ভুবনেশ্বর: জয়ের জন্য তুমুল লড়াই করেও শেষ পর্যন্ত পয়েন্ট ভাগাভাগি করে নিল গতবারের লিগ শিল্ড চ্যাম্পিয়ন মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট (Mohun Bagan Super Giant) ও সেমিফাইনালিস্ট ওড়িশা এফসি (Odisha FC)। রবিবার সন্ধ্যায় ভুবনেশ্বরের কলিঙ্গ স্টেডিয়ামে চলতি আইএসএলের অন্যতম সেরা দুই দলের ম্যাচ ১-১ ফলে শেষ হয়।


ম্যাচের শুরুতেই মোহনবাগানের প্রাক্তন তারকা হুগো বুমোসের গোলে এগিয়ে যায় ওড়িশা এফসি। ৩৬ মিনিটের মাথায় হেড করে সেই গোল শোধ করেন মনবীর সিং। এই দুই গোলের পর দু’পক্ষই ব্যবধান বাড়ানোর মরিয়া চেষ্টা চালালেও সফল হয়নি। বল পজেশনে এগিয়ে থাকলেও মোহনবাগানকে বেশি শট গোলে রাখতে দেয়নি ওড়িশা। তবে সারা ম্যাচে একটিও কর্নার আদায় করতে পারেননি রয় কৃষ্ণারা।


মোহনবাগানের দুই প্রাক্তনী বুমো ও রয় এ দিন তাঁদের পুরনো দলের বিরুদ্ধে উজ্জীবিত ফুটবল খেলার চেষ্টা করলেও তাঁদের কড়া পাহাড়ায় রেখেছিল বাগান-রক্ষণ। আক্রমণেও দুই দল কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে। ওড়িশা যেখানে আটটি গোলের সুযোগ তৈরি করে, সেখানে দশটি গোলের সুযোগ পায় মোহনবাগান। প্রতিপক্ষের বক্সে বল ছোঁয়ার দিক থেকে দুই দল ছিল সমান (২৭-২৬)। মোহনবাগান যেখানে পাঁচটি শট লক্ষ্যে রাখে, সেখানে ওড়িশার ছ’টি শট ছিল গোলে। এই ড্রয়ের ফলে সাত ম্যাচে ১৪ পয়েন্ট নিয়ে লিগ টেবলের দ্বিতীয় স্থানেই রয়ে গেল সবুজ-মেরুন বাহিনী। ওড়িশা এফসি আট ম্যাচে ন’পয়েন্ট নিয়ে ন’নম্বরে। শেষ তিন ম্যাচেই জয়হীন থাকল তারা।


এ দিন তিনটি পরিবর্তন করে দল নামায় মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। জন্মদিনে পেত্রাতোস প্রথম এগারোয় ফিরে আসেন। সঙ্গে কোলাসো ও আপুইয়া। সহাল, টাঙরি ও স্টুয়ার্টের জায়গায় নামেন তাঁরা। সামনে পেত্রাতোস ও ম্যাকলারেন ও তাঁদের পিছনে মনবীর, থাপা, আপুইয়া ও কোলাসোকে রেখে ৪-৪-১-১-এ খেলা শুরু করে সবুজ-মেরুন বাহিনী। অন্য দিকে, ওড়িশার প্রথম এগারোয় হুগো বুমো ও আহমেদ জাহু ফেরেন। দিয়েগো মরিসিও ও কার্লোস দেলগাদো ছিলেন রিজার্ভ বেঞ্চে।


শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক মেজাজে থাকা ওড়িশা এফসি এতটাই চাপে ফেলে দেয় মোহনবাগানকে যে, ডিফেন্ডার আশিস রাই ছ’গজের বক্সের সামনে থেকে গোলকিপার বিশালকে হঠাৎ ব্যাক পাস করে বসেন এবং বিশাল তা হাত দিয়ে তুলেও নেন। ফলে ছ’গজের বক্সের মাথায় ইনডাইরেক্ট ফ্রি-কিক পায় ওড়িশা। নিজেদের গোলের সামনে এগারোজন ফুটবলারের দেওয়াল তুললেও জাহুর ফ্রি কিক থেকে নেওয়া বুমোের শট আটকাতে পারেনি মোহনবাগান, জালে জড়িয়ে যায় সেই শট (১-০)।


ঘরের মাঠে ম্যাচের শুরুতেই গোল পেয়ে যাওয়ায় আরও উজ্জীবিত ফুটবল খেলা শুরু করে ওড়িশা। অন্য দিকে, সমতা আনার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে মোহনবাগানও। ফলে আক্রমণ ও প্রতি আক্রমণে জমে ওঠে ম্যাচ। পেত্রাতোসের গোলমুখী শট ন’মিনিটের মাথায় অনবদ্য সেভ করেন অমরিন্দর। ২১ মিনিটে ফের একই ভাবে গোলে শট নেন দিমি। কিন্তু এ বার তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। ২৬ মিনিটে কোলাসোর দূরপাল্লার শট অমরিন্দর আটকালেও তাঁর হাত থেকে বল ছিটকে বেরিয়ে আসে। কিন্তু পরের মুহূর্তেই পরিস্থিতি সামলে নেন ওড়িশা কিপার।


মোহনবাগানের হাইলাইন ফুটবলের জন্য ১৮ মিনিটের মাথায় প্রায় ফাঁকা মাঠে গোলের সুযোগ পেয়ে যান রয় কৃষ্ণা। কিন্তু বিশাল এগিয়ে এসে তাঁকে আটকান। দুই সেন্টার ব্যাকের মাঝখানে অনেকটা জায়গা পেয়ে গিয়েছিলেন রয়। একই ভাবে গোলের সুযোগ পেয়ে যান রহিম আলিও। এ বারও একই ভাবে দলকে বাঁচান বিশাল।


সমতা আনার জন্য মরিয়া মোহনবাগান সাফল্য পায় ৩৬ মিনিটের মাথায়, যখন তারা কর্নার পায়। সেটি ছিল তাদের ষষ্ঠ কর্নার। পেত্রাতোসের নিখুঁত কর্নার গিয়ে পড়ে প্রথম পোস্টের সামনে থাকা মনবীরের মাথায়। দুর্দান্ত হেড করে বল গোলের দিকে ঠেলে দেন তিনি, যা অমরিন্দরের হাতে লেগে গোলে ঢুকে যায় (১-১)। অর্থাৎ দুই দলই গোল করে সেট পিস মুভ থেকে। প্রথমার্ধে প্রায় ৬৪ শতাংশ বলই ছিল মোহনবাগানের দখলে। তিনটি শট গোলে রাখে, ১৮টি ক্রস বাড়ায় এবং সাতটি কর্নার আদায় করে নেয় সবুজ-মেরুন বাহিনী।


দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে একে অপরের গোলে আক্রমণের চেয়ে শারীরিক দ্বৈরথ বেশি দেখা যায়। ফলে যেমন রয় কৃষ্ণা চোট পান, তেমনই অনিরুদ্ধ থাপাও আহত হন। রয় চোট সামলে নিলেও থাপা পারেননি। তাঁর জায়গায় নামেন দীপক টাঙরি। এর মধ্যে একবার ইসাক রালতের শট দুর্দান্ত সেভ করেন বিশাল ও পুইতিয়ার শট বারে লেগে ফিরে আসে। রয়ের শটও সেভ করেন বিশাল। মোহনবাগান কিন্তু এই সময়ে আক্রমণে কিছুটা পিছিয়েই ছিল।


দ্বিতীয়ার্ধে মিনিট পনেরো খেলা হওয়ার পর থেকে আক্রমণে ওঠা শুরু করে বাগান-বাহিনী। ৬৭ মিনিটের মাথায় ডানদিক দিয়ে বক্সে ঢোকা মনবীরের কাট ব্যাক পেয়ে সোজা গোলে শট নেন পেত্রাতোস, যা সোজা অমরিন্দরের হাতে আটকে যায়। পেত্রাতোসকে এই সময় ডান উইং বরাবর আক্রমণে উঠতে দেখা যায়। মনবীরের সঙ্গে জায়গা পরিবর্তন করে খেলা শুরু করেন তিনি। তবে এ দিন জেমি ম্যাকলারেনকে কিছুটা ম্লান লেগেছে। গ্রেগ স্টুয়ার্ট না থাকায় সম্ভবত তিনি ঠিকমতো গোলের বল পাচ্ছিলেন না।


তবে ৭৩ মিনিটের মাথায় জাহুর দূরপাল্লার ফ্রি কিক থেকে গোল করার যে সুযোগ পায় ওড়িশা, তাকে সহজ বললেও বোধহয় কম বলা হবে। ডান প্রান্ত থেকে জাহুর ফ্রি কিক উড়ে এলে তা দ্বিতীয় পোস্টের সামনে থেকে গোলের দিকে ঠেলে দেন মুর্তাদা ফল, যা দুর্দান্ত সেভ করেন বিশাল। কিন্তু তাঁর হাত থেকে ছিটকে আসা বলে গোলের চেষ্টা করেন অময় রানাওয়াডে। এ বারও তাঁর শট ব্লক হওয়ার পর বুমো হেড করে গোলে বল ঠেলার চেষ্টা করেন, কিন্তু ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত বল ক্লিয়ার করে দেন বাগান-ডিফেন্ডাররা। ৮১ মিনিটের মাথায় ডানদিক দিয়ে বল নিয়ে ফাঁকা বক্সে ঢুকে পড়েন রয়। কিন্তু এগিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁর পা থেকে বল ছিনিয়ে নেন বিশাল।


ম্যাচের শেষ দিকে গোলসংখ্যা বাড়াতে ৭৭ মিনিটের মাথায় একসঙ্গে কামিংস ও সহালকে নামায় মোহনবাগান। তুলে নেওয়া হয় ম্যাকলারেন ও মনবীরকে। সহাল ডানদিক দিয়ে আক্রমণে উঠতে শুরু করেন। পেত্রাতোস ও কামিংস চলে আসেন মাঝখানে। নতুন দুই অ্যাটাকারকে সামলানোর দায়িত্ব নেন ফল ও জাহু।


মাঠে নামার মিনিট পাঁচেক পরেই গোলে শট নেন কামিংস, যা অমরিন্দর ডানদিকে ডাইভ দিয়ে বিপদসীমার বাইরে পাঠিয়ে দেন। ৮৭ মিনিটের মাথায় বক্সের সামনে থেকে ফ্রি কিক পায় মোহনবাগান, যা নেন পেত্রাতোস। তাঁর শট সোজা ওয়ালে লাগে। ফিরতি বলেও শট নেন পেত্রাতোস। কিন্তু তা ছিল গোলের বাইরে।


ম্যাচের ৮৫ মিনিটের মাথায় দিয়েগো মরিসিও ও কার্লোস দেলগাদোকে নামান ওড়িশা কোচ সের্খিও লোবেরা। উদ্দেশ্য একটাই, জয়সূচক গোল। হোসে মোলিনাও কোলাসোর জায়গায় নামান আশিক কুরুনিয়ানকে। ছ’মিনিটের বাড়তি সময়ে দুই দলই গোলের সুযোগ তৈরি করে। ওড়িশা সুযোগ পায় ফ্রি কিক থেকে এবং মোহনবাগান ওপেন প্লে-তে। কিন্তু কোনও দলই তা কাজে লাগাতে পারেনি।


মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট দল (৪-৪-১-১): বিশাল কয়েথ (গোল), আশিস রাই, আলবার্তো রড্রিগেজ, টম অ্যালড্রেড, শুভাশিস বোস, মনবীর সিং (সহাল আব্দুল সামাদ-৭৭), অনিরুদ্ধ থাপা (দীপক টাঙরি-৫৭), লিস্টন কোলাসো (আশিক কুরুনিয়ান-৮৮), আপুইয়া, দিমিত্রিয়স পেত্রাতোস


(তথ্য: আইএসএল মিডিয়া)


আরও পড়ুন: ন'জন নিয়ে এক ঘণ্টার অধিক সময় লড়াই, মহামেডানের বিরুদ্ধে ড্রয়ে মরশুম প্রথম পয়েন্ট ইস্টবেঙ্গলের