কলকাতা: জুন মাসের জন্য অনেক ফুটবলপ্রেমীরই তর সইছিল না। বিশ্বকাপ, ইউরো কাপ, কোপা আমেরিকা, এই তিন টুর্নামেন্ট দেখার জন্য হা পিত্যেশ করে অপেক্ষা করি আমরা। আর এই জুনে একেবারে দুটি টুর্নামেন্টে, তাও প্রায় একই সঙ্গে শুরু হচ্ছে। ইউরো ও কোপা আমেরিকা। করোনার জন্য পিছিয়ে যাওয়ায় একসঙ্গে হচ্ছে বিশ্ব ফুটবলের দুই মহারণ।


শুরুতে ইউরো কাপের গ্রুপ-এ নিয়ে একটু আড্ডা দিয়ে নেওয়া যাক। এই গ্রুপে রয়েছে ইতালি, তুরস্ক, ওয়েলশ ও সুইৎজারল্যান্ড। কারা এই গ্রুপে ফেভারিট, ট্রফি জয়ের দাবিদার কারা, কোন দল ঘটাতে পারে অঘটন, দেখে নিই।


ইতালি: প্রথমেই আসি ইতালির কথায়। গোটা বিশ্বের মতো বাংলাতেও আজ্জুরি (নীল জার্সি পরে খেলে বলে এই নামেও ইতালি ফুটবল দল পরিচিত)-দের অজস্র ফ্যান। হবে না-ই বা কেন! কী ফুটবল ঐতিহ্য দেশটার। চারবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। একবার ইউরো চ্যাম্পিয়ন। অলিম্পিক্সে সোনা জয় একবার। অথচ, সেই ইতালি গত বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি! যা অনেককেই হতবাক করে দিয়েছিল। ইতালি জুড়ে বিক্ষোভ চলেছিল। এবারের ইউরো কাপে ইতালি নামে খোঁচা খাওয়া বাঘের মতো। বিশ্বকাপের টিকিট না পাওয়া ইতালির ফুটবলারদের জাত্যাভিমানের ওপর আঘাত ছিল। সেই কলঙ্ক এবার মাঠের পারফরম্যান্স দিয়ে ভোলাতে চাইবে ইতালি। প্রমাণ করতে চাইবে, বিশ্বকাপে সুযোগ না পাওয়াটা নিতান্তই এক অঘটনের অধ্যায় ছিল।


কোচ রবের্তো মানচিনির অধীনে ইতালি ছক ভাঙা ফুটবল খেলছে। ইতালি বরাবর পরিচিত তাদের রক্ষণের জন্য। পাওলো মালদিনিদের দেশের ফুটবল দর্শনই ছিল, বিপক্ষকে নিজেদের অর্ধে দাঁত ফোটাতে দিও না। আর প্রতি আক্রমণে গিয়ে গোল করো। একটি গোলও করতে পারলে রক্ষণকে আরও দুর্ভেদ্য গড়ে তোলো। যদিও সেই ধারণার মূলে কুঠারাঘাত করেছেন মানচিনি। ফুটবল খেলার সময় যাঁকে আক্রমণাত্মক ফরওয়ার্ড হিসাবেই চিনত সকলে। কোচ হয়ে এসে আগ্রাসী ফুটবলে জোর দিয়েছেন। ফুটবল মাঠে একটা কথা আছে। যদি তোমার আক্রমণের ঝাঁঝ বেশি থাকে, তাহলে রক্ষণের দুর্বলতাও ঢেকে দেওয়া যায়। এক গোল খেলে তিন গোল দিয়ে আসা যায়। মানচিনির ইতালি ৪-৩-৩ ছকে খেলছে। ভীষণ আগ্রাসী স্ট্র্যাটেজি। আর এই ছকে খেলে টানা ১১ ম্যাচ জিতে নতুন রেকর্ড গড়েছে ইতালি।


ইতালির আক্রমণে রয়েছে লোরেঞ্জো ইনসিনিয়ের মতো ছন্দে থাকা তারকা। গোল করতে ও করাতে সমান পারদর্শী। সেই সঙ্গে থাকছেন চিরো ইমমোবিলে এবং ফেদেরিকো বের্নার্দেস্কি। মাঝমাঠে ভরসা মার্কো ভেরাত্তি। রক্ষণের অতন্দ্র প্রহরী লিয়োনার্দো বোনুচ্চি। গোলকিপার ছন্দে থাকা জানলুইজি দনারুমা। কোচ হিসাবে মানচিনি বলের দখল নিজেদের কাছে রেখে দেওয়ায় জোর দেন। যাতে প্রতিপক্ষ ক্রমশ ম্যাচ থেকে হারিয়ে যেতে থাকে। সেই সঙ্গে নিজেদের মধ্যে প্রচুর পাস খেলছে ইতালির এই নতুন দল। অনেকটা দেল বস্কের স্পেনের সেই বিখ্যাত তিকিতাকার মতো। সব মিলিয়ে এই গ্রুপ থেকে পরের পর্বে যাওয়ার ব্য়াপারে ফেভারিট ইতালি। ট্রফি কে জিতবে, সেটা এত আগে থেকে বলা বেশ কঠিন। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স রয়েছে, জার্মানি, গতবারের চ্যাম্পিয়ন পর্তুগাল রয়েছে। তবে ইতালি ইউরোপ সেরা হওয়ার অন্যতম দাবিদার।


তুরস্ক: এবারের ইউরো কাপে অনেক হিসেব নিকেশ বদলে দিতে পারে তুরস্ক। ঘটাতে পারে অঘটন। যে কারণে ডার্ক হর্স বলা হচ্ছে এই দলকে। ইতালির মতোই গত বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি তুরস্ক। তবে তাদের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হল দীর্ঘ প্রায় আড়াই দশক ধরে কোচ রয়েছেন শেনল গুনেস। সেই গুনেস, যাঁর প্রশিক্ষণে ২০০২ সালের বিশ্বকাপে তৃতীয় স্থান অর্জন করেছিল হাকান সুকুরদের তুরস্ক। এবার তাদের বড় ভরসা ফরাসি লিগ চ্যাম্পিয়ন লিলের ফুটবলার, অধিনায়ক বুরাক ইলমাজ়। এ ছাড়া ওজ়ান কাবাক, ইয়োকুসলু, হাকান চালানোলুর মতো ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ ও ইতালির সেরি আ-তে খেলা এক ঝাঁক ফুটবলার রয়েছে দলে। অনেক দলকেই বেকায়দায় ফেলতে পারে ইলমাজ়রা।


ওয়েলশ: ঠিক পাঁচ বছর আগের ইউরোতে দুরন্ত ফুটবল উপহার দিয়েছিল ওয়েলশ। বেলজিয়ামের মতো শক্তিশালী দলকে হারিয়ে সেমিফাইনালে উঠেছিল। শেষ চারের লড়াইয়ে পর্তুগালের কাছে পরাজিত হয়েছিল ওয়েলশ। শেষ পর্যন্ত পর্তুগালই চ্যাম্পিয়ন হয়। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে কতটা ভাল ফুটবল খেলেছিল ওয়েলশ। দলের দুই প্রধান ভরসা গ্যারেথ বেল ও অ্যারন রামজ়ি। ক্লাব ফুটবলে বেলকে হয়তো সেভাবে পাওয়া যায়নি এবার। টটেনহ্যামের হয়ে বলার মতো কিছু করে উঠতে পারেনি। তবে বড় প্লেয়াররা বড় মঞ্চে জ্বলে উঠতে জানে। বেলও ইউরো কাপে নিজেকে নতুন করে প্রমাণ করতে চাইবে। দলের কোচ রবার্ট পেজ় অভিজ্ঞ। যোগ্যতা অর্জন পর্বে ৮ ম্যাচের মধ্যে ৪টিতে জিতেছিল ওয়েলশ। ইউরো কাপের মূল পর্বেও চমক দিতে পারে।


সুইৎজ়ারল্যান্ড: যোগ্যতা অর্জন পর্বে দুরন্ত ছন্দে ছিল সুইৎজ়ারল্যান্ড। ৮ ম্যাচের মধ্যে ৫টিতে জিতেছিল। দলের সেরা তারকা 'আল্পসের মেসি' বলে খ্যাত জ়ার্দান শাকিরি। ঠিকানা লেখা পাস বাড়াতে সিদ্ধহস্ত গ্রানিট জ়াকা। জ়াকাই দলের অধিনায়ক। দলের কোচ ভ্লাদিমির পেতকোভিচ। গত ৯ মাসের মধ্যে জার্মানি, স্পেনের মতো বড় দলকে আটকে দিয়েছে সুইৎজ়ারল্যান্ড। ইউরো কাপেও বিনা যুদ্ধে এক ইঞ্চিও জমি ছাড়বে না তারা।


*সাক্ষাৎকারভিত্তিক অনুলিখন: সন্দীপ সরকার