কলকাতা: চোট-আঘাতের সমস্যায় জর্জরিত এটিকে মোহনবাগান। তবু ঘরের মাঠে অসাধারণ ও উজ্জীবিত ফুটবল খেলে এফসি গোয়াকে ২-১-এ হারিয়ে প্রথম লেগের হারের বদলা নিয়ে নিল তারা। দলের এই অবস্থা, যেখানে প্রায় চল্লিশ শতাংশ ফুটবলার চোট-আঘাতে স্কোয়াডের বাইরে, সেখানে এফসি গোয়ার মতো লড়াকু দলকে হারিয়ে লড়াইয়ে ফিরে আসাটা অবশ্যই কৃতিত্বে দাবি করতে পারে। বুধবার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে এই অসাধারণ জয়ের ফলে লিগ টেবলের তিন নম্বরে উঠে এল গতবারের সেমিফাইনালিস্টরা। এফসি গোয়া রয়ে গেল পাঁচেই।


একটি গোল করে ও অপর গোলে অ্যাসিস্ট করে এ দিন যথাযথ ভাবেই ম্যাচের নায়কের পুরস্কার জিতে নেন অস্ট্রেলীয় অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার তথা ফরোয়ার্ড দিমিত্রিয়স পেট্রাটস। ন’মিনিটের মাথায় তাঁর গোলেই এগিয়ে যায় এটিকে মোহনবাগান। ২৫ মিনিটে আনোয়ার আলির গোলে এফসি গোয়া সমতা আনলেও ৫২ মিনিটের মাথায় হুগো বুমৌসের গোল জয় এনে দেয় তাদের। পেট্রাটস ও আশিক কুরুনিয়ান আরও দু’টি গোলের সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া না করলে ম্যাচটা হয়তো আরও বড় ব্যবধানে জিততে পারত তারা। তবে বুধবার প্রায় সারা ম্যাচে দুই দলই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে (নীচের পরিসংখ্যান দেখুন)।


চোট-আঘাতের সমস্যার জন্য যেখানে পছন্দের প্রথম এগারো তৈরি করাই কঠিন হয়ে ওঠে এটিকে মোহনবাগান কোচ হুয়ান ফেরান্দোর পক্ষে, সেখানে এমন এক জয় সমর্থকদের কাছে নতুন বছরের আগে সেরা চমক ও সেরা উপহার বলা যেতেই পারে।


এ দিন হুগো বুমৌসকে এটিকে মোহনবাগানের প্রথম এগারোয় দেখা যায় কিছুটা অপ্রত্যাশিত ভাবেই। কাঁধের চোট সারিয়ে তিনি মাঠে ফেরেন এবং তাঁর উপস্থিতিই ম্যাজিকের মতো কাজ করে। মাঝমাঠে তাঁর সঙ্গে দেখা যায় অভিজ্ঞ প্রণয় হলদারকেও, যিনি এ বারের লিগে এর আগে সব মিলিয়ে এক মিনিট মাঠে থাকার সুযোগ পেয়েছেন। এ ছাড়া দলে আর কোনও পরিবর্তন হয়নি। গত ম্যাচে চোট পাওয়া আশিক কুরুনিয়ানও শুরু থেকে খেলেন এবং যথেষ্ট ভাল পারফরম্যান্স দেখান। তিন ব্যাকে শুরু করে তারা। এফসি গোয়ার প্রথম এগারোয় এ দিন আলভারো ভাস্কেজ ছিলেন। গোয়ার ৪-২-৩-১ ছকে তিনিই ছিলেন সবার আগে। তাঁর পিছনে ব্রেন্ডন ফার্নান্ডেজ, ইকার গুয়ারৎজেনা ও রেডিম তলাং।


শুরু থেকেই বিপক্ষকে চাপে রাখার প্রবণতা দেখা যায় এটিকে মোহনবাগানের খেলায়। পাঁচ মিনিটের মাথাতেই বক্সের মাথা থেকে নেওয়া বুমৌসের শট গোলের বাইরে চলে যায়। শুরু থেকেই সবুজ-মেরুন শিবিরের খেলোয়াড়দের মধ্যে যে ছটফটানি লক্ষ্য করা যায়, তাতে মনেই হচ্ছিল, তারা শুরুতেই একটি গোল তুলে নিতে চায় এবং নবম মিনিটেই সেই আকাঙ্খিত গোলটি পেয়ে যান দিমিত্রিয়স পেট্রাটস।


লিস্টন কোলাসোর থ্রো থেকে বল পেয়ে ডানদিক দিয়ে উঠে বক্সের ডানদিক থেকে প্রায় ৪৫ ডিগ্রি কোণ থেকে পেট্রাটস শট নেন গোলে। নিজের বাঁদিকে ঝাঁপান গোয়ার গোলকিপার ধীরজ কুমার। তাঁর হাতে লেগে বল প্রথম পোস্ট দিয়ে গোলে ঢুকে যায় (১-০)। 


গোল খাওয়ার পর এফসি গোয়া গোল পজেশন বাড়িয়ে খেলার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করলেও ব্যবধান বাড়ানোর চেষ্টায় ছিল এটিকে মোহনবাগান। ১৮ মিনিটের মাথায় তার সুবর্ণ সুযোগ পেয়েও যায় তারা। ডানদিক দিয়ে ওঠা লিস্টন কোলাসোর ব্যাকহিলে বল পেয়ে গোলের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েও আশিস রাই গোলের সামনে আশিক কুরুনিয়ানের উদ্দেশ্যে বল বড়ালেও প্রতিপক্ষের রক্ষণের তৎপরতায় বলে পৌঁছতে পারেননি তিনি। এর পরের মিনিটেই বক্সের মাথা থেকে বুমৌস গোলে শট নেওয়ার আগেই তাঁর পা থেকে বল কেড়ে নেন এডু বেদিয়া।


এক গোলের ব্যবধান অবশ্য বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারেনি এটিকে মোহনবাগান। এফসি গোয়া প্রতিপক্ষকে সে ভাবে পাল্টা চাপে ফেলতে না পারলেও সেট পিস থেকে সমতা এনে ফেলে ২৫ মিনিটের মাথায়। ডানদিকের উইং থেকে নেওয়া ফ্রিকিকে পায়ে টোকা দিয়ে হিরো আইএসএলে তাঁর প্রথম গোলটি করেন পঞ্জাব থেকে উঠে আসা এফসি গোয়ার সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার আনোয়ার আলি (১-১)।


সমতা আনার পর থেকে এফসি গোয়া আক্রমণে ধার বাড়ায় এবং ঘন ঘন বিপক্ষের রক্ষণকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয়। এর মধ্যেও অবশ্য তাদের বক্সের সামনে বিপজ্জনক জায়গা থেকে ফ্রিকিক পেয়ে যায় সবুজ-মেরুন ব্রিগেড। কিন্তু সোজাসুজি শটে গোলে বল রাখার উদ্দেশ্যে নেওয়া কোলাসোর শট বারের অনেক ওপর দিয়ে বেরিয়ে যায়। গত মরশুমেও কোলাসোর কাছ থেকে এই ধরনের শটে একাধিক গোল দেখা গিয়েছিল। কিন্তু এ বার আর সেগুলো ক্লিক করছে না। এর মিনিট ছয়েক পরে ফের একই জায়গায় ফ্রি কিক পায় তারা। কিন্তু এ বার কোলাসো ডামি দেওয়ার পর পেট্রাটসের শট ধাক্কা মারে মানবপ্রাচীরে।


প্রথমার্ধের শেষ দিকে দেখা যায় বুমৌস, পেট্রাটস, কোলাসোরা একাধিক আক্রমণে তৈরির চেষ্টা করলেও তাঁদের সতীর্থরা ঠিকমতো জায়গাতেই পৌঁছতে পারেননি। হয় ফিটনেসের সমস্যা, নয় ক্লান্তি তাদের বারবার স্লথ করে দেয়। কোলাসোকেও প্রথমার্ধে তাঁর নিজের প্রিয় জায়গা বাঁ দিকের উইং ছেড়ে ডানদিক থেকে খেলতে দেখা যায়। যার ফলে তিনিও ততটা স্বচ্ছন্দে ছিলেন না। প্রথমার্ধে দুই দলই একটি করে শট গোলে রাখে। দুই দলের মধ্যেই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়। তবে এফসি গোয়া সমতা আনার আগে পর্যন্ত আধিপত্য ছিল এটিকে মোহনবাগানেরই।


নির্ধারিত সময়ের শেষ পাঁচ মিনিট ও চার মিনিটের বাড়তি সময়ে সমতা ফেরাতে মরিয়া হয়ে ওঠে গোয়া। কিন্তু ততক্ষণে নিজেদের গোলের সামনে কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তোলে এটিকে মোহনবাগান ডিফেন্ডাররা। শেষ বাঁশি বাজার পরে সমর্থকদের উল্লাস দশগুন বাড়িয়ে নিজেরাও হাসিমুখেই মাঠ ছাড়েন সবুজ-মেরুন তারকারা।


এটিকে মোহনবাগান দল: বিশাল কয়েথ (গোল), আশিস রাই, প্রীতম কোটাল (অধি), ব্রেন্ডান হ্যামিল, শুভাশিস বোস, কার্ল ম্যাকহিউ, প্রণয় হালদার (লেনি রড্রিগেজ), হুগো বুমৌস (লালরিনলিয়ানা হ্নামতে), আশিক কুরুনিয়ান, লিস্টন কোলাসো, দিমিত্রিয়স পেট্রাটস।