আলমোড়া: এ যেন পদকজয়ীর চোখে পদকজয়ীর গল্প। কথায় আছে রতনে রতন চেনে। বয়সে ১০ বছরের ব্যবধান থাকলেও ঠিক বুঝতে পারছিলেন যে এই ছেলে একদিন রাজ্য ও দেশের নাম উজ্জ্বল করবে। খুব কাছ থেকে লক্ষ্য সেনকে দেখেছেন। দেখেছেন ছোট্ট লক্ষ্যর (Lakshya Sen) কড়া অনুশাসনে বেড়ে ওঠা। নিজে প্যারালিম্পিক্সে গতবছরই দেশকে ব্রোঞ্জ এনে দিয়েছেন। তিনি উত্তরাখণ্ডের প্রবাসী বাঙালি মনোজ সরকার (manoj sarkar)। আর গতকাল তাঁরই রাজ্যের আরেক উদীয়মান ব্যাডমিন্টন তারকা লক্ষ্য বিশ্বচ্যাম্পিয়নকে হারিয়ে ইন্ডিয়ান ওপেন খেতাব জিতেছেন। প্রথমবার এই টুর্নামেন্টে নামলেন বছর কুড়ির লক্ষ্য। আর অভিষেকেই বাজিমাত। কিন্তু কীভাবে? এবিপি লাইভকে একান্ত সাক্ষাৎকারে সেই গল্পই শোনালেন মনোজ --
ফোনের ওপারে কথা বলতে গিয়ে খুশি ঝড়ে পড়ছিল টোকিও প্যারালিম্পিক্সে ব্রোঞ্জজয়ী ব্যাডমিন্টন তারকার গলায়। মনোজ বলছেন, ''সালটা ঠিক মনে নেই, তখন লক্ষ্যর বয়স খুব বেশি হলে ১০ হবে। ওর বাবা ডি কে সেন স্যারের কোচিং সেন্টারে গিয়েছিলাম আমরা কয়েকজন। সেখানকার প্র্যাকটিস দেখতে। বেঞ্চে বসে তখন লক্ষ্য। পাশে ওই অ্যাকাডেমিরই এক ছাত্রী। ওর থেকে বেশ খানিকটা বড়ই হবে হয়ত। হঠাৎ দেখি ডি কে সেন স্যার কাছে গিয়ে ওই ছাত্রীকে বললেন, লক্ষ্য যেন কোনোভাবেই ঘুমিয়ে না পড়ে। দরকারে চোখে জলের ঝাপটা দিতে হবে, কিন্তু ওকে জেগে থেকে পুরো প্র্যাকটিস দেখতে হবে। এতটাই কড়া ছিলেন উনি।''
কিছুটা থেমে মনোজ আরও বলেন, ''আমাদের এখানে পাহাড় এলাকা। ভোরবেলা এখানে ওঠা ভীষণ চাপের। কিন্তু সেন স্যার এতটাই কড়া ছিলেন যে রোজ ভোর ৪.৩০টেয় উঠে ছেলেকে কোর্টে নামিয়ে দিতেন। বাড়ির সামনেই উনি চিরাগ (লক্ষ্য সেনের দাদা) ও লক্ষ্যর অনুশীলনের জন্য কোর্ট তৈরি করেছিলেন। এমনকী একটা ঘটনা তো আমাকে অবাক করে দিয়েছিল। শারীরিক ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ও পেশি আরও শক্তিশালী করতে সেন স্যার বাইকে উঠে পাহাড়ি রাস্তায় লক্ষ্যকে বলতেন সেই বাইক ঠেলতে। কায়িক পরিশ্রমের কোনো বিকল্প হয় না। সেন স্যারের থেকেই পরিশ্রম, অধ্যাবসায়ের পাঠ পেয়েছিল ও।''
কথা যেন থামতেই চাইছিল না বছর ত্রিশের মনোজের। তাঁর সঙ্গে কোনো বিশেষ মুহূর্ত? দেশের অন্যতম সেরা প্যারালিম্পিয়ান বলেন, ''লক্ষ্য ভীষণ লাজুক স্বভাবের ছেলে। নিজের খেলা নিয়েই ব্যস্ত থাকে ও। বেশি কারও সঙ্গে কোনও কথা বলে না। আমার সঙ্গে খুব বেশি কথা হয়নি, কারণ অনেক বছর ধরেই ও প্রকাশ পাড়ুকোনের অ্যাকাডেমি থেকেই অনুশীলন করে। ফলে এখানে থাকে না। তবে আমি প্যারালিম্পিক্সে পদক জয়ের পর ফোন করে শুভেচ্ছা জানিয়েছিল। সবাইকে সম্মান করে। খুব ভাল ছেলে। মাটিতে পা থাকুক ওর, এটাই চাইব। আমি আশাবাদী একদিন ব্যাডমিন্টনে অলিম্পিক্সে মেডেলও আসবে ওর হাত ধরে।''
মাত্র ২০ বছর বয়সেই ব্যাডমিন্টনে যে বিক্রম দেখিয়েছেন লক্ষ্য তাতে একটুও অবাক নন মনোজ। ফোন রাখার আগে তিনি বলেন, ''হার কোনওভাবেই মানতে পারে না ও। ২০০৮-০৯ সালে একবার লক্ষ্য স্টেট সিনিয়র লেভেলে খেলতে নেমেছিল। সবাই ওর থেকে ১২-১৪ বছরের বড়। কিন্তু ওইটুকু বয়সেও দুর্দান্ত রিফ্লেক্স, পায়ের মুভমেন্ট দেখে আমরা অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। মনে আছে একটা ম্যাচে হেরে যাওয়ার পর অঝোরে কেঁদে ফেলেছিল ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরে। সেই ছবিটা এখনও আমার চোখের সামনে ভাসে। এগিয়ে চলার পথে এই খিদেটাই তো দরকার।''