কুন্তল চক্রবর্তী,  নয়াদিল্লি: পিতৃত্বকালীন ছুটিতে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সিরিজের প্রথম টেস্ট খেলে দেশে ফিরে এসেছেন ভারতীয় দলের অধিনায়ক বিরাট কোহলি। প্রথম টেস্টে ভালো অবস্থাতে থেকেও দ্বিতীয় ইনিংসে লজ্জাজনক ব্যাটিং বিপর্যয়ে ম্যাচ খোয়াতে হয়েছে কোহলির ভারতকে। প্রথম টেস্টে এই ব্যাটিং বিপর্যয়ের পর তো কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ সিরিজে ভারতকে খরচের খাতায় ফেলে দিয়েছিলেন। সিরিজের বাকি টেস্টগুলিতে ভারতের নেতৃত্ব দিচ্ছেন আজিঙ্কা রাহানে। প্রথম টেস্টে বিপর্যয়ের ধাক্কা সামলে দ্বিতীয় টেস্টে ঘুরে দাঁড়িয়েছে ভারত। এই টেস্টে অস্ট্রেলিয়াকে বিধ্বস্ত করে জয়ী হয়েছে ভারত।  বুক চিতিয়ে দুরন্ত সেঞ্চুরি করে দলের ব্যাটিংয়ের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিলেন রাহানে। তাছাড়া টসে হেরে ফিল্ডিং করতে নেমে মুম্বইকরের বোলার পরিবর্তন ও ফিল্ড সাজানোর ক্ষেত্রে মুন্সিয়ানা বিশেষজ্ঞদের নজর কেড়ে নিয়েছে। বিরাটের অনুপস্থিতিতে দুরন্তভাবে দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন রাহানে।


কয়েক বছর আগেও মনে করা  হচ্ছিল যে, তিন ফরম্যাটেই ভারতীয় ক্রিকেটের বিরাট কোহলির পর সবচেয়ে ভালো ব্যাটসম্যান রাহানে। হঠাৎ করেই টেস্ট ছাড়া অন্য দুটি ফরম্যাট থেকে হারিয়ে যেতে থাকেন। এক্ষেত্রে টিম ম্যানেজমেন্টের একটা অংশ মনে করছিল, সীমিত ওভারের ক্রিকেটে রাহানে দ্রুত রান করতে পারেন না। কিন্তু এই দ্রুত রান নিয়ে  প্রাক্তন ক্রিকেটারদের একটা অংশের বক্তব্য, একজন ব্যাটসম্যান ১০০ বলে ৮০ বা ৯০ রান করছে, এমনটা দেখলে চলবে না। বরং দেখতে হবে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কেমন খেলছে। ভারতের মাটিতে ভালো স্ট্রাইক রেখে খেলছেন, এমন  ব্যাটসম্যান অনেক রয়েছেন। কিন্তু দেখতে হবে বিদেশের মাঠে প্রতিকূল পরিস্থিতি কেমন পারফর্ম করেন। যেমন গত বছরের বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে রাহানের অভাব অনুভূত হয়েছে। নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ২৪০ রান তাড়া করতে পারেনি ভারত।  এক্ষেত্রে বিজয় শঙ্করের মতো খেলোয়াড়রা এমন চাপের পরিস্থিতি পারফর্ম করতে পারেননি। শুধু বিজয় শঙ্করই নন, অনেক তাবড় ব্যাটসম্যানই এক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছেন।

কিন্তু বারবার দেখা গিয়েছে, বিদেশের মাঠে রাহানের পারফরম্যান্স খুবই ভালো। ডারবানে ৯৬-ই হোক, বা লর্ডসে সবুজ পিচে অ্যালিস্টার কুক যখন টস জিতে ভারতকে ব্যাট  করতে পাঠিয়েছিলেন, ভারতের ২৮ রানে ৬ উইকেট পড়ে গিয়েছিল। তখন সেখানে ১০৩ রান করেছিলেন রাহানে। ২৯৫ রানে নিয়ে যান ভারতের ইনিংসকে। ওই ম্যাচ জিতেছিল ভারত।  তারপর কিংস্টন বা ওয়েলিংটনেও সেঞ্চুরি রয়েছে রাহানের। এর আগেও  মেলবোর্নে সেঞ্চুরি করেছেন। বিরাট কোহলির সঙ্গে দারুণ পার্টনারশিপ করেছিলেন। ২০১৮-তে জোহানেসবার্গ টেস্টে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ভুবনেশ্বর কুমারকে সঙ্গে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পার্টনারশিপ করেছিলেন। সিরিজে ২-০ পিছিয়ে ছিল ভারত। এই অবস্থায় জোবার্গের ওই টেস্টে ভারত জিতেছিল। বারেবারেই দেখা গেছে যে,  প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ভালো খেলেছেন রাহানে। এমন একজন ব্যাটসম্যান কি তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা পেয়েছেন? এর উত্তর হল-না। কারণ, রাহানে ততটা সরব নন। অনেকে ক্রিকেটারকেই নিজের অধিকার নিয়ে সরব হতে দেখা গিয়েছে। কিন্তু রাহানে সে রকম চরিত্র নন। কোনও কারণে বাদ পড়লে তিনি বলে থাকেন, আরও ভালো পারফর্ম করতে হবে।

রাহানে বরাবরই মিতভাষী। কিন্তু তার মানে এমন নয় যে, তাঁর নেতৃত্বের দক্ষতা নেই। এর আগে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সিরিজে ধর্মশালা টেস্টের প্রসঙ্গ আসবে। ২০১৭-র চার ম্যাচের সিরিজ   ১-১ অবস্থায় ছিল। চতুর্থ টেস্ট ছিল নির্ণায়ক। চোটের কারণে ওই টেস্টে খেলেননি কোহলি। রাহানে ওই ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ওই টেস্ট ম্যাচে রাহানে তাঁর নেতৃত্বের দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছিলেন। ওই ম্যাচে প্রথম ইনিংসে ৪৬ ও দ্বিতীয় ইনিংসে অপরাজিত ৩৮ করেছিলেন। দলের সূত্রের খবর, ওই ম্যাচে কুলদীপ যাদব খেলুন, এমনটা চাননি কোহলি।  কিন্তু তৎকালীন কোচ অনিল কুম্বলে ও রাহানে কুলদীপকে খেলানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ওটাই ছিল কুলদীপের অভিষেক টেস্ট। ম্যাচে চার উইকেট নিয়েছিলেন কুলদীপ। ম্যাচ উইনিং পারফর্ম করেছিলেন এই স্পিনার।  ওই টেস্টেই ভারতীয় ক্রিকেটে কুলদীপের উদয় হয়েছিল। ধর্মশালা টেস্টে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে সিরিজ জিতেছিল ভারত।  পরামর্শ না শোনায় কুম্বলে-রাহানের সঙ্গে  কোহলির সঙ্গে সম্পর্কে চিড় ধরতে শুরু করেছিল বলে সূত্রের খবর।

রাহানে শান্ত স্বভাবের, ক্রিকেটারদের খুব ভালো চেনেন।  তাঁর এই শান্ত স্বভাবের প্রতিফলন ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি  নেতৃত্বের ভার যখন মাঝেমধ্যে সামলেছেন, তখন সেক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়েছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নেতৃত্বের খুব একটা সুযোগ পাননি। মুম্বইয়ের ক্রিকেটারদের সহজাত নেতৃত্বগুণ রয়েছে। যে কোনও কঠিন পরিস্থিতিতেই ভালো পারফর্ম করতে পারেন, যা ওপর থেকে দেখলে বোঝা যায় না। রাহানেও সে রকম। চুপচাপ মানে এমন নয় যে, রাহানে তিনি লড়াই করতে জানেন না। কোহলির স্বভাবের থেকে একেবারেই আলাদা। কোহলি আক্রমণাত্মক। অনেক ক্ষেত্রে প্রাক্তন ক্রিকেটাররা সমালোচনা করলে পাল্টা মন্তব্য করে দিতে দ্বিধা করেন না কোহলি। মাঠের মধ্যে আগ্রাসী মানসিকতার প্রতিফলন বারেবারেই দেখা গিয়েছে কোহলির মধ্যে।   রাহানের মধ্যে তা না থাকলেও এটা নয় যে, তিনি কঠিন পরিস্থিতিতে পারফর্ম করতে পারেন না। রাহানে কিন্তু বারবার প্রমাণ করেছেন, কঠিন পরিস্থিতিতে, বিশেষ করে, বিদেশের মাঠে ভালো ক্রিকেট খেলার ক্ষমতা তাঁর রয়েছে। যেটা হল টেস্ট ক্রিকেটের আসল পরীক্ষা। কাজেই কোথাও না কোথাও এই ম্যাচটা বদলে দিতে পারে রাহানের ক্রিকেট কেরিয়ার। সমতা ফেরানোর পর যদি চলতি সিরিজটা জিতিয়ে দিতে পারেন, তাহলে কোথাও না কোথাও ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেট দলের ভালো অধিনায়ক হতে পারেন রাহানে, এমন একটা আওয়াজ উঠতে পারে। প্রাক্তন ক্রিকেটারদের অনেকেই এক্ষেত্রে সরব হতে পারেন।

সেইসঙ্গে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে বিশেষ করে ৫০ ওভারের তাঁকে দলে ফেরানোর দাবিও জোরদার হবে। হতে পারে, দেশের মাঠে ৩০০-৪০০ রান হয়ে যাচ্ছে, সেখানে হয়ত তাঁর অভাব অনুভূত হয় না। কিন্তু কঠিন পরিস্থিতিতে, যেমন যেখানে বল সিম করবে, সুইং  করবে, সেখানে রাহানের যে ভারতীয় দলে প্রয়োজন, তা আবার অনুভূত হচ্ছে। কাজেই মেলবোর্নের ইনিংসের হাত ধরে ভারতীয় ক্রিকেটে রাহানের যে গুরুত্ব হারিয়ে যাচ্ছিল, তা আবার পাদপ্রদীপের আলোয় চলে এল।