কলকাতা: মঙ্গলবার ঘরের মাঠে পাঞ্জাব এফসির বিরুদ্ধে (East Bengal vs Punjab FC) প্রথমার্ধে প্রত্যাশা অনুযায়ী খেলতে না পারায় যে তিনি কতটা বিরক্ত, তা বিরতির সময় ড্রেসিংরুমে এসে দলের খেলোয়াড়দের স্পষ্ট ভাবেই জানিয়ে দেন ইস্টবেঙ্গল কোচ অস্কার ব্রুজোন (Oscar Bruzon)। সেই কথাবার্তাতেই শেষ পর্যন্ত তাতিয়ে তোলে ফুটবলারদের। দ্বিতীয়ার্ধে যে ভাবে তারা ঘুরে দাঁড়ায়, তা আইএসএলের ইতিহাসে সেরা প্রত্যাবর্তনের ম্যাচগুলির অধ্যায়ে উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা থাকবে।
এ দিন যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে লিগ টেবলে সেরা ছয়ে থাকা পাঞ্জাব এফসি-র বিরুদ্ধে দু’গোলে পিছিয়ে গিয়েও শেষ পর্যন্ত ৪-২-এ জেতে লাল-হলুদ বাহিনী। আইএসএলের আসরে এ রকম জয় কখনও দেখেননি ইস্টবেঙ্গল সমর্থকেরা। প্রথম দলের চার খেলোয়াড়কে ছাড়া খেলতে নামা ইস্টবেঙ্গলের এমন নাটকীয় জয় চলতি লিগের সেরা অঘটনগুলির তালিকায় অবশ্যই থাকবে।
এমন স্মরণীয় জয়ের পর সাংবাদিকদের কোচ অস্কার বলেন, 'প্রথমার্ধে দলের খেলা দেখে আমি খুব হতাশ হয়েছিলাম। কিছুই ঠিক হচ্ছিল না আমাদের। আমরা লড়াই করার জায়গায় ছিলাম না তখন। ঘরের মাঠে সমর্থকদের সামনে খেলছি, অথচ এই পারফরম্যান্স! বিরতিতে ছেলেদের বলি, দ্বিতীয়ার্ধেও যদি এমনই বাজে পারফরম্যান্স চলতে থাকে, তা হলে আমাদের পক্ষে পুরো ৯০ মিনিটও দাঁড়ানো মুশকিল হবে। দ্বিতীয়ার্ধে ছবিটা পুরো পাল্টে যায়। প্রথমার্ধে যা যা ঠিক হচ্ছিল না, বিরতির পর সেগুলোই ঠিক ঠিক হতে শুরু করে'।
স্প্যানিশ কোচ মনে করেন, প্রথমার্ধে মনস্তাত্বিক সমস্যায় ভুগছিলেন তাঁর দলের ফুটবলাররা। তিনি বলেন, 'আসলে সমস্যাটা টেকনিক বা ট্যাকটিক্সে ছিল না, ছিল আত্মবিশ্বাস, সাহসিকতা ও মানসিকতায়। দ্বিতীয়ার্ধে ছেলেরা যা খেলেছে, তার প্রশংসা করতেই হবে। ওরা সিংহের মতো খেলেছে। দ্বিতীয়ার্ধে যে পরিবর্তনগুলো করেছি, প্রতিটিই কাজে লেগেছে। স্থানীয় ছেলেরা, যারা নিয়মিত অনুশীলনে ভাল করে অথচ ম্যাচে নামার সুযোগ পায় না, তারাই আজ বাজিমাত করে দিয়েছে। আশা করি, ইস্টবেঙ্গলের ইতিহাসে এই ঘুরে দাঁড়ানোর ঘটনা উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা থাকবে'।
মঙ্গলবার প্রথমার্ধে ৪০ মিনিটের মধ্যে হাঙ্গেরিয়ান ফরোয়ার্ড আসমির সুলজিক ও আর্জেন্টাইন মিডফিল্ডার নর্বের্তো ভিদালের গোলে এগিয়ে যায় পাঞ্জাব। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুর দিকে পিভি বিষ্ণু রিজার্ভ বেঞ্চ থেকে নামার পরেই ইস্টবেঙ্গলের মেজাজ পুরো বদলে যায় এবং মাত্র ২১ মিনিটের মধ্যে চার-চারটি গোল করে জয়ের দিকে এগিয়ে যায় তারা। দ্বিতীয়ার্ধের দ্বিতীয় মিনিটেই সেটপিস গোল করে প্রথমে ব্যবধান কমান হিজাজি মাহের। এই গোলের আট মিনিট পরেই সমতা আনেন বিষ্ণু। ৬০ মিনিটের মাথায় পাঞ্জাবের ডিফেন্ডার সুরেশ মিতেইয়ের নিজ গোলে এগিয়ে যায় লাল-হলুদ বাহিনী, যে ব্যবধান ৬৭ মিনিটের মাথায় বাড়িয়ে নেন ইস্টবেঙ্গলের ফরোয়ার্ড ডেভিড লালনসাঙ্গা।
নাওরেম মহেশের মাথায় সজোরে বল লাগায় তিনি কিছুটা অচৈতন্য হয়ে পড়েন বলে বিষ্ণুকে নামান বলে জানান লাল-হলুদ কোচ। সেই ঘটনার কথা শুনিয়ে তিনি বলেন, 'মহেশের মাথার পিছনে বল লাগায় ও কিছুটা অচেতন হয়ে পড়ে। বিরতির পরে আমি আর ঝুঁকি নিতে চাইনি। তাই ওকে তুলে বিষ্ণুকে নামাই। তাতে ভালই হয়েছে। দ্বিতীয়ার্ধে আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে ওর অবদান যথেষ্ট ছিল। তবে মহেশের কোনও গুরুতর চোট হয়নি'।
বিষ্ণু নামার পরই যে ছবিটা বদলে যায়, তা স্বীকার করতে দ্বিধা করেননি অস্কার। তবে তিনি মনে করেন, এটাই একমাত্র কারণ নয়। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'এটা ঠিকই যে, বিষ্ণু নামার পর থেকেই ছবিটা পুরো বদলে যায়। বিশেষ করে প্রথমার্ধে আমাদের উইংপ্লে-তে যে সমস্যা হচ্ছিল, দ্বিতীয়ার্ধে তা আর হয়নি। বিষ্ণু একদিকটা ধরে নেওয়ায় ব্যাপারটা অনেক কার্যকরী হয়। তা ছাড়া আরও একটা সুবিধা হয়েছে, ক্লেটন আজ শুধু যে আক্রমণে অংশ নিয়েছে, তা নয়, মাঝমাঠেও অনেকটা চাপ নিয়েছে। সে জন্য দ্বিতীয়ার্ধে মাঝমাঠে আমাদের নিয়ন্ত্রণও ওদের চেয়ে বেশি ছিল। গত কয়েকদিন ধরে আমরা যা পরিশ্রম করেছি, তারই প্রতিফলন দেখা গিয়েছে আজ দ্বিতীয়ার্ধে'।
দলকে যে আরও আক্রমণাত্মক ও দাপুটে করে তুলতে চান তিনি, তা স্পষ্ট জানিয়ে অস্কার বলেন, 'আমি নিজে আক্রমণাত্মক ফুটবলই পছন্দ করি এবং সব সময় চাই যে, আমার দল প্রতিপক্ষের চেয়ে বেশি গোলের সুযোগ তৈরি করুক। জিততে গেলে আমাদের ঝুঁকি নিতেই হবে। তবে ঝুঁকির পরিমান যত কম হয়, ততই ভাল। রক্ষণে শক্তি বজায় রেখে আক্রমণে ওঠাই আমার নীতি। সে জন্য আমি চাই দলের ফুটবলারদের আত্মবিশ্বাস বাড়ুক। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই কাজ করছি। আমি চাই, একদিন আমার দল ম্যাচের ৭০ শতাংশ বল দখলে রাখবে এবং প্রতিপক্ষের অর্ধেই বেশির ভাগ সময় খেলবে। এখনই সেটা হওয়া কঠিন। কারণ, এরকম আধিপত্য বিস্তার করার জন্য দলের সব খেলোয়াড়দের যে জায়গায় থাকা উচিত, সবাই সেই জায়গায় নেই'।
এমন সাফল্যের দিনে সমর্থকদের খুশির খবরও দিলেন ইস্টবেঙ্গলের কোচ। সেটি গ্রিক ফরোয়ার্ড দিমিত্রিয়স দিয়ামান্তাকসকে নিয়ে। কী সেই খবর? অস্কার বলেন, 'দিমির মতো গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়কে অবশ্যই দলে চাই। আজকেই ওকে হয়তো কয়েক মিনিটের জন্য নামানো যেত। তবে আজ ম্যাচের পরিস্থিতি দেখে ওকে আর নামাইনি। পরের দুটো ম্যাচও খুব গুরুত্বপূর্ণ। ওকে ওই ম্যাচগুলোতে নামাব'।
সমর্থকদের ধন্যবাদ দিয়ে তিনি বলেন, 'যখন আমরা খারাপ খেলছিলাম, তখনও আমাদের জন্য তারা গলা ফাটিয়েছে। আজ দ্বিতীয়ার্ধে যেমন খেলেছি আমরা, এ রকম আরও খেলতে পারব, যদি সমর্থকেরা পাশে থাকে। ওদের মতো আমরাও এই দলের জন্য গর্বিত। সেই গর্ব যেন বজায় থাকে'।
(তথ্য: আইএসএল মিডিয়া)
আরও পড়ুন: পিছিয়ে পড়েও অনবদ্য লড়াই, পাঞ্জাবকে হারিয়ে মরশুমের তৃতীয় জয় ইস্টবেঙ্গলের