কলকাতা: কলকাতার ফুটবলে যে তারা চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী, রবিবার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে মহমেডান স্পোর্টিং ও ইস্টবেঙ্গল এফসি-র (Mohammedan Sporting vs East Bengal) দ্বৈরথ দেখে তা আরও একবার বোঝা গেল। ইস্টবেঙ্গলের ৩-১-এ জয় দেখে হয়তো কেউ বলবে না খেলাটা দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দলের মধ্যে ছিল। তবে ইতিহাস জানে সে কথা। কলকাতা শহর তথা সারা বাংলা জানে দুই ক্লাবের দ্বৈরথের ইতিহাস। সেই কলকাতা ডার্বির চিরপ্রতিদ্বন্দ্বিতা ফের দেখা গেল মাঠে এবং সেই ডার্বি জিতেই চলতি আইএসএলে জয়ে ফিরে এল ইস্টবেঙ্গল। ইন্ডিয়ান সুপার লিগে এই প্রথম কলকাতা ডার্বি জিতল লাল-হলুদ বাহিনী।
রবিবার কলকাতার দুই দলের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে ২৭ মিনিটের মাথায় নাওরেম মহেশের অনবদ্য গোলে এগিয়ে যায় ইস্টবেঙ্গল। দ্বিতীয়ার্ধে এই ব্যবধান বাড়িয়ে নেন স্প্যানিশ মিডিও সউল ক্রেসপো। তবে এর তিন মিনিট পরেই ব্যবধান কমান মহমেডানের ব্রাজিলীয় স্ট্রাইকার কার্লোস ফ্রাঙ্কা, যিনি বহু চেষ্টার পর গোল পেলেন। কিন্তু ইস্টবেঙ্গল যে এক গোলের ব্যবধানে জয়ে সন্তুষ্ট নয়, তা বুঝিয়ে দেয় তারা এবং ৮৯ মিনিটের মাথায় ডেভিড লালনসাঙ্গা তাঁর প্রাক্তন ক্লাবের বিরুদ্ধে গোল করে জয় সুনিশ্চিত করেন।
এ দিন বাংলার ফুটবলপ্রেমীদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি অবশ্যই বাংলার ফরোয়ার্ড রবি হাঁসদার দুর্দান্ত আইএসএল অভিষেক। এ দিন ৫৯ মিনিটে রিজার্ভ বেঞ্চ থেকে নেমে মনে রাখার মতো পারফরম্যান্স দেখান সন্তোষ ট্রফিজয়ী দলের এই বঙ্গ তারকা। এ দিন মহমেডানের একমাত্র গোলে ফ্রাঙ্কাকে অ্যাসিস্ট করেন তিনিই। গোলের সুযোগও তৈরি করেন তিনি এবং একটি অবধারিত গোলের সুযোগ পেয়েও তা হাতছাড়া করেন রবি। আধ ঘণ্টার এই পারফরম্যান্সেই এ দিন তিনি বুঝিয়ে দেন, সুযোগ পেলে আরও অনেক কিছু করে দেখাতে পারেন তিনি।
দুই দলই এ দিন হাফ ডজন করে শট গোলে রাখে। কিন্তু সুযোগকে গোলে পরিণত করার ক্ষেত্রে বরাবরই পিছিয়ে মহমেডান এ দিনও চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে অনেকটাই পিছিয়ে থাকায় এ দিনও জয়ের ঠিকানা খুঁজে পাওয়া হল না তাদের। এই নিয়ে টানা পাঁচটি ম্যাচে জয়হীন রইল তারা। অন্যদিকে গত দুই ম্যাচে জয়হীন থাকার পর এ দিন জয়ে ফিরল ইস্টবেঙ্গল। ছ’নম্বর জয়ের পর ২০ ম্যাচে ২১ পয়েন্ট অর্জন করল তারা।
এ দিন চারটি পরিবর্তন করে প্রথম এগারোয় নামায় মহমেডান স্পোর্টিং। দলে ফেরেন গোলকিপার পদম ছেত্রী, মনবীর সাইনি, আদিঙ্গা ও বিকাশ সিং তাদের প্রথম দলে ফেরেন। অন্য দিকে, ইস্টবেঙ্গলও চারটি পরিবর্তন করে প্রথম দলে। আনোয়ার আলি, নন্দকুমার শেকর, শৌভিক চক্রবর্তী ও রাফায়েল মেসি বৌলিকে দেখা যায় প্রথম দলে। সউল ক্রেসপোকে রিজার্ভ বেঞ্চে দেখা গেলেও রিচার্ড সেলিস সেখানে ছিলেন না। দিয়ামান্তাকস ও মেসি বৌলিকে সামনে রেখে লাল-হলুদ বাহিনী ৪-৪-২-এ খেলা শুরু করলেও ফ্রাঙ্কা, মনবীর সাইনি ও ফানাইকে সামনে রেখে ৪-৩-৩ ছকে দল সাজায় মহমেডান।
এ দিন ম্যাচের পঞ্চম মিনিটেই ইস্ট বেঙ্গল এফসি-কে এগিয়ে দেওয়ার সুযোগ তৈরি করেন পিভি বিষ্ণু। রাফায়েল মেসি বৌলির কাছ থেকে পাওয়া বল বক্সের বাঁ দিকে পান তিনি। যথেষ্ট সময় পেয়েও সঠিকভাবে লক্ষ্যভেদ করতে পারেননি বিষ্ণু। তাঁর শট বারের বাঁ দিকে অনেক উঁচু দিয়ে উড়ে যায়।
অন্যদিকে, আট মিনিটের মাথায় ফ্রাঙ্কা পাল্টা আক্রমণ করেন। জো জোহেরলিয়ানার সঙ্গে দ্রুত একসঙ্গে উঠে বক্সের বাঁ দিকে বল পান তিনি। তবে তাঁর ফাইনাল শটটি বাঁ দিকের পোস্ট ঘেঁষে বাইরে চলে যায়।
ফাইনাল থার্ডে এ দিন বেশ সক্রিয় ছিলেন ক্যামেরুনের নবাগত স্ট্রাইকার মেসি বৌলি এবং ১৫ মিনিটের মাথায় দিমিত্রিয়স দিয়ামান্তাকসকে একটি নিখুঁত ক্রস বাড়ান তিনি। বক্সের মাঝামাঝি জায়গায় সেই ক্রস পেলেও তা গোলের বাইরে মারেন দিয়ামান্তাকস।
তবে, ২৭তম মিনিটে বিষ্ণু তাঁর আক্রমণাত্মক ফুটবলকে কাজে লাগান, নাওরেম মহেশ সিংকে গোলে সাহায্য করে। মহেশকে লক্ষ্য করে অসাধারণ মাপা ফাইনাল পাস বাড়ান বিষ্ণু। মহেশ কঠিন কোণে চলে গিয়েও বাঁ পায়ে গোলে শট নেন, যা রোখা সম্ভব হয়নি গোলকিপারের পক্ষে (১-০)। এই গোলটিই ছিল প্রথমার্ধে ইস্টবেঙ্গল এফসি-র আধিপত্যের প্রতিফলন।
মহমেডান স্পোর্টিং যেন ব্যাকফুটে না থাকে, দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই তা নিশ্চিত করেন মার্ক শ্মেরবক। ৪৬ মিনিটের মাথায় তিনি ফ্রাঙ্কার উদ্দেশ্যে নিখুঁত একটি বল বাড়ান, যেটি ফ্রাঙ্কা বক্সের ঠিক মাঝখানে পান। কিন্তু ইস্টবেঙ্গল এফসি-র রক্ষণভাগ দ্রুত নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে ফ্রাঙ্কার শটটি ব্লক করে দেয়।
ম্যাচের ৬১তম মিনিটে নন্দকুমার শেকরের বদলে সউল ক্রেসপোকে মাঠে নামান ইস্টবেঙ্গল এফসি-র হেড কোচ অস্কার ব্রুজন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তাঁর এই সিদ্ধান্তের সুফল পেয়ে যায় দল। মাত্র চার মিনিটের মধ্যেই গোলের সন্ধান পান ক্রেসপো। বক্সের মাঝখানে ফাঁকা জায়গায় দাঁড়ানো সাউলকে লক্ষ্য করে ক্রস পাঠান মেসি বৌলি এবং নিখুঁতভাবে ডান পায়ের নীচু শটে গোলের বাঁদিকের কোণ দিয়ে জালে জড়িয়ে দেন ক্রেসপো (২-০)।
দু-গোল খাওয়ার পর আক্রমণের তীব্রতা বাড়াতে থাকে মহমেডান স্পোর্টিং এবং ৬৮তম মিনিটে ফ্রাঙ্কার মাধ্যমে গোলের দেখা পায় তারা। ইস্টবেঙ্গল এফসি সাময়িকভাবে ছন্দ হারালে দ্রুত কিছু পাস খেলে তাদের রক্ষণে চিড় ধরায় মহামেডান স্পোর্টিং। রবি হাঁসদা একটি নিখুঁত পাস বাড়ান ফ্রাঙ্কার উদ্দেশ্যে, যিনি বলটি নীচু শটে গোলে পাঠিয়ে ব্যবধান কমিয়ে আনেন (২-১)।
তবে ফ্রাঙ্কার গোলের পরও তারা ছন্দ হারায়নি এবং আরেকটি গোলের সুযোগ খুঁজতে থাকে ইস্টবেঙ্গল এফসি। ম্যাচের শেষ মুহূর্তে জয় নিশ্চিত করার জন্য স্বস্তিদায়ক গোল আদায় করে নেয় তারা। রিজার্ভ বেঞ্চ থেকে নামা ডেভিড লালনসাঙ্গার গোলে একটি অসাধারণ ও নিখুঁত অ্যাসিস্ট করেন প্রভাত লাকড়া। বক্সের মাঝখানে বল পেয়ে বাঁ পায়ের দুর্দান্ত নীচু শটে বল গোলে পাঠিয়ে জয় নিশ্চিত করেন মহমেডানের এই প্রাক্তন তারকা (৩-১)।
(তথ্য: আইএসএল মিডিয়া)
আরও পড়ুন: এখনও জাতীয় দলের প্রথম পছন্দ নয়, তবে আইএসএলে জানুয়ারির সেরা খেলোয়াড় বিশালই