কলকাতা: ইন্ডিয়ান সুপার লিগের (ISL) ২০২৪-২৫ মরশুম ইস্টবেঙ্গল এফসির (East Bengal FC) পক্ষে আরও একটি চ্যালেঞ্জিং বছর হয়ে ওঠে। ইতিবাচক প্রত্যাশা ও শক্তিশালী দল নিয়ে কলকাতার ক্লাবটি গত কয়েক বছরের ব্যর্থতা কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্য নিয়ে এ বারের আইএসএলে নেমেছিল। মরশুম শুরুর আগে থেকেই দলের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়দের ধরে রেখে ও ভাল পারফর্মারদের দলে অন্তর্ভুক্ত করে ভাল খেলার সংকল্প ছিল তাদের। গত মরশুমের গোল্ডেন বুট বিজয়ী ও সর্বোচ্চ অ্যাসিস্টদাতা ফুটবলারদের সই করানোয় সমর্থকদের প্রত্যাশা বেড়ে যায়। জিকসন সিং এবং ডেভিড লালনসাঙ্গার অন্তর্ভুক্তি দলকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। এবং শেষ মুহূর্তে আনোয়ার আলির আগমন দলের রক্ষণ বিভাগকেও স্থিতিশীল করার পক্ষে ছিল যথেষ্ট।

কিন্তু শক্তিশালী দল থাকা সত্ত্বেও ইস্টবেঙ্গল তাদের আইএসএল অভিযান শুরু করে টানা ছ’টি পরাজয়ের মাধ্যমে। এই ব্যর্থতার ফলে সুপার কাপজয়ী কোচ কার্লস কুয়াদ্রাতকে অব্যহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ক্লাব কর্তৃপক্ষ। অক্টোবরের মাঝামাঝি এএফসি চ্যালেঞ্জ লিগের নকআউট পর্বে জায়গা করে নিয়ে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে শুরু করে ইস্টবেঙ্গল। এই ধারাবাহিকতা তারা লিগেও ধরে রাখার চেষ্টা করে এবং বছরের শেষ দিকে ইতিবাচক পারফরম্যান্স দেখায়।

তবে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়দের চোট মরশুমের এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তাদের বড় ধাক্কা দেয়। জানুয়ারিতে দল মাত্র ১৫ পয়েন্টের মধ্যে চার পয়েন্ট অর্জন করে, যা তাদের অবস্থান বেশ দুর্বল করে দেয়। ফেব্রুয়ারির শুরুতে ঘরের মাঠে চেন্নাইন এফসির বিরুদ্ধে বড় হার তাদের সমস্যা আরও জটিল করে তোলে। যদিও মরশুমের শেষ দিকে টানা তিনটি জয়ে প্লে-অফের আশার আলো দেখা দেয়, তবে বেঙ্গালুরু এফসির বিপক্ষে ঘরের মাঠে ড্র করার ফলে সেই আশা শেষ হয়ে যায়।

ইতিবাচক দিক

যদিও এ মরশুম তাদের পক্ষে হতাশাজনক ছিল, তবে কিছু ভাল মুহূর্তও কাটিয়েছে তারা। ইস্টবেঙ্গল তাদের ঘরের মাঠে তুলনামূলক ভাবে ভাল খেলেছে। কলকাতায় তারা পাঁচটি জয় ও ১৭ পয়েন্ট সংগ্রহ করে। ডেভিড লালনসাঙ্গা ও পিভি বিষ্ণুর মতো তরুণ খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্স ভবিষ্যতের জন্য আশা জাগিয়েছে। এখন তাদের লক্ষ্য সুপার কাপে নিজেদের খেতাব রক্ষা করা এবং কঠিন মরশুম থেকে অন্তত ভাল কিছু অর্জন করা।


নেতিবাচক দিক

এ মরশুমে শৃঙ্খলাজনিত সমস্যা ইস্টবেঙ্গল এফসির পক্ষে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। দলটি ৫৯টি হলুদ কার্ড ও ১০টি লাল কার্ড দেখেছে, যা আইএসএল ইতিহাসে এক মরশুমে সর্বোচ্চ লাল কার্ডের এক নজির। বেঙ্গালুরু এফসির বিপক্ষে মরশুমের প্রথম ম্যাচ থেকে শুরু করে এএফসি চ্যালেঞ্জ লিগের কোয়ার্টার-ফাইনাল পর্যন্ত, গুরুত্বপূর্ণ সময়ে লাল কার্ড দলকে বিপদে ফেলে।

এছাড়া, বেশি গোলের সুযোগ তৈরি করতেও ব্যর্থ হয়েছে লাল হলুদ বাহিনী। সারা লিগে তারা মাত্র ২১১টি সুযোগ তৈরি করতে পেরেছে, যা আইএসএল-এর তৃতীয় সর্বনিম্ন। গত পাঁচ মরশুমে গোলের সুযোগ তৈরির দিক থেকে নিচের তিন দলের মধ্যে অবস্থান করছে তারা। আক্রমণ বিভাগ শক্তিশালী করতে হলে এই সমস্যার সমাধান করতেই হবে।

সেরা খেলোয়াড়: পিভি বিষ্ণু

এ মরশুমে ইস্টবেঙ্গলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন পিভি বিষ্ণু। তিনি ২২টি ম্যাচ খেলেন, যার মধ্যে ১৬টিতে প্রথম একাদশে ছিলেন। মাঝমাঠ থেকে একাধিক আক্রমণে অবদান রেখেছেন বিষ্ণু। চারটি গোল করার পাশাপাশি তিনটি অ্যাসিস্ট করেন। তাঁর পাসিং অ্যাকিউরেসি ছিল ৭২%, গড়ে প্রতি ম্যাচে ১৭টি সফল পাস দেন। তাঁর পারফরম্যান্স ইস্টবেঙ্গলের পক্ষে অন্যতম ইতিবাচক দিক ছিল।

সেরা তরুণ খেলোয়াড়: ডেভিড লালনসাঙ্গা

২৩ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ড এ মরশুমে ইস্টবেঙ্গলের অন্যতম সেরা অ্যাটাকার। মাত্র ৫৬৮ মিনিট খেলে তিনি চারটি গোল করেন, যা তাঁকে ক্লাবের সর্বোচ্চ ভারতীয় গোলদাতার আসনে বসায়। মহমেডান এসসি থেকে ইস্টবেঙ্গলে যোগ দেওয়ার পর এটি তার প্রথম আইএসএল মরশুম। নিজের দক্ষতা প্রমাণ করেছেন ডেভিড। তাঁর পাসিং অ্যাকিউরেসি ৮১% এবং চারটি গুরুত্বপূর্ণ গোলের সুযোগ তৈরি করেন তিনি। তাঁর ফিনিশিং দক্ষতা ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা তাঁকে ভবিষ্যতের জন্য ক্লাবের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

আগামী মরশুমে যা প্রয়োজন

ইস্টবেঙ্গল এফসিকে তাদের দুর্বলতা কাটিয়ে একটি শক্তিশালী দল গঠন করতে হবে। দলটিতে প্রতিভার অভাব নেই, তবে কৌশলগত পরিকল্পনা, রক্ষণভাগের স্থিতিশীলতা এবং আরও আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলার দিকে নজর দিতে হবে। কোচ অস্কার ব্রুজোনের ভবিষ্যৎ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে ক্লাবকে এবং পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে সঠিক খেলোয়াড়দের ধরে রাখার সিদ্ধান্তও খুবই গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে। গত দুই মরশুমে চোট-আঘাতের জন্য দল বারবার ব্যাকফুটে চলে যায়। তাই স্কোয়াডের গভীরতা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। শক্তিশালী দল গঠন করে সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী পারফরম্যান্স দেখাতে পারলে ইস্টবেঙ্গল আগামী মরশুমে ক্লাবের ঐতিহ্য ও ইতিহাসের প্রতি সুবিচার করতে পারবে, এমনই আশা করা যায়।


পরিসংখ্যান

ম্যাচ: ২৪ | জয়: ৮ | পরাজয়: ১২ | ড্র: ৪ | পয়েন্ট: ২৮ | গোল করেছে: ২৭ | গোল হজম করেছে: ৩৩ (সৌ: আইএসএল মিডিয়া)