গুয়াহাটি: ইন্ডিয়ান সুপার লিগে (ISL 2024-25) থামানো যাচ্ছে না মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের বিজয়রথ। ক্রমশ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে তারা। রবিবারও গুয়াহাটির ইন্দিরা গাঁধী অ্যাথলেটিক স্টেডিয়ামে নর্থইস্ট ইউনাইটেডকে (Mohun Bagan Super Giant vs NorthEast United) ২-০-য় হারিয়ে চলতি লিগের সাত নম্বর জয়টি তুলে নেয় সবুজ-মেরুন বাহিনী। এই জয়ের ফলে ফের বেঙ্গালুরু এফসি-কে টপকে লিগ টেবলের শীর্ষস্থানে উঠে পড়ল তারা। চতুর্থ হারের পর নর্থইস্ট ইউনাইটেড ছ’নম্বরে রয়ে গেলেও তাদের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে জামশেদপুর এফসি ও মুম্বই সিটি এফসি।

এ দিন উত্তেজনায় ঠাসা ম্যাচে শুরু থেকেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে দুই দল। তবে ম্যাচের শেষ আধ ঘণ্টায় চালকের আসনে বসে পড়ে গতবারের লিগশিল্ড চ্যাম্পিয়নরা। ৬৫ ও ৭১তম মিনিটে দুই সবুজ-মেরুন উইঙ্গার মনবীর সিংহ ও লিস্টন কোলাসোর গোলে টানা তৃতীয় জয় তুলে নেয় কলকাতার দল। শেষ পাঁচটি ম্যাচের মধ্যে এটি তাদের চতুর্থ জয়। এই নিয়ে টানা সাতটি ম্যাচে অপরাজিত তারা, যার মধ্যে ছ’টিতেই জিতেছে। নিজেদের মাঠে নর্থইস্টকে ৩-২-এ হারানোর পর এ বার তাদের মাঠেও জয় পেল বাগান-বাহিনী।

অন্যদিকে, টানা চারটি ম্যাচে অপরাজিত থাকার পর শেষ দুই ম্যাচেই হারের মুখ দেখতে হয় নর্থইস্টকে এবং দুই ম্যাচই তারা খেলে কলকাতার দুই প্রধানের বিরুদ্ধে। এই দুই ম্যাচেই গোল পেলেন না তাদের মরক্কান ফরোয়ার্ড আলাদিন আজারেই। টানা আটটি ম্যাচে গোল করার পর শেষ দুই ম্যাচেই গোলহীন তিনি।

দুই নির্ভরযোগ্য ডিফেন্ডার আলবার্তো রড্রিগেজ ও শুভাশিস বসু কার্ড সমস্যার জন্য এ দিন খেলতে না পারায় ছক বদলে খেলা শুরু করে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। রড্রিগেজের জায়গায় আশিস রাই ও শুভাশিসের বদলে আশিক কুরুনিয়ান প্রথম এগারোয় আসেন। মাঝমাঠে দীপক টাঙরির জায়গায় খেলেন সহাল আব্দুল সামাদ। হাতের সেরা তাসগুলিকে ৪-২-৩-১-এ সাজান হোসে মোলিনা। একই ছকে শুরু করে নর্থইস্টও, যারা এদিন প্রথম এগারোয় চারটি পরিবর্তন করে নামে।

শুরু থেকেই দুই দলের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়। এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ঘন ঘন আক্রমণ ও প্রতি আক্রমণে জমে ওঠে ম্যাচ। ইন্দিরা গাঁধী স্টেডিয়ামের পরিবেশও ছিল জমজমাট। দুই দলের সমর্থকদের উল্লাসে সরগরম ছিল গ্যালারি।

দশ মিনিটের মাথায় বক্সের মাথা থেকে নেওয়া লিস্টন কোলাসোর শট পোস্টে লেগে ফিরে আসে এবং ২০ মিনিটের মাথায় দিমিত্রিয়স পেট্রাটোসের ভাসানো বল গোলের সামনে পৌঁছলে কোলাসো তাতে ফ্লিক করেন, যা সোজা গোলকিপার গুরমিত সিংহের হাতে চলে যায়। ৩৭ মিনিটের মাথায় কোলাসো দুর্দান্ত ফ্লিকে গোলের সামনে বল ঠেললেও ডিফেন্ডাররা ঘিরে ধরায় গোলে শট নিতে পারেননি মনবীর সিংহ।

প্রথমার্ধের শেষ মিনিটে কোলাসোর বাড়ানো বল বক্সের মাথা থেকে গোলে শট নেন পেট্রাটস। কিন্তু অসাধারণ দক্ষতায় তা বারের ওপর দিয়ে বের করে দেন গুরমিত। সেই কর্নার থেকে হেড করে গোল করার চেষ্টা করেন টম অলড্রেড। কিন্তু তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়।

অন্যদিকে, নর্থইস্ট ও লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা আলাদিন আজারেইকে এ দিন বেশিই ক্ষুধার্ত মনে হয়। বাঁ প্রান্ত দিয়ে প্রায়ই ঢুকছিলেন প্রতিপক্ষের গোল এলাকায়। কিন্তু সমানে তাঁকে আটকে রাখেন আশিস। তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অন্য উইং দিয়ে আক্রমণে ওঠেন জিথিন এম এস। মাঝবরাবর উঠছিলেন নেস্টর আলবিয়াখ।

ম্যাচের ১৯ মিনিটের মাথায় বাঁ দিক থেকে আলাদিনের ক্রস পেয়ে সোজা গোলে শট নেন আলবিয়াখ, যা গোলকিপার বিশালের হাতে লেগে অল্পের জন্য পোস্টের বাইরে চলে যায়। ২৫ মিনিটের মাথায় আলবিয়াখের পাস থেকে গোলে শট নেন আলাদিন, যা দুর্দান্ত ব্লক করেন দীপেন্দু। প্রথমার্ধে মোহনবাগানের দখলে ছিল প্রায় ৬০ শতাংশ বল। তারা যেখানে গোলে দুটি শট মারে, সেখানে হোম টিমের মাত্র একটি শট লক্ষ্যে ছিল।

দ্বিতীয়ার্ধের খেলা শুরু হওয়ার দশ মিনিটের মধ্যেই দুই দলই গোলের সুযোগ পেয়ে যায়। ৪৭ মিনিটের মাথায় বক্সের বাইরে থেকে নেওয়া ম্যাকার্টন নিক্সনের শট আটকে দেন বিশাল। এর পরেই ডানদিক দিয়ে বক্সে ঢুকে কাট ব্যাক করেন জেমি ম্যাকলারেন, যেখানে ঠিকমতো পৌঁছতে পেট্রাটস, কোলাসো কেউই।

দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকে ম্যাচে আধিপত্য বিস্তার করার প্রবণতা দেখা যায় নর্থইস্টের খেলায়। ৫৪ মিনিটের মাথায় ফের সুযোগ পায় তারা। বাঁ দিক দিয়ে বক্সে ঢুকে কোণাকুনি গোলে শট নেন আলবিয়াখ। কিন্তু বিশালের গায়ে লেগে তা ছিটকে আসে আলাদিনের পায়ে, তাঁর শট বারের ওপর দিয়ে উড়ে যায়। প্রথমার্ধের মতো দ্বিতীয়ার্ধেও খেলার গতি ছিল একই রকম দ্রুত ও আক্রমণ-প্রতি আক্রমণে ভরা।

দুই দলেরই রক্ষণকে এ দিন কড়া চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয় বারবার। তবে পরীক্ষায় উতরে যায় তারা। একদিকে যেমন আলাদিনকে কড়া পাহাড়ায় রাখেন নর্থইস্টের ডিফেন্ডাররা, তেমনই পেট্রাটস বল ধরলেই তাঁকে ঘিরে ধরছিলেন নর্থইস্টের খেলোয়াড়রা। মোহনবাগানের দুই নির্ভরযোগ্য ডিফেন্ডার এ দিন মাঠে না থাকলেও তাঁদের অভাব বুঝতে দেননি পরিবর্ত ফুটবলাররা। আলাদিনকে আটকে রাখার কঠিন কাজটি দারুণ ভাবে করেন আশিস।

কিন্তু সবুজ-মেরুন শিবিরে যে শুধু একজন অ্যাটাকারকে কড়া পাহাড়ায় রাখলে চলে না, তাদের গোলদাতার সংখ্যা অনেক, ৬৫ মিনিটের মাথায় সেটাই প্রমাণ করেন মনবীর সিংহ। ডান উইংয়ে থাকা মনবীরকে পাস বাড়ান আপুইয়া, যা নিয়ে কাট-ইন করে তিনি চলে আসেন পেনাল্টি বক্সের সামনে, মাঝামাঝি জায়গায়। সেখান থেকেই বাঁ পায়ে সোজা গোলে শট নেন তিনি, যার নাগাল পাননি গুরমিত (১-০)।

এক গোলে এগিয়ে যাওয়ার পর আরও উজ্জীবিত হয়ে ওঠে সবুজ-মেরুন ব্রিগেড এবং প্রথম গোলের ছ’মিনিট পরেই ফের গোল করে জয়ের দিকে দলকে এগিয়ে দেন কোলাসো। যেন মনবীরের গোলের ‘মিরর ইমেজ’! আশিসের পাসে বল পেয়ে বাঁ দিক থেকে ডানদিকে কাট-ইন করে বক্সে ঢুকে পড়েন কোলাসো এবং বক্সের মাথা থেকে ডানপায়ে গোলে শট নেন। এ বারও গুরমিতের কিছু করার ছিল না (২-০)।

ঘরের মাঠে দু’গোলে পিছিয়ে যাওয়া নর্থইস্ট গোলশোধের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে এবং কোলাসোর গোলের চার মিনিট পরেই সেই সুযোগ পেয়ে যায় তারা। বক্সের মধ্যে সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে হেড করেন আলাদিন, যা সাইড নেটে গিয়ে লাগে। বিরতির পর জিথিনের জায়গায় পার্থিব গগৈকে নামান কোচ পেদ্রো বেনালি। দ্বিতীয়ার্ধে জিথিনের অনুপস্থিতিই সম্ভবত ক্রমশ তাদের আক্রমণের ধার কমিয়ে দেয়।

তবে গোলের চেষ্টা চালিয়ে যায় নর্থইস্ট এবং শেষ দশ মিনিটে আলবিয়াখ, হামজা রেগরাগুই, পার্থিবরা পরপর গোলের সুযোগও পেয়ে যায়। পার্থিবের কোণাকুনি শট অনবদ্য বিশাল অনবদ্য সেভ না করলে বোধহয় ব্যবধান কমিয়ে ফেলতে পারত নর্থইস্ট ইউনাইটেড।

এ দিন নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার ১৪ মিনিট আগে পেট্রাটসের জায়গায় মাঠে আসেন তাঁর স্বদেশীয় জেসন কামিংস এবং ৮৭ মিনিটের মাথায় একসঙ্গে দীপক টাঙরি ও গ্রেগ স্টুয়ার্ট নামেন যথাক্রমে সহাল ও ম্যাকলারেনের জায়গায়। তবে ততক্ষণে জয় সুনিশ্চিত করে ফেলে সবুজ-মেরুন বাহিনী। সাত মিনিটের সংযুক্ত সময় পেয়েও ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পায়নি নর্থইস্ট ইউনাইটেড।


(তথ্য: আইএসএল মিডিয়া)


আরও পড়ুন: দুমড়ে মুচড়ে একাকার গাড়ি, দুর্ঘটনার শিকার প্রিমিয়ার লিগের তারকা ফুটবলার