কলকাতা: ফোনটা পেয়ে বেশ চমকে উঠেছিলেন জ্যোতির্ময়ী সিকদার। সালটা ১৯৯৮। এশিয়ান গেমসে ৮০০ ও ১৫০০ মিটারে জোড়া সোনা জিতে সবে ব্যাঙ্কক থেকে বাংলায় ফিরেছেন। তাঁকে ফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছিল গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বর। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতের জন্য শুভেচ্ছাও ভেসে এসেছিল ফোনের ওপার থেকে।


ফোন রেখেও যেন ঘোর কাটছিল না জ্যোতির্ময়ীর। কারণ, ফোনের ওপারে ছিলেন কিংবদন্তি অ্য়াথলিট। গোটা বিশ্ব যাঁকে চিনেছে 'ফ্লাইং শিখ' নামে। মিলখা সিংহ।


শুক্রবার রাতে করোনায় প্রয়াত হয়েছেন ভারতীয় অ্যাথলেটিক্স জগতের সর্বকালের সেরা তারকা। মিলখার প্রয়াণে মর্মাহত বাংলার কৃতী অ্যাথলিট। এবিপি লাইভকে জ্যোতির্ময়ী বললেন, 'আমি এশিয়ান গেমসে পদক জেতার পর উনি ফোন করেছিলেন। ওইরকম মাপের একজন ক্রীড়াবিদ নিজে থেকে ফোন করে অভিনন্দন জানাবেন, আমি ভাবতেই পারিনি। শুরুতে বিশ্বাসই হচ্ছিল না। মিলখা স্যার ফোনে খুব প্রশংসা করেছিলেন। পরে যখন নয়াদিল্লিতে দেখা হয়েছিল, বলেছিলাম, স্যার আমি জ্যোতির্ময়ী। উনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন, আরে! তোমাকে কে না চেনে। এতটাই মিশে যেতে পারতেন উনি।'


জ্যোতির্ময়ীর সঙ্গে দিল্লিতে বার তিনেক দেখা হয়েছিল মিলখার। তার মধ্যে একটা ছিল ২০০৬ সালে মেলবোর্ন কমনওয়েলথ গেমসের মশাল জ্বালানোর অনুষ্ঠান। জ্যোতির্ময়ী বলছেন, 'সেই সময়ে ওঁর সঙ্গে তোলা একটি ছবিও রয়েছে। এছাড়া যখন খেলতাম, তখন দিল্লি স্টেডিয়ামে একবার দেখা হয়েছিল। দুবারই কিছুক্ষণ কথা হয়েছিল মিলখা সিংহের সঙ্গে।'


মিলখার কীর্তি কেন ভারতীয় ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের দুনিয়ায় রূপকথা হয়ে রয়েছে, ব্যাখ্যা করছিলেন জ্যোতির্ময়ী। 'আমাদের জন্মের আগে অলিম্পিক্সে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। সেই সময় ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে ভাল কিছু করা আর আমাদের সময়ে বা বর্তমান প্রজন্মের করার মধ্যে তফাত রয়েছে। সেই সময় না ছিল উন্নত পরিকাঠামো বা ট্রেনিংয়ের ব্য়বস্থা, না ছিল আধুনিক মাঠ। খালি পায়ে দৌড়তেন উনি। তা সত্ত্বেও ওঁর কীর্তি অতুলনীয়,' বলছিলেন বাংলার সোনার মেয়ে। যোগ করলেন, 'অলিম্পিক্সে পি টি ঊষা দিদি ছাড়া ভারতের কেউই ফোর্থ হতে পারেননি। কমনওয়েলথ গেমসে প্রথম সোনার পদক মিলখা সিংহের। উনি যা করেছেন, এখনকার ছেলেমেয়েরা এত পরিকাঠামোর সুবিধা নিয়েও করে উঠতে পারেনি। উনি বারবার বলতেন যে, ভারতের হয়ে উনি নিজে অলিম্পিক্সে পদক পাননি। ভারতের কোনও অ্যাথলিট অলিম্পিক্সে পদক জিতছে সেটা দেখা ওঁর স্বপ্ন। কিন্তু সেই স্বপ্ন অপূর্ণ রেখেই চলে গেলেন মিলখা সিংহ।'


তাঁকে বাংলার উঠতি অ্যাথলিটদের অনেকেই নিজের আদর্শ মনে করেন। সেই জ্যোতির্ময়ী বলছেন, 'আমাদের প্রজন্মের কাছে তো দুজনই আদর্শ ছিলেন। মিলখা সিংহ ও পি টি ঊষা। দুজনই যা করে গিয়েছেন, সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যেভাবে লড়াই করে সফল হয়েছেন, ওঁদের সেলাম জানাতেই হয়। আমাদের কাছে যতই দুটো পদক থাকুক, ওঁরা গ্রেট।' 


তবে জ্যোতির্ময়ী মনে করেন, আরও সম্মান প্রাপ্য ছিল মিলখার। বলছিলেন, 'মিলখা পদ্মশ্রী পেয়েছিলেন। তবে আমার মনে হয় দেশের সরকারের উচিত ছিল ওঁকে আরও সম্মান দেওয়া। তরুণ প্রজন্ম তো ওঁকে চিনেছে, ওঁর কথা জেনেছে 'ভাগ মিলখা ভাগ' সিনেমা দেখে। আমার একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। ট্রেনে করে মুর্শিদাবাদের দেবগ্রামে যাচ্ছিলাম। সেই ট্রেনে স্কুলের কিছু বাচ্চা ছিল। তারা নিজেদের মধ্যে বলছিল, ভাগ মিলখা ভাগ। আমার খুব ভাল লেগেছিল। ওইটুকু বাচ্চাগুলোও জেনে গিয়েছে মিলখা সিংহ কে। সিনেমার মধ্যে দিয়ে এখনকার ছেলেমেয়েরা তো তবু ওঁকে চিনছে। আমাদের সময় এভাবে চেনার সুযোগ ছিল না। কতজনের বাড়িতেই বা টিভি ছিল! মিলখা সিংহের সিনেমা তো তখন আমরা দেখিনি। আমরা জাতীয় শিবিরে গিয়ে বা দেশের অন্যান্য অ্য়াথলিটদের মুখে শুনে ওঁর কথা জেনেছি।'