কলকাতা: কার্যত ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছে তিন শতাব্দীপ্রাচীন ক্লাব - মোহনবাগান, মহমেডান ও ইস্টবেঙ্গল। এক পাশে বয়ে চলেছে গঙ্গা। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাইটার্স বিল্ডিং, রাজভবন, হাওড়া ব্রিজের মতো ঐতিহ্য আর ইতিহাসের মেলবন্ধনের এক ঝাঁক নিদর্শন। তার মাঝে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে ক্রিকেটের নন্দনকানন। ইডেন গার্ডেন্স (Eden Gardens)। যেখানে ক্রিকেট আর ইতিহাস পথ হাঁটে হাতে হাত ধরে।


শহর কলকাতার প্রাণচঞ্চলতার রেশ ছুঁয়ে গিয়েছে যে স্টেডিয়ামকে। তিলোত্তমার বুকে ক্রিকেটের পীঠস্থানকে দেশের তো বটেই, বিশ্বের অন্যতম সেরা মাঠ মনে করা হয়। বঙ্গ ক্রিকেটের নিয়ামক সংস্থা সিএবি-র (CAB) অধীনস্থ স্টেডিয়ামে হবে এবারের বিশ্বকাপের (ODI World Cup) একটি সেমিফাইনাল-সহ মোট ৫টি ম্যাচ। যার মধ্যে তিনটি ব্লকবাস্টার। শুরুতে বাংলাদেশ বনাম নেদারল্যান্ডস। তারপর পাকিস্তান বনাম বাংলাদেশ। ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীরা মুখিয়ে থাকবেন ৫ নভেম্বরের দিকে। সেদিন রোহিত শর্মার টিম ইন্ডিয়ার সঙ্গে লড়াই দক্ষিণ আফ্রিকার। পাকিস্তান-ইংল্যান্ড হাইভোল্টেজ় ম্যাচও রয়েছে এই মাঠে। আর রয়েছে দ্বিতীয় সেমিফাইনাল। পাকিস্তান সেমিফাইনালে উঠলে আর তাদের ম্যাচ ভারতের বিরুদ্ধে পড়লে ইডেনেই হবে মহারণ। আর সত্যি যদি তাই হয়, তাহলে ১৯৯৬ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালের অভিশাপ মুছে দিতে যে চেষ্টার কসুর করবে না টিম ইন্ডিয়া, এখন থেকেই বলে দেওয়া যায়।


ওয়ান ডে বিশ্বকাপের আর দু'সপ্তাহও বাকি নেই। সাজ সাজ রব পড়ে গিয়েছে বিশ্বক্রিকেটে। সব দলই শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি সারতে ব্য়স্ত। তার ফাঁকে এবিপি লাইভ বিশ্বকাপের দশ স্টেডিয়ামের হাল হকিকত জানাতে শুরু করল বিশেষ এই সিরিজ়। যার অষ্টম পর্বে আলোচনা চলছে ইডেন গার্ডেন্স নিয়ে।


আর ইডেন গার্ডেন্স মানেই ক্রিকেট ইতিহাসের একের পর এক অমরগাথা। হিরো কাপে অনিল কুম্বলের বিধ্বংসী স্পেল, শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে রোহিত শর্মার ২৬৪, শুধু ওয়ান ডে ক্রিকেটেই এক ঝাঁক মণিমুক্তো।


রয়েছে কালো দাগও। যার মধ্যে অন্যতম, ১৯৯৬ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল। শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ভারতের ব্যাটিং বিপর্যয়। যা গণরোষ তৈরি করেছিল। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ম্যাচ। ২০১১ বিশ্বকাপে ভারত-ইংল্যান্ড ম্যাচ সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল স্টেডিয়াম তৈরি নয় বলে। ২০১৫ সালে দুপুরের বৃষ্টিতে রাতের ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা টি-টোয়েন্টি ভেস্তে যাওয়ার পর মাঠের আমূল সংস্কার করা হয়। কোরিং করে মাঠে বালির পরিমাণ বাড়ানো হয়। বদলে যায় পিচও। ইডেন গার্ডেন্সের বাইশ গজ এখন দেশের অন্যতম সেরা। গত আইপিএলেও সেরা পিচের তকমা পেয়েছে। মুম্বইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের সঙ্গে যুগ্মভাবে।


এবারের বিশ্বকাপের আগে নতুন চেহারায় সাজছে ক্রিকেটের নন্দনকানন। বদলে গিয়েছে ক্লাব হাউসের চেহারা। নতুন প্রেস বক্স, ঝাঁ চকচকে ড্রেসিংরুম। কর্পোরেট বক্স। বদলে গিয়েছে আলো। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ফ্লাডলাইট এখন আলোকিত করে তোলে মাঠকে। সব মিলিয়ে বিশ্বকাপের জন্য তৈরি ইডেন গার্ডেন্স। এখন শুধু ২৮ অক্টোবর আম্পায়ারের প্লে বলার অপেক্ষা।


পিচ: একটা সময় ছিল, যখন ইডেন গার্ডেন্সে ম্যাচ মানেই সব দলের সহজ ফর্মুলা। টস জিতে প্রথমে ব্যাটিং করো। আর ওয়ান ডে ম্যাচে আড়াইশো রান চাপিয়ে দাও বিপক্ষের ওপর। তারপর স্পিনারদের দিয়ে ঘায়েল করো প্রতিপক্ষ শিবিরকে। ইডেন মানেই বল পড়ে ঘুরবে। থমকে আসবে। দাপট দেখাবেন কখনও অনিল কুম্বলে, তো কখনও মুথাইয়া মুরলীধরন। দ্বিতীয়ার্ধে শিশিরের কাঁটাও থাকবে। তবে ২০১৫ সালে পিচের মাটি বদলে ফেলার পর এখন ইডেনের বাইশ গজের চরিত্র সম্পূর্ণ পাল্টে গিয়েছে। এখন বল পড়ে সাঁ সাঁ গতিতে যায়। সঙ্গে বাউন্স। স্ট্রোকপ্লেয়ারদের কাছে স্বর্গরাজ্য। ওয়ান ডে ম্যাচে তিনশোর বেশি রান হামেশাই ওঠে। বিশ্বকাপের উইকেটও সেরকমই থাকবে। পিচে থাকবে হাল্কা সবুজের আভা। বড় রানের ম্যাচ হবে, এখন থেকেই জানিয়ে দিয়েছেন কিউরেটর সুজন মুখোপাধ্যায়।


আবহাওয়া: বিশ্বকাপে ইডেন গার্ডেন্সে সবকটি ম্যাচই হবে শেষ অক্টোবর থেকে মাঝ নভেম্বরে। সেই সময় হয়তো ঠান্ডা জাঁকিয়ে পড়বে না। তবে শীতের আমেজ থাকবে। সবচেয়ে বড় কথা, শিশির পড়বে। সব দলকেই তাই শিশিরের সঙ্গে লড়াই করতে হবে। বিশেষ করে দ্বিতীয়ার্ধে। ইডেনের সবকটি ম্যাচই হবে নৈশালোকে। তাই পরে ফিল্ডিং করা দলকে বল গ্রিপ করতে সমস্যায় পড়তে হবে।


স্টেডিয়ামের মোট আসনসংখ্যা: ৬৪,৫০০


ইডেন গার্ডেন্সে ওয়ান ডে রেকর্ড:


প্রথম ওয়ান ডে – ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৭


শেষ ওয়ান ডে – ১২ জানুয়ারি, ২০২৩


ম্যাচ – ৩১


মোট রান – ১৪১২২


মোট উইকেট – ৪৪৯


উইকেট প্রতি রান খরচ – ৩১.৪৫


ওভার প্রতি রান – ৫.১১


সর্বোচ্চ ইনিংস – ভারত ৪০৪/৫ (বনাম শ্রীলঙ্কা, ১৩ নভেম্বর, ২০১৪। ভারত জয়ী ১৫৩ রানে)


সর্বনিম্ন ইনিংস – ভারত ১২০/৮ (বনাম শ্রীলঙ্কা, ১৩ মার্চ, ১৯৯৬, বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল। জয়ী শ্রীলঙ্কা)


সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত স্কোর – রোহিত শর্মা (২৬৪ বনাম শ্রীলঙ্কা, ১৩ নভেম্বর, ২০১৪)


সেরা বোলিং – অনিল কুম্বলে ৬.১-২-১২-৬ (বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ়, ২৭ নভেম্বর, ১৯৯৩)


ফলাফল হয়েছে, এরকম ৩০টি ম্যাচের মধ্যে প্রথমে ব্যাটিং করা দল ১৮টি ম্যাচ জিতেছে


ইডেন গার্ডেন্সে ভারতের ওয়ান ডে রেকর্ড:


ম্যাচ – ২২


জয় – ১৩


পরাজয় - ৮


ফলাফল হয়নি ১টি ম্যাচের


ইডেন গার্ডেন্সে বিশ্বকাপের ম্যাচ:


১. বাংলাদেশ বনাম নেদারল্যান্ডস, ২৮ অক্টোবর, শনিবার, দুপুর ২.০০


২. বাংলাদেশ বনাম পাকিস্তান, ৩১ অক্টোবর, মঙ্গলবার, দুপুর ২.০০


৩. ভারত বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা, ৫ নভেম্বর, রবিবার, দুপুর ২.০০


৪. পাকিস্তান বনাম ইংল্যান্ড, ১১ নভেম্বর, শনিবার, দুপুর ২.০০


৫. দ্বিতীয় সেমিফাইনাল, ১৬ নভেম্বর, বৃহস্পতিবার, দুপুর ২.০০


আরও পড়ুন: শৈলশহরে শিশিরে ঘুরে যেতে পারে ম্যাচের মোড়, বিশ্বকাপে ধর্মশালায় ধুন্ধুমারের অপেক্ষা