কোচি: যে কোনও ভারতীয় ফুটবলারেরই স্বপ্ন দেশের জার্সি গায়ে মাঠে নামা এবং দেশের সেরা ক্লাবের হয়ে খেলা। এই দুই স্বপ্নের কোনওটিই অপূর্ণ থাকেনি তাঁর। কিন্তু ভাল দিন যেমন দেখেছেন, দুঃস্বপ্নের রাতও কম কাটাননি তিনি। তবু জীবনের যাবতীয় হার্ডল পেরিয়ে তিনি ফিরে এসেছেন তাঁর নিজের প্রিয় জায়গায়, ফুটবল মাঠে। তাই যে কোনও ফুটবল-যোদ্ধার কাছে আদর্শ হয়ে উঠতে পারেন আশিক কুরুনিয়ান (Ashik Kuruniyan)।
সেই আশিক কুরুনিয়ান যখন নিজের রাজ্য কেরলের ফুটবলপ্রেমীদের সামনে ভিনরাজ্যের ক্লাবের জার্সি গায়ে নামেন ও মালয়লি ফুটবলপ্রেমীরা যখন তাঁর দলের প্রতিপক্ষের হয়ে গলা ফাটায়, তখন তাতে কর্ণপাত না করে নিজের পারফরম্যান্সেই ফোকাস করতে জানেন আশিক। এটাই তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ। কেরলের ছেলে হয়েও এখন পর্যন্ত কেরল ব্লাস্টার্সের হয়ে খেলার সুযোগ পাননি আশিক। বরাবরই ভিনরাজ্যের ক্লাবের হয়ে কেরল ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে নেমেছেন তিনি। তাই এই ব্যাপারটা গা সওয়া হয়ে গিয়েছে তাঁর।
২০ বছর বয়সে পেশাদার ফুটবল জীবন শুরু করে এফসি পুনে সিটি, বেঙ্গালুরু এফসি হয়ে এখন তিনি মোহনবাগান সুপার জায়ান্টে। ফুটবল জীবন শেষও করতে চান কলকাতার ঐতিহ্যবাহী ক্লাবের হয়ে খেলেই। পিছন ফিরে তাকানোর সুযোগই আর পান না তিনি। স্পেনের ভিয়ারিয়েল সি-তে প্রশিক্ষণের যে সুযোগ পেয়েছিলেন কেরলর এই তারকা, তাকেও ভরপুর কাজে লাগিয়েছেন। হয়ে উঠেছেন এক সফল উইঙ্গার, যিনি আবার ফুল ব্যাক হিসেবেও খেলতে পারেন। এখন যে আশিককে দেখা যাচ্ছে, তিনি বহু বছর ধরে ঘষে মেজে গড়ে তোলা এক ফুটবল শিল্পী।
তবে এর মধ্যে ছিল অনেকটা কাঁটা বিছানো পথও। ২০২৩-এ থাইল্যান্ডে কিংস কাপে ভারতীয় দলের হয়ে ইরাকের বিরুদ্ধে খেলতে গিয়ে এসিএল-এ (অ্যান্টেরিয়ার ক্রুশিয়েট লিগামেন্ট) চোট পেয়ে পুরো মরশুমের জন্য ছিটকে যান আশিক। তখন সামনেই এএফসি এশিয়ান কাপে ভারতের হয়ে ও আইএসএলে মোহনবাগান এসজি-র হয়ে দ্বিতীয় মরশুমে খেলার স্বপ্ন তাঁর চোখে। কিন্তু সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায় ওই একটা চোটেই। একটা গোটা মরশুম (২০২৩-২৪) মাঠে নামতে না পেরে ছটফট করেছেন। শুধু শারীরিক যন্ত্রণা নয়, মানসিক যন্ত্রণাতেও।
শুক্রবার কলকাতায় সাংবাদিকদের আশিক এই প্রসঙ্গে বলেন, "আমার মতো গুরুতর চোট অনেকেরই আগে হয়েছে। তারা ভাল ভাবে ফিরেও এসেছে। তাদের অনেকের সঙ্গে আমার কথাও হয়। সবাই আমাকে বলে, চোট সারিয়ে ফিরে আসার পর প্রথম বছরটা কঠিন হবে। সত্যিই সেটা হয়েছে। এখন আমি কেমন খেলেছি, তা আমি নিজে বলার চেয়ে যারা আমার খেলা দেখছে, তারা বললে ভাল হয়। আমার মনে হয়, আরও ভাল খেলতে পারি আমি।"
প্রায় এক বছর নেন মাঠে ফিরতে। গত মরশুমে আইএসএলে একটিও ম্যাচ না খেলতে পারার যন্ত্রণা বুকে নিয়ে এ বছর মাঠে ফিরে এসে ১১টি ম্যাচে মাঠে নেমেছেন তিনি। যদিও বেশিরভাগ ম্যাচেই পরিবর্ত হিসেবে খেলেছেন তিনি। তবে এক নতুন ভূমিকায় দেখা গিয়েছে এই উইঙ্গারকে। তিনি এখন স্বচ্ছন্দে মোহনবাগানের লেফট ব্যাকের জায়গা সামলাচ্ছেন। এবং এই নতুন ভূমিকা নিয়ে তিনি খুশি।
এই প্রসঙ্গে আশিক বলেন, "লেফট উইঙ্গার ও লেফট ব্যাক পজিশনে বেশি তফাৎ নেই। উইং ব্যাককে একদিকে যেমন রক্ষণের কাজ করতে হয়, আক্রমণেও উঠতে হয়। এখানে দায়িত্ব একটু বেশিই এবং এই ভূমিকা ভালও লাগছে আমার।"
মালাপ্পুরমের গলি থেকে কলকাতার রাজপথ— এই সফরটা যে খুব একটা সহজ ছিল না আশিক কুরুনিয়ানের, তা বোধহয় আলাদা করে বলে দিতে হবে না। ওই জায়গা থেকে ভারতীয় ফুটবলের অন্যতম সেরা ক্লাব মোহনবাগান ও ভারতের জাতীয় দলের নিয়মিত সদস্য হয়ে ওঠা মোটেই কম কৃতিত্বের নয়। কিন্তু এই চোটই অনেকটা পিছিয়ে দেয় তাঁকে। ফের ভারতীয় দলে ডাক পাওয়ার লড়াই শুরু করেছেন তিনি।
হিরো আইএসএলে সাতটি মরশুম খেলা হয়ে গিয়েছে তাঁর। মোট ৯৪টি ম্যাচ খেলেছেন, পাঁচটি গোল করেছেন ও ছ’টিতে অ্যাসিস্ট করেছেন। ২০১৬-১৭ মরশুমে স্পেনের ক্লাব এফসি ভিয়ারিয়েলেও খেলে এসেছেন। পুনে এফসি থেকে লোনে সেখানে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে এফসি পুনে সিটিতে যোগ দেন ও সেখান থেকে বেঙ্গালুরুতে যোগ দেন ২০১৯-এর অগাস্টে। তিন বছর পরে ফের দল বদলে মোহনবাগানে আসেন তিনি।
ফুটবল জীবন শেষ করতে চান কলকাতার ঐতিহ্যবাহী ক্লাবে থেকেই। বলেন, "মোহনবাগান আমাকে দুঃসময়ে অনেক সাহায্য করেছে। তাই এখানেই থেকে যেতে চাই। কলকাতায় ফুটবলের জন্য যে সমর্থন ও আবেগ দেখেছি, তা সারা দেশে আর কোথাও দেখিনি। মোহনবাগানকে সমর্থন করা তো একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে। তাই এ রকম ক্লাবের হয়ে খেলা সবার কাছেই স্বপ্ন। তাই এখানেই থেকে যেতে চাই।"
কেরল থেকে উঠে আসা একজন তারকা ফুটবলার যখন কেরলর মাঠে টানটান উত্তেজনাপূর্ণ কোনও ম্যাচে নামেন, তখন কী হয়? চিরকাল ভিনরাজ্যের ক্লাবে খেলে আসা আশিকের এই নিয়ে কোনও বিশেষ অনুভূতি নেই। বলেন, "আমার কাছে সব ম্যাচই একই রকম। সব ম্যাচই কঠিন। কেরলয় ম্যাচ বলে এটা বেশি কঠিন, এমন ব্যাপার নেই। এখন আমি কলকাতার ক্লাবে খেলি, তাই এখানকার সমর্থকেরাই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তবে নিজের রাজ্যে গিয়ে খেলব, এটা অবশ্যই আমার কাছে বিশেষ ব্যাপার।"
আইএসএলে কেরল ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে দশটি ম্যাচে খেলেছেন। একটি গোল করেছেন, দু’টি অ্যাসিস্টও করেছেন। মোট ন’টি শট মেরেছেন, যার মধ্যে তিনটি ছিল লক্ষ্যে। ১৩টি গোলের সুযোগ তৈরি করেছেন, ২৩টি ক্রস দিয়েছেন। ব্লাস্টার্সের বক্সে বল ছুঁয়েছেন ১১বার, ২৫বার ড্রিবল করেছেন, যার সাফল্যের হার ৫২ শতাংশ। শনিবার ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে ১১তম ম্যাচ খেলতে নামছেন তিনি।
নিজের রাজ্যে ম্যাচ বলে বাড়তি তাগিদ নিয়ে মাঠে নামবেন, এমন সম্ভাবনা নেই বলেই সাফ জানিয়ে দিলেন তিনি। বলেন, "প্রতি ম্যাচেই সমান খিদে নিয়ে মাঠে নামি। এই ম্যাচে বাড়তি খিদে নিয়ে মাঠে নামব, এমন ব্যাপার নেই। আমাদের কাছে এখন প্রতি ম্যাচ ফাইনালের মতো। আমার পরিবারের সদস্যরা ও কয়েকজন বন্ধু মাঠে খেলা দেখতে আসবে। আমার বন্ধুরা বেশিরভাগই কেরল ব্লাস্টার্সকে সমর্থন করে। কয়েকজন অবশ্য মোহনবাগানকে সমর্থন করে।"
সামনেই শিল্ড জয়ের হাতছানি। সে জন্য দলের সবাই উজ্জীবিত বলে জানান আশিক। বলেন, "এখনও শিল্ড জয় নিশ্চিত হয়নি। এখনও আমাদের দুটো ম্যাচ জিততে হবে। দলের সবাই উজ্জীবিত। কারণ, সবাই জানে দু-তিনটে ম্যাচ ভাল খেললে শিল্ড জিততে পারি আমরা। এখন পর্যন্ত আমরা যে রকম ভাল খেলেছি, সে রকমই ভাল খেলার চেষ্টা করব এবং একশো শতাংশ দেব।"
গতবার শিল্ডজয়ের জন্য শেষ ম্যাচ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল তাদের, যদিও তখন মাঠের বাইরে ছিলেন তিনি। এ বার শেষ ম্যাচে নামার আগেই শিল্ড জয়ের লক্ষ্য পূরণ হতে পারে তাদের। এই দাপুটে পারফরম্যান্সের জন্য দলের প্রশংসা করে আশিক বলেন, "আমাদের সবাই একশো শতাংশ দিয়েছে, আমাদের কোচও খুব ভাল। আমাদের দলের শক্তিও চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতোই। দলের সব কিছু ভাল হলেই এরকম হওয়া সম্ভব। খেলোয়াড়, কোচিং স্টাফ, যারা রিজার্ভ বেঞ্চে থাকে সবার পরিশ্রম রয়েছে এর মধ্যে।"
ডিসেম্বরে প্রথম লিগে ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে ৩-২-এ জেতা ম্যাচে দ্বিতীয় গোল খাওয়ার পরেই টম অলড্রেডের জায়গায় আশিক কুরুনিয়ানকে নামায় মোহনবাগান এবং ৮৬ মিনিটের মাথায় সমতাও এনে ফেলে তারা। সমতা আনার গোলে আশিকেরও ভূমিকা ছিল।
আরও পড়ুন: উৎসাহ দিয়েছেন সৌরভও, বাংলার প্রথম মহিলা হিসাবে দুর্দান্ত নজির গড়তে চলেছেন বিউটি
শুভাশিস বসু বাঁ দিকের উইংয়ে আশিককে বল দিলে তিনি তা বক্সের মধ্যে দিমিত্রি পেট্রাটস কাছে পাঠান। গোলের সামনে থেকে শট নেন তিনি, যা কামিংসের পায়ে লেগে গোলে ঢুকে পড়ে। এই গোলের পর, পাঁচ মিনিটের সংযুক্ত সময়ের একেবারে শেষ মুহূর্তে বক্সের বাইরে থেকেই সোজা গোলে শট নেন আলবার্তো রড্রিগেজ, যা রোখার সাধ্য ছিল না গোলকিপারের।
তবে শনিবার ফিরতি ম্যাচে আদৌ খেলার সুযোগ পাবেন কি না, তা জানেন না আশিক। বলেন, "কাল খেলব কি না, তা যেমন জানি না, তেমনই বেঞ্চে থাকতে হবে কি না, পরে নামতে হবে কি না, সে সব কিছুই জানি না। যদি সুযোগ পাই, যথাসাধ্য ভাল খেলে দলকে জিততে সাহায্য করব।" (সৌ: আইএসএল মিডিয়া)
আরও পড়ুন: আর বিনা পয়সায় দেখা যাবে না আইপিএল! মাথায় হাত ক্রিকেটপ্রেমীদের