কলকাতা: শুক্রবার ৮ জুলাই। আর ৮ জুলাই মানেই গোটা দেশের পাশাপাশি আপামর বাঙালির আবেগের দিন। কারণ, ৮ জুলাই সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের (Sourav Ganguly) জন্মদিন। সেই সৌরভ, যিনি প্রত্যেক বাঙালির মনে বিশ্বাস গেঁথে দিয়েছেন, হ্যাঁ, চেষ্টা করলে আমরাও পারি।


বাল্যবন্ধুও ইংল্যান্ডে


আর এ বছরের ৮ জুলাই আরও স্পেশ্যাল। কারণ, জীবনের হাফসেঞ্চুরি পূর্ণ করলেন বাঙালির চিরকালীন আইকন সৌরভ। জন্মদিনে তিনি রয়েছেন লন্ডনে। প্রবাসেই পালিত হচ্ছে মহারাজের পঞ্চাশ। বিশেষ এই দিনে এবিপি লাইভে সৌরভের অজানা গল্প শোনালেন বাল্যবন্ধু, কিংবদন্তি ক্রিকেট প্রশাসক, প্রয়াত জগমোহন ডালমিয়ার (Jagmohan Dalmiya) কন্যা বৈশালি ডালমিয়া (Baishali Dalmiya)।


প্রথম সাক্ষাৎ


বেহালার বীরেন রায় রোডের গঙ্গোপাধ্যায় ও ১০ নম্বর আলিপুর রোডের বাসিন্দা ডালমিয়া পরিবারের বন্ধুত্ব দীর্ঘদিনের। সেই সূত্রেই সৌরভের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল বৈশালির। প্রথম সাক্ষাতের স্মৃতি? লন্ডনের বাকিংহ্যাম প্যালেসের সামনে ঘুরতে ঘুরতে বৈশালি বলছিলেন, 'সৌরভকে কবে প্রথম দেখেছিলাম, ঠিক মনে পড়ছে না। ৪৫ বছর আগেকার কথা তো। বা হয়তো তারও আগের। সৌরভের তখন তিন বা সাড়ে তিন বছর বয়স। আমার একটা বার্থ ডে পার্টি ছিল। পরে ছবিতে দেখেছিলাম। আমাদের বাড়িতে সৌরভরা সকলে এসেছিল। সৌরভ, স্নেহাশিস সকলে। সেই প্রথম দেখা। তার আগেও দেখা হয়ে থাকতে পারে।' যোগ করলেন, 'এক সঙ্গে বড় হয়েছি দুজনে। ওর ছোটবেলার বিভিন্ন গল্প মনে আছে। ছোটবেলাই বুঝতে পেরেছিলাম ও বড় হয়ে ডাকাবুকো ও দারুণ একজন ক্রিকেটার হতে চলেছে।'


ইডেনের অশান্তিতেও 'কুল'


শৈশব থেকে বন্ধুত্ব। ইডেনে (Eden Gardens) একসঙ্গে ম্যাচ দেখা, আড্ডা মারা, ঘোরাঘুরি। সৌরভ আর বৈশালির বেড়ে ওঠাও একসঙ্গে। বাল্যবন্ধুর সঙ্গে অনেক মজার স্মৃতিও রয়েছে বৈশালির। 'একটা মজার ঘটনা বলি। ইডেনে আমরা ও সৌরভরা খেলা দেখতে গিয়েছি। আমি, মা, বাবা, চণ্ডী কাকা (চণ্ডী গঙ্গোপাধ্যায়), সৌরভ, নিরূপা কাকিমা, সকলে মিলে হইহই করে গিয়েছি। খুব আনন্দে কাটত সেই সময়গুলো। সেইরকমই একটা ম্যাচের কথা বলি। সৌরভের বয়স তখন ১৩। ম্যাচে একটা কোনও গোলমাল হয়েছিল। তখন ক্রিকেট মাঠে এত প্রযুক্তি আসেনি। আম্পায়ারের কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল। গ্যালারি থেকে কমলালেবু ছোড়া, চেঁচামেচি চলছে। চারদিক থেকে শুধু কমলালেবু উড়ে আসছে। সবাই খুব সিঁটিয়ে রয়েছি,' প্রায় সাড়ে তিন দশক পুরনো স্মৃতি হাতড়ে বলছিলেন বৈশালি।


তারপর? বৈশালি বললেন, 'হঠাৎ আমাদের দিকেও একটা কমলালেবু উড়ে এল। সৌরভ সামনে বসেছিল। ও লাফিয়ে উঠে সেটা লুফে নিল। আমরা ভাবলাম, ভাগ্যিস ধরল, নাহলে আমাদের গায়ে লাগত। ও বাবা! সৌরভ দেখলাম সেই লেবু মুহূর্তে ছাড়িয়ে খেয়ে নিল। আমাদের ভারি মজা লেগেছিল। আপেল, কমলালেবু উড়ে আসছে আর ও লুফে নিয়ে খাচ্ছে। যেন কোনও কিছুরই পরোয়া করে না। তখন থেকেই সব ব্যাপারে ও ভীষণ কুল।'


লর্ডসে পরীক্ষা


সৌরভের কেরিয়ারের নানা চড়াই উৎরাই সামনে থেকে দেখেছেন। লর্ডসে (Lords) সৌরভের মহারাজকীয় টেস্ট অভিষেকের স্মৃতি এখনও টাটকা বৈশালির মনে। মাঝে ২৬ বছর কেটে গিয়েছে। বৈশালির কাছে যেন এই সেদিনের ঘটনা। বলছিলেন, 'লর্ডসে সৌরভের অভিষেক কেউই ভুলতে পারবে না। তবে আমাদের কাছে সেটা বিশেষ মুহূর্ত ছিল। বাবাকে (জগমোহন ডালমিয়া) প্রথম দেখেছিলাম স্নায়ুর চাপে ভুগতে। তার আগে কোনওদিন বাবাকে টেনসড দেখিনি। অনেকটা যেন মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী বাবা-মায়ের মতো। যতদিন ছেলে-মেয়েরা স্কুলে পড়ে, পরীক্ষা দেয়, ততদিন বাবা-মায়েদের খুব একটা স্নায়ুর চাপ থাকে না। তবে ছেলেমেয়েদের মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে বাবা-মায়েরাও স্নায়ুর চাপে ভোগে। বাবাকে দেখে আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। তবে সেঞ্চুরি সম্পূর্ণ হওয়ার পর বাবার চেয়ে খুশি আর কেউ হয়নি।' বৈশালি যোগ করলেন, 'সৌরভের প্রথমবার টেস্ট খেলে সেঞ্চুরি করাটা বাবার কাছে বিশেষ একটা ব্যাপার ছিল। মনে হয়েছিল বাবাই যেন কিছু জিতেছে। আমাদের সকলের কাছেই গর্বের ব্যাপার ছিল। সকলে মিলে সোফায় বসেছিলাম। উত্তেজনায় হাতের নখ খাচ্ছিলাম। সেঞ্চুরি হতেই স্বস্তি।'


হাল ছেড়ো না বন্ধু


সৌরভের নাছোড় মানসিকতার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছোটবেলার বন্ধু। বৈশালি বলছেন, 'ও নিজে বলে বয়স একটা সংখ্যা। ও প্রমাণ করে দিয়েছে, বয়স সত্যিই স্রেফ সংখ্য। আসল হচ্ছে কীভাবে নিজেকে মেলে ধরছো। আমি সকলকে বলব, ওকে দেখে শিখুন। ও কিংবদন্তি। কমবয়সীদের বলব, ওকে দেখে শেখো। ও হেরে যায় না। ও সবসময়ই প্রত্যাবর্তন ঘটিয়েছে। নিজের উপস্থিতি বুঝিয়েছে। হারতে শেখেনি এই মানুষটি।'


সৎ ও দায়িত্ববান


সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় নামটা শুনলে প্রথম কোন শব্দটা মাথায় আসে? বৈশালি বলছেন, 'সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় নামটা শুনলে প্রথমেই মনে হয় একজন সৎ ও দায়িত্ববান মানুষ। ওর ওপর সব মানুষ নির্ভর করতে পারে। যখন ও জাতীয় দলের নেতৃত্ব দিয়েছে, তখন সকলে ওকে ভরসা করেছে। ওর কথা শুনলেই মনে হয় এ সৎ। সত্যনিষ্ঠ। ওর নামের সঙ্গেই ব্যাপারটা জড়িয়ে রয়েছে।'



জনপ্রিয়তার শীর্ষে


বন্ধু সৌরভ, ক্রিকেটার সৌরভ নাকি ক্রিকেট প্রশাসক সৌরভ, কোন সত্তা আপনার সবচেয়ে প্রিয়? বৈশালির জবাব, 'আমার তো মনে হয় ও মানুষটাই জনপ্রিয়। প্রত্যেক মানুষ ওকে ভালবাসে। ওকে দেখলে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। সত্তর বছরের বয়স্ক কেউ হোক বা সাত বছরের বাচ্চা, ওকে দেখলে খুশি হয়ে পড়ে। ওর মধ্যে একটা আলাদা ইতিবাচক শক্তি আছে। যা মানুষকে ওকে নিয়ে মুগ্ধ করে তোলে। এই মানুষটা সকলের মন জয় করতে পারে।' জীবনের হাফসেঞ্চুরি সম্পূর্ণ করা বন্ধুকে বৈশালির বার্তা, 'জন্মদিনে অনেক শুভেচ্ছা রইল। সৌরভ আরও বড় হোক। বড় হওয়ার কোনও শেষ নেই। সব সময় আনন্দে থাকুক। সুস্থ থাকুক।'


আরও পড়ুন: ইডেনের গ্যালারিতে অশান্তি, ছোড়া হচ্ছে কমলালেবু, লুফে খোসা ছাড়িয়ে মুখে পুরে দিলেন সৌরভ!