলেন, পদক জেতো। তারপর প্রাণ ভরে সিনেমা দেখো।'


৫ অগাস্ট বাড়ি ফিরবেন অচিন্ত্য। আপাতত প্রিয় সিনেমা দেখে দিনকয়েক ছুটি কাটাতে চান। তারপরই শুরু হবে পরের সংকল্প। অলিম্পিক্সে পদক জয়ের লক্ষ্যে প্রস্তুতি শুরু করে দিতে চান হাওড়ার তরুণ।


আরও পড়ুন: বাবার শেষকৃত্য করেছিলেন ধার করে, ধান বয়ে মিলত ঘুগনি-ডিম, ইতিহাস হাওড়ার অচিন্ত্যর