আবীর দত্ত, কলকাতা: একটা বিশাল সিংহ। দৌড়াচ্ছে মাঠের এই প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্তে। একটা ফুটবলের পিছনে দৌড়াচ্ছে। যেন পুরো খেয়ে ফেলবে বলটাকে। ভালো করে লক্ষ্য করে দেখা গেল খেলছে সিংহ টা ওটা নিয়ে। খুব তীব্র গতিতে। যেমন বাড়ির পোষ্যরা খেলে। আবার 'দুটো হাত' বল নিজের কাছে রাখার চেষ্টা করছে। মাঝে মাঝে সিংহের সঙ্গে হাতের ধাক্কা লাগছে। কিন্তু সিংহ কামড়াচ্ছে না হাত দুটো কে। আরে এটা তো ফুটবল! হাত দিয়ে তো হবে না। সেই হ্যান্ড অফ গড তো বিতর্কিত। তাহলে? ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ দেখা মিললো একটি পদ্ম ফুল, যেন হাওয়ায় ভাসছে। চ্যালেঞ্জ দিচ্ছে সবাইকে "ধরতে পারো কিনা দেখো"। আবার মনে হচ্ছে যেন দুটো হাত এগিয়ে যাচ্ছে পদ্ম ফুলটা ধরতে। অঙ্ক পরীক্ষায় ক্যালকুলেশন করতে গিয়ে যেমন সব গুলিয়ে যেত, ঠিক তেমনই। খেলা হচ্ছে নাকি একটা বা একাধিক স্বপ্ন। এরই মাঝে হটাৎ যেন বুকের ভেতরের হৃৎপিণ্ড টা চোখে পড়লো। একে বারে আসল। চোখ ডলে নিলেও বুঝা যাচ্ছে ঐ তো হৃৎপিণ্ড। বুকের বাইরে কিভাবে! সব হচ্ছে এই বিশ্বকাপে। একদম কল্পনা নয়। সত্যি। গল্প হলেও সত্যি তেমন নয়। আক্ষরিক অর্থে সত্যি। এসব হতে চলেছে এই বিশ্বকাপে। আবার।
বিশ্বকাপের আসরে নামছে তাবড় তাবড় ফুটবলাররা। সঙ্গে নামছে জীবন্ত হৃদয় বা বিশাল জঙ্গলরাজ সিংহ বা পাহাড় আবার নামছে ড্রাগন। ভাবছেন এরা কি গ্যালারিতে থাকবে? না একেবারে মাঠে থাকবে। কিন্তু কিভাবে? ফুটবলারদের সঙ্গেই নামবে তাঁরা। সব ট্যাটু বা উল্কি আকারে। কয়েকশো সতীর্থকে পিছনে ফেলে সেরা ২৪ বা ২৫ জনের দলে যারা জায়গা পেয়েছেন, বিশ্বকাপের মাঠে নিজেদের প্রমান করার পালা। কেউ গোল করবে, কেউ গোল করাবে, কেউ গোল আটকাবে। কিন্তু তাঁরা একাই নন। নামছে তাদের বিশ্বাস । মানে তাঁদের গায়ে থাকা বিভিন্ন ট্যাটু। এই বিশ্বাস তাঁদের দেবে আত্মবিশ্বাস। আর্জেন্তিনা তারকা লিওনেল মেসি থেকে ব্রাজিলিয়ান সুপারস্টার নেমার। প্রাক্তন স্পেনিও বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন সের্জিও রামোস থেকে জার্মান তরুণ তুর্কি লিরোয় সানে। পিছিয়ে নেই এই বিশ্বকাপের আন্ডার ডগ হিসেবে আলোচিত ডাচ স্ট্রাইকার মাফিজ ডিপে। লিস্ট লম্বা। কেউ মনে করেন গুড লাক এই ট্যাটু আবার কেউ সাহস পান পুরোনো কীর্তিকে তুলে ধরে। আবার কুসংস্কার মনে করেন এমন লিস্ট ছোটো নয়।
যেমন লিও মেসি। ১৭ টি ট্যাটু আছে। ডান হাতে রয়েছে চোখের ট্যাটু। তার বাম দিকের তলপেটে ঠোঁটের ট্যাটু। নিজের স্ত্রী এন্তলিনা চোখ আর ঠোঁট। স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা আর সেখান থেকে আসা বিশ্বাস যা কাতারের মাঠেও মেসিকে আত্মবিশ্বাস দেবে বলেই হয়তো মনে করেন আর্জেন্তিনীয় তারকা। এছাড়া আছে বাঁ পায়ে দুটো হাতের ছবি। যেটা সবাই ভাবতো মারাদোনার হ্যান্ড অফ গডের ছবি। কিন্তু আদতে নয়। মেসি তাঁর প্রথম পুত্র সন্তানের হাতের ট্যাটু করে ছিলেন। কিন্তু মারাদোনার কথা সবাই ভাবায় পরে থিয়াগো নাম লিখে রেখেছেন। এছাড়াও যীশু, নিজের মায়ের ছবিও রয়েছে তাঁর সারা গা জুড়ে। রয়েছে একটি পদ্ম। যা নিজের অপর বিশ্বাস কে সুচিত করে।
এবার আসি এক সময় মাঠে মেসির সব থেকে বড়ো প্রতিপক্ষ বর্তমানে মেসির পিএসজি ক্লাবের সতীর্থ সার্জিও রামোসের গল্পে। এই স্প্যানিশ তারকার ইউরো কাপে টিমে না থাকা, বিশ্বকাপে সুযোগ না পাওয়া ও মেসির সঙ্গে একই ক্লাবে খেলা পুরোটা যেন সিনেমার গল্প। বাঁ হাতের চারটে আঙুলে লেখা লাল রং দিয়ে ৩৫, ৯০+, ৩২, ১৯. কারণ জীবনের শুরুতে স্পেনের বিশ্বকাপ জয়ী দলের এই সদস্য ৩৫ ও ৩২ নম্বর জার্সিতে খেলা শুরু করেন। ১৯ বছর বয়েসে শুরু জাতীয় দলের হয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচে অংশগ্রহণ। আর 90+? 2014 সালে অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদের বিরুদ্ধে ৯০+ খেলার আয়ু , তখনই রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে সেই অবিশ্বাস্য গোল রামোসের। বোঝাই যাচ্ছে কিভাবে নিজের খেলা জীবন কে সামনে রেখেই আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যায় এই ৪ নম্বর জার্সিধারি স্প্যানিশ ডিফেন্ডার। কিন্তু বিশ্বকাপে দলে সুযোগ না পেলেও মাঠে যাবেন বলে জানিয়েছেন একটি সাক্ষাৎকারে।
ব্রাজিলিয়ান তারকা নেমার। ফুটবল যেমন ভালোবাসা তেমন নিজের বোন। রাফেল্লা সেনতোষ নিজের বনের ট্যাটু করে রেখেছে নেমার জুনিয়র। ভালোবাসা মিলেই তো বিশ্বাস। সেই বিশ্বাস এনে দিতে পারে জয়। এটাই হয়তো বিশ্বাস। একই ভাবে পিঠে সিংহ মাফিস ডিপের। ডাচ তারকা এখন ভালো ফর্মে, পিঠে রয়েছে বিশাল সিংহ। ট্যাটু যেন বলছে জঙ্গলের রাজা সিংহ আর স্ট্রাইকারের রাজা ডিপে। আরেক ব্রাজিলিয়ান তরুণ তারকা রিচার্ডলিশন। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে টোটেনহামের হয়ে নজর ঘুরিয়েছেন নিজের পারফর্মেন্সে সারা পৃথিবীর ফুটবল প্রেমীদের। এবার প্রথমবার দলে সুযোগ বিশ্বকাপে। এর আগে অনুর্ধ ২০ বিশ্বকাপ জয়ের ব্রাজিলের তারকা এবার ও বাম দিকের বুকে হৃদয়ে ফুটবল ট্যাটু নিয়ে নামবেন মাঠ কাপাতে।
এই গেল বিশ্বাস। এবার বিশ্বাস ভঙ্গের গল্প। জার্মান উইঙ্গার লেরোয় সানে। নিজের পিঠে নিজের গোল করার পরের মুহূর্ত কে তুলে ধরে ট্যাটু। এ সি মিলনের বিরুদ্ধে ৫-৩ জয় ম্যাঞ্চেস্টার সিটির। উল্কি এঁকে ফেললেও ফিরতি লিগে মানে প্রতিপক্ষের মাঠে গিয়ে ৩-১ এ পরাজয়। একটি সাক্ষাৎকারে সানে জানিয়েছিলেন, " ট্যাটু নিয়ে আক্ষেপ আছে।"
লিও মেসি ও রোনাল্ডোর সেরার লড়াই মাঠে ও বিশ্বাসেও। "ট্যাটু থেকে আসতে পারে ইনফেকশন। রক্ত দান করতে চাই আরো । ট্যাটু বানিয়ে রক্তদান করা থেকে বিরত থাকতে চাই না" - একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন বিশ্ব কাঁপানো সি আর সেভেন। মানে ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডো। একটাও ট্যাটু নেই পর্তুগাল তারকা রোনাল্ডোর। একই ভাবে রোনাল্ডোর ভক্ত এবং বিশ্ব কাপ জয়ী ফ্রান্সের তথা ফুটবলের ওয়ান্ডার বয় কিলিয়ান এমবাপে করেননি কোনো ট্যাটু। কারণ তিনি মনে করেন, এখনো ট্যাটু করার মতো বয়েস তাঁর হয়নি। রোনাল্ডোর প্রাক্তন রিয়াল মাদ্রিদের সতীর্থ গ্যারেথ বেল এবার ওয়েলসের হয়ে বিশ্বকাপ অভিযানে অন্যতম মুখ। তিনিও করেননি ট্যাটু। কারণ একবার কানের দুল পরার জন্য নিজের বাবার বকুনি এখনও মনে আছে তাঁর। তাই ট্যাটু করে অশান্তি বাড়াতে চাননা। পোলিশ তারকা লেওয়ানডস্কি জানিয়েছেন এক সাক্ষাৎকারে তিনি ট্যাটু করে শো অফ করতে চাননা।
সব মিলিয়ে বিশ্বকাপ কখনো সাম্বা নাচ দিয়েছে কখনো তিকিতাকা ফুটবল, আবার কখনও আমরা পেয়েছি পাওয়ার ফুটবল, কখনো নতুন ফ্যাশন। কিন্তু ট্যাটু শিল্প শুরু বহুদিন ধরে। মারাদোনার হাতে যেমন ছিলো চে ট্যাটু। আজও চলছে এই শিল্প ফুটবল মাঠে। কেউ বিশ্বাস বিশ্বাস বলেন ট্যাটুকে, আবার কেউ অস্বীকার করেন ট্যাটুকে। কুসংস্কার নাকি আত্মবিশ্বাস এই দ্বন্দে আবার কাতারের মাটিতে ট্যাটু গুলোও লড়বে একে ওপরের সঙ্গে। এখন কে বাজিমাত করে সেটাই দেখার।