গুয়াহাটি: চার দিন আগে সৌদি আরবের আভা থেকে এক পয়েন্ট নিয়ে ফেরার পর এবার ঘরের মাঠে ভারতের প্রয়োজন পুরো তিন পয়েন্ট। কিন্তু তিন পয়েন্ট পেতে গেলে গোল করতেই হবে ইগর স্তিমাচের (Igor Stimac) দলকে। মঙ্গলবার গুয়াহাটির ইন্দিরা গাঁধী অ্যাথলেটিক স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপ (এশীয়) বাছাই পর্বের দ্বিতীয় রাউন্ডের ম্যাচে এই মহার্ঘ্য গোল পাওয়াই ভারতের (Indian Football Team) কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে এখন।


গত পাঁচ ম্যাচে গোলহীন ভারতীয় দলের ফরওয়ার্ড ও উইঙ্গাররা সব কিছু করলেও প্রতিপক্ষের গোলের দরজা খুলতে পারছেন না, এটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা তাদের। গত জানুয়ারিতে কাতারে তিনটি ম্যাচের মধ্যে একটিতেও গোল করতে পারেনি তারা। তার আগে নভেম্বরে কাতারের বিরুদ্ধে এই বাছাই পর্বের ম্যাচেও কোনও গোল পায়নি ভারত। আর গত ম্যাচে গোলশূন্য ড্রয়ের কথা তো এখন সবারই মনে আছে। এই গোলখরাই এখন ভারতীয় দলের সবচেয়ে বড় শত্রু, যা না কাটিয়ে উঠতে পারলে ভারতের পক্ষে জয়ে ফেরাও অসম্ভব।


জীবনের ১৫০তম আন্তর্জাতিক ম্যাচকে স্মরণীয় করে রাখতে সুনীল ছেত্রী এই ম্যাচে কী করবেন, সেটাও একটা আকর্ষণীয় দিক। গত এক বছরে দেশের হয়ে মাঠে নেমে তিনি মোট দশটি গোল করেছেন। শেষ গোল করেছেন ১৩ অক্টোবর মালয়েশিয়ার বিরুদ্ধে ফ্রেন্ডলি ম্যাচে। তার পরে ছ’টি ম্যাচের একটিতেও গোল পাননি। তাঁর এই গোলখরা দলকেও ভোগাচ্ছে। যে ছ’টি ম্যাচে গোল পাননি সুনীল, তার মধ্যে মাত্র একটি ম্যাচে একটি গোল করে। বাকি পাঁচ ম্যাচেই গোল দলের গোল সংখ্যাও শূন্য।


অতিরিক্ত সুনীল-নির্ভরতাই যে এই গোলখরার কারণ, তা এখন অনেকটাই স্পষ্ট। কিন্তু সেই নির্ভরতা যে কাটানোর চেষ্টা করছে ভারতীয় দল তার ইঙ্গিত গত শুক্রবারের ম্যাচেই পাওয়া গিয়েছে। যদিও ফিফা ক্রমতালিকায় ১১৭ নম্বরে থাকা ভারত বিশ্বের ১৫৮ নম্বরের বিরুদ্ধে সে দিন দাপুটে ফুটবল খেলার চেষ্টা করলেও গোলের মুখ খুলতে পারেনি। ম্যাচের শেষ দিকে কয়েকটি ভাল সুযোগ তৈরি করেও তা হাতছাড়া করে তারা। কর্নার থেকে হেড করে গোল করার সুবর্ণ সুযোগও হাতছাড়া করেন ভারতীয় দলের একমাত্র বঙ্গতারকা শুভাশিস বোস।


নাওরেম মহেশ সিংহও প্রতিপক্ষের বক্সে গোলে শট নেওয়ার সুযোগ পান। কিন্তু এত বেশি সময় নিয়ে ফেলেন তিনি যে, ডিফেন্ডাররা তাঁকে ঘিরে ধরে। আকাশ মিশ্রর নিখুঁত ক্রসে গোলের সামনে বলে পা লাগাতে পারলে হয়তো গোল পেতেন বিক্রম প্রতাপ সিং। কিন্তু তিনি বলে পৌঁছতেই পারেননি।    


মঙ্গলবার গুয়াহাটিতে এই ভুলগুলো শোধরাতে না পারলে  যে কতটা হতাশা আছে ভারতীয় ফুটবলারদের কপালে, তা বোঝাই যাচ্ছে। এশিয়ান কাপে খারাপ ফল হওয়ার পর ভারতীয় দলের হেড কোচ সারা দেশকে কথা দেন, বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে ভারতকে এই প্রথম তৃতীয় রাউন্ডে তুলবেনই তিনি। কিন্তু গোলের খরা না মেটাতে পারলে যে সেই কথা রাখতে পারবেন না তিনি, তা খুব ভাল করেই জানেন ভারতীয় কোচ।


গত ম্যাচের পরে যেমন এই নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন স্টিমাচ, সোমবারও একই সমস্যার কথা তুলে ধরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “পাঁচ বছর ধরে এই সমস্যা রয়ছে আমাদের। আমি এখানে আসার আগেও ছিল। আগেও বলেছি, আমাদের দলের ছেলেরা বেশিরভাগই গোল করার সুযোগ বেশি পায় না ওরা। তাই এই সমস্যাটা থেকেই যাচ্ছে। আমাদের ছোটখাটো ভুলগুলো কমাতে হবে। উজবেকিস্তানের বিরুদ্ধে ম্যাচটা আমরাই বেশিরভাগ নিয়ন্ত্রণ করেছিলাম। কিন্তু আমাদের ছোট ভুলে ওরা গোল করে দেয়। আমাদের প্রতিপক্ষের ভুল কাজে লাগাতে শিখতে হবে”।


এ বারের এশীয় বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে ভারত রয়েছে ‘এ’ গ্রুপে। কাতার, কুয়েত ও আফগানিস্তানের সঙ্গে। এই গ্রুপে ভারত এখন রয়েছে দুই নম্বরে। তিনটির মধ্যে একটি ম্যাচে জিতে ও একটিতে ড্র করে তাদের সংগ্রহ চার পয়েন্ট। কুয়েতের সংগ্রহ তিন পয়েন্ট। তাই তারা তিন নম্বরে। আফগানিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে গত ম্যাচে ড্র করে এক পয়েন্ট নিয়ে চার নম্বরে। তাই দু’নম্বর জায়গাটা ধরে রাখতে গেলে অবশ্যই জয় দরকার সুনীলদের।


আফগানিস্তান এই গ্রুপে সবার শেষে রয়েছে। প্রথম দু’টি ম্যাচের একটিতেও জিততে পারেনি তারা। কাতারের কাছে ১-৮ ও কুয়েতের কাছে ০-৪ গোলে হারে। কিন্তু ভারত বাছাই পর্বের প্রথম ম্যাচে কুয়েতে গিয়ে তাদের ১-০-য় হারিয়ে আসে। যদিও দ্বিতীয় ম্যাচে কাতারের বিরুদ্ধে ঘরের মাঠে ০-৩-এ হেরে যায়। জানুয়ারিতে এএফসি এশিয়ান কাপের মূলপর্বেও গোল ও জয়হীন থাকে তারা। সে দিক থেকে দেখতে গেলে আফগানিস্তানের চেয়ে খাতায় কলমে এগিয়েই রয়েছে ভারতই।


ভারতের বাছাই পর্বের তৃতীয় রাউন্ডে ওঠার ব্যাপারে এতটাই আত্মবিশ্বাসী কোচ স্টিমাচ যে, সেই লক্ষ্য পূরণ না হলে তিনি দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন বলেও জানিয়েছেন। দলের ফুটবলারদেরও সমানে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি। বলেন, “ছেলেদের বলেছি, কালকের ম্যাচেই আমাদের সব কিছু শেষ হয়ে যাচ্ছে না। আমরা গ্রুপে দু’নম্বরে রয়েছি। দেশের ফুটবলে নতুন ইতিহাসের দোরগোড়ায় রয়েছি। এখানকার পরিবেশ খুবই ভাল। আমাদের ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে। ড্র-কে আমরা হারের সমানই ধরছি। কাল আমাদের নিজেদের সেরাটা উজাড় করে দিয়ে জিততে হবে। জুনে কুয়েতের মুখোমুখি হওয়ার আগে পরিস্থিতি আমাদের অনুকুলে নিয়ে আসতে হবে”।


গত ম্যাচে প্রতি আক্রমণের সুযোগের অপেক্ষায় থাকা আফগানরা প্রথমার্ধের শেষ দিকে দু-একটি ইতিবাচক আক্রমণ ছাড়া প্রথম ৪৫ মিনিটে বেশি কিছু করতে পারেননি। দুই দলই সে দিন ট্রানজিশনে দক্ষতা দেখায়। প্রায় ৮,১০০ ফিট উচ্চতায় দামাক স্টেডিয়ামে খেলা হলেও প্রথমার্ধে দমে ঘাটতি পড়েনি কোনও দলের ফুটবলারদেরই। দ্বিতীয়ার্ধে গতি হারাতে শুরু করেন প্রথম এগারোর খেলোয়াড়রা, পরিবর্ত খেলোয়াড়দের দিয়ে যা সামাল দেন কোচেরা। কিন্তু প্রথমার্ধে গোলের সুবর্ণ সুযোগ তৈরি করে উঠতে পারেনি ভারতীয় দল। দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকে তাদের একটু বেশিই আক্রমণাত্মক মেজাজে পাওয়া যায়। কিন্তু প্রতিবার বিপক্ষের গোলের সামনে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলে তারা।


বাছাই পর্বের পারফরম্যান্সের নিরিখে ভারত খাতায় কলমে যেমন এগিয়ে রয়েছে। তেমনই ফিফা ক্রমতালিকায় অবস্থানের দিক থেকেও আফগানদের চেয়ে এগিয়ে তারা। ভারত যেখানে রয়েছে ১১৭ নম্বরে, সেখানে আফগানিস্তানের অবস্থান ১৫৮-য়। ইতিহাসও ভারতকে এগিয়ে রেখেছে। এ পর্যন্ত যে ১২ বার দুই দেশের ফুটবল-দ্বৈরথ হয়েছে, তার মধ্যে ভারত জিতেছে সাতবার, আফগানিস্তান জিতেছে মাত্র একবার, চারবার ড্র হয়েছে।  


কিন্তু এগুলো সবই খাতায় কলমে। ভারতকে মাঠের লড়াইয়ে জিততে গেলে তাদের প্রধান সমস্যা দূর করতে হবে। যদিও এ বার ঘরের মাঠে খেলবে তারা। গত ম্যাচের মতো অস্বাভাবিক উচ্চতায় খেলতেও হবে না তাদের। চেনা পরিবেশে নিজেদের সমর্থকদের সামনেই খেলবে। ফলে একটা বাড়তি সুবিধা অবশ্যই থাকবে তাদের। এই সুবিধা কাজে লাগাতে পারে কি না তারা, সেটাই দেখার।


আফগানদের কোচ অ্যাশলে ওয়েস্টউডও এই মাঠকে খুব ভাল করেই চেনেন। কারণ, ভারতীয় ফুটবলে তিনি একসময় পরিচিত মুখ ছিলেন। অতীতে বেঙ্গালুরু এফসি, এটিকে ও রাউন্ডগ্লাস পাঞ্জাবের কোচ ছিলেন তিনি। গত বছর বিশ্বকাপ বাছাই পর্ব শুরুর আগে নভেম্বরে আফগানিস্তানের জাতীয় দলের দায়িত্ব নেন ওয়েস্টউড। ভারতীয় ফুটবলে কাজ করে যাওয়ার অভিজ্ঞতা যে তাঁকে ভারতের বিরুদ্ধে বাড়তে সুবিধা দিচ্ছে, তা গত ম্যাচে তাদের পারফরম্যান্সেই বোঝা গিয়েছে। এ বার দেখার, গত ম্যাচের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ভারতকে তাদের ঘরের মাঠে কী ভাবে আটকানোর চেষ্টা করবে আফগানরা।


ভারতীয় স্কোয়াড


গোলরক্ষক: অমরিন্দর সিং, গুরপ্রীত সিং সান্ধু, বিশাল কয়েথ,


ডিফেন্ডার: আকাশ মিশ্র, মেহতাব সিং, নিখিল পূজারি, রাহুল ভেকে, শুভাশিষ বোস, আনোয়ার আলি, অময় রানাওয়াডে, জয় গুপ্তা।


মিডফিল্ডার: অনিরুদ্ধ থাপা, ব্র্যান্ডন ফার্নান্ডেজ, দীপক টাংরি, লালেংমাওইয়া রালতে, লিস্টন কোলাসো, নাওরেম মহেশ সিং, সহাল আব্দুল সামাদ, সুরেশ সিং ওয়াংজাম, জিকসন সিং, ইমরান খান।


ফরোয়ার্ড: লালিয়ানজুয়ালা ছাংতে, মনবীর সিং, সুনীল ছেত্রী, বিক্রম প্রতাপ সিং।


ম্যাচভারত বনাম আফগানিস্তান, বিশ্বকাপ (এশীয়) বাছাই পর্ব, দ্বিতীয় রাউন্ড 


ভেনুইন্দিরা গান্ধী অ্যাথলেটিক স্টেডিয়াম, গুয়াহাটি


কিক-অফ২৬ মার্চ, সন্ধ্যা ৭.০০


সরাসরি সম্প্রচারস্পোর্টস ১৮ ওয়ান, থ্রি ও জিও সিনেমা মোবাইল অ্যাপে


তথ্য: ISL Media


আরও পড়ুন: কেকেআর শিবিরে রং বরষে... দোলের দিনও প্র্যাক্টিস নাইটদের, সকালে চলল দোল খেলা


আপনার পছন্দের খবর আর আপডেট এখন পাবেন আপনার পছন্দের চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম হোয়াটস অ্যাপেও। যুক্ত হোন ABP Ananda হোয়াটস অ্যাপ চ্যানেলে