কলকাতা: ২০২৩-কে বিদায় জানানোর সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চয়ই ধন্যবাদও দেবেন ইস্টবেঙ্গল সমর্থকেরা। গত তিন বছর ধরে পাওয়া তীব্র যন্ত্রণার অবসান যেমন হয় এই বছরেই, তেমনই শতাধিক বছরেরও বেশি ঐতিহ্যবাহী ক্লাব কিছুটা হলেও দুঃসময় কাটাতে শুরু করেছে এই বছরেই। তাই ২০২৪-কে বরণ করে নেওয়ার আগে বিদায়ী বছরকে লাল-হলুদ সমর্থকেরা ধন্যবাদ না দিলে, সেটা বোধহয় অন্যায়ই হবে।

   


যে মরশুম থেকে হিরো আইএসএলে খেলা শুরু করে ইস্টবেঙ্গল, সেই মরশুম থেকেই তারা সাফল্যের অভাবে ভুগেছে। অভিষেক মরশুমে তারা ছিল লিগ টেবলের ন’নম্বরে। দ্বিতীয় মরশুমে তারা ছিল সর্বশেষ স্থানে, ১১-য় এবং গতবার ফের সেই নয়ে। এ বার তার চেয়ে ভাল জায়গায় থাকবে ইস্টবেঙ্গল এফসি-র নাম, এই আশা নিয়েই বছর শেষ করছেন লাল-হলুদ জনতা।  


উন্নতির শুরু


গত মরশুমের পারফরম্যান্স থেকে এই আশার আলো দেখেছেন তাঁরা। কারণ, আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে লাল-হলুদ ব্রিগেডের পারফরম্যান্স। ২০২১-২২-এ সারা লিগে তারা একটিমাত্র ম্যাচ জিতেছিল। গত মরশুমে তারা ছ’টি ম্যাচ জেতে, যা তার আগের দুই মরশুমে মোট জয়ের চেয়েও বেশি।


গত মরশুমে তারা বেঙ্গালুরু এফসি-কে দু’বারের মুখোমুখিতেই যেমন হারায়, তেমন গতবারের লিগশিল্ডজয়ী মুম্বই সিটি এফসি-কে তাদের মাঠে গিয়ে হারিয়ে আসে এবং ঘরের মাঠে কেরালা ব্লাস্টার্সের মতো দলের বিরুদ্ধেও জেতে। এই পারফম্যান্সকে আর যাই হোক, মোটেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।


২০২২-এর শেষে যখন তারা দ্বিতীয় লেগ শুরু করে বেঙ্গালুরুর বিরুদ্ধে জয় দিয়ে, তখনও তারা সেরা ছয়ের মধ্যে থাকার স্বপ্ন দেখছিল। কিন্তু সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায় ২০২৩-এর শুরুতেই, ওডিশা এফসি, জামশেদপুর এফসি, হায়দরাবাদ এফসি ও এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে টানা চারটি ম্যাচে হারের ধাক্কায়। এই চারটি ম্যাচে ১১টি গোল খায় তারা দেয় মাত্র চারটি। শেষ পাঁচটি ম্যাচের মধ্যে সেমিফাইনালিস্ট কেরালা ব্লাস্টার্স ও লিগশিল্ড মুম্বই সিটি এফসি-র বিরুদ্ধে লাল-হলুদ বাহিনী দুটি বড় জয় পায় ঠিকই, কিন্তু বাকি ম্যাচগুলির ব্যর্থতা তাদের আর ন’নম্বরের ওপর উঠতে দেয়নি।


সেই কারণেই, এ বার মরশুম শুরুর অনেক আগে থেকেই নতুন উদ্যমে মাঠে নেমে পড়ে লাল-হলুদ শিবির। প্রথমে একজন ভাল কোচ বাছাই, তার পরে একটা ভাল দল বাছা এবং সেই দলটাকে তৈরি করার জন্য ভাল প্রাক-মরশুম প্রস্তুতির ব্যবস্থা করা, এ সবই করেছে ইস্টবেঙ্গল কর্তৃপক্ষ। চেষ্টায় কোনও ত্রুটি ছিল না তাদের। যার ফল তারা মরশুমের শুরুতেই পায় ডুরান্ড কাপের আসরে।


গত তিন মরশুম ধরে টানা একতরফা ব্যর্থতার জ্বালায় ডার্বি থেকে মুখ ফেরাতে শুরু করেছিলেন লাল-হলুদ জনতা। এ বছর ১২ অগাস্ট উপশম হয় ৫৫ মাস ধরে সহ্য করা যন্ত্রণার। তামিলনাড়ু থেকে আসা লাল-হলুদ বাহিনীর নতুন তারকা নন্দকুমার শেখরের একমাত্র গোলে। সেই ডার্বির আগে ধারে ও ভারে এবং সাম্প্রতিক সাফল্যের বিচারে মোহনবাগান সুপার জায়ান্টকে অনেকটাই এগিয়ে রেখেছিলেন ফুটবল বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু প্রাক্তন আইএসএল চ্যাম্পিয়ন কোচ কার্লস কুয়াদ্রাতের ইস্টবেঙ্গল সে দিন সব হিসেব পাল্টে দেয়।


টানা চার ম্যাচে অপরাজিত থেকে ডুরান্ডের ফাইনালে ওঠে তারা। ফাইনালে ফের চিরপ্রতিদ্বন্দী মোহনবাগান এসজি-রই মুখোমুখি হয়। এ বারও সারা ম্যাচে দুই দলই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে। দ্বিতীয়ার্ধে মোহনবাগানের উইঙ্গার অনিরুদ্ধ থাপা লাল কার্ড দেখে মাঠ ছেড়ে চলে যাওয়ার পরেও ৭১ মিনিটে একক দক্ষতায় দুর্দান্ত এক গোল করে দলকে এগিয়ে দেন অস্ট্রেলিয়ান ফরোয়ার্ড দিমিত্রিয়স পেট্রাটস। এই গোলেই শেষ পর্যন্ত ফাইনাল জিতে নেয় মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। জিততে না পারলেও আইএসএলের নতুন মরশুমে যে দুই প্রধান সমানে সমানে টক্কর দেবে, এই দুই ম্যাচে তারই ইঙ্গিত পাওয়া যায়।


গত আইএসএলে ন’নম্বরে থেকে লিগ শেষ করার পর দলের এক ঝাঁক ফুটবলারকে ছেড়ে দেয় লাল-হলুদ বাহিনী। ভারতীয় ফুটবলার জেরি লালরিনজুয়ালা, সেম্বয় হাওকিপ, সুমিত পাসি, শুভম সেন, নবীন কুমার, অমরজিৎ সিং কিয়াম ও হীমাংশু জাঙরা এবং বিদেশী ফুটবলার অ্যালেক্স লিমা, চ্যারিস কিরিয়াকু, জেক জার্ভিস ও জর্ডন ও’ডোহার্টিকে বিদায় দেয় তারা।


এই মরশুমের জন্য তাই ঢেলে দল সাজানো হয়। জুনে সিনিয়র ডিফেন্ডার হরমনজ্যোৎ সিং খাবরা, মান্দার রাও দেশাইকে সই করায় তারা। তার আগে স্প্যানিশ ফরোয়ার্ড হাভিয়ে সিভেরিও ও সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার সল ক্রেসপোকে সই করায় কলকাতার ঐতিহ্যবাহী ক্লাব। এ ছাড়া হায়দরাবাদ এফসি থেকে স্প্যানিশ মিডফিল্ডার বোরহা হেরেরা গঞ্জালেসকেও নিয়ে আসা হয়। যোগ দেন আর এক স্প্যানিশ ডিফেন্ডার হোসে পার্দো। এ ছাড়া গত মরশুমের দলে থাকা ব্রাজিলীয় স্ট্রাইকার ক্লেটন সিলভা তো ছিলেনই। ছিলেন দলের নির্ভরযোগ্য উইঙ্গার নাওরেম মহেশ সিংও।


২০২৩-এ ইস্টবেঙ্গল এফসি’র আইএসএল অভিযান: ম্যাচ- ১৯, জয়- ৪, হার- ৯, ড্র- ৬, গোল- ২০, প্রতিপক্ষের গোল- ২৬, ওপেন প্লে থেকে গোল- ১৪, সেট পিস থেকে গোল- ৫, সেভ- ৪৬, ক্লিন শিট- ৭।


বছরের সেরা পাঁচ স্কোরার: ক্লেটন সিলভা- ১০, নাওরেম মহেশ- ৩, নন্দকুমার শেখর- ২, ভিপি সুহের- ১, বোরহা হেরেরা- ১, জেক জার্ভিস- ১, সার্থক গলুই- ১।


সেরা নজির: লিগের ইতিহাসে এই প্রথম শুরুর দশ ম্যাচে ১১ পয়েন্ট সংগ্রহ করেছে ইস্টবেঙ্গল। গত তিন মরশুমে দশ ম্যাচে এত পয়েন্ট অর্জন করতে পারেনি তারা