কলকাতা: ত্রয়োদশ আইপিএলে শুরু হতে আর বেশিদিন বাকি নেই। চেন্নাই সুপার কিংস ছাড়া বাকি সব দলই সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে পৌঁছে প্রস্তুতিতে নেমে পড়েছে। বাংলার দল কলকাতা নাইট রাইডার্স প্রস্তুতি শিবির করছে আবু ধাবিতে। ক্রিকেটার ও সাপোর্ট স্টাফেরা থাকছেন বিশেষ একটি হোটেলে। দ্য রিটজ কার্লটনে। কেন? কারণ, নাইট শিবির এই হোটেলকে পয়মন্ত মনে করে। ২০১৪ সালে যখন আইপিএলের প্রথমার্ধ সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে হয়েছিল, আবু ধাবির এই হোটেলেই ছিলেন নাইটরা। আর সেবার ট্রফি জিতেছিল শাহরুখ খানের দলই।

জার্সির রং হোক বা টিমহোটেল-বাস, নাইট শিবিরে এরকম অনেক বিষয়কেই পয়মন্ত মনে করা হয়। ইডেনে কেকেআরের ম্যাচ থাকলেই অন্যতম টিম মালকিন জুহি চাওলা ছোটেন কালীমন্দিরে। প্রসাদী ফুল নিয়ে মাঠে যান। শুধু কেকেআর-ই বা কেন, আইপিএলে প্রায় সমস্ত দলই এরকম অনেক সংস্কারে বিশ্বাসী। প্রায় সব দল ও তাদের ক্রিকেটারেরাই মনে করে যে, নির্দিষ্ট কিছু বিষয় ফিরিয়ে দিতে পারে ভাগ্য। দলগুলোর এই সংস্কারের সন্ধান পেতে আইপিএল খেলা বাংলার তিন ক্রিকেটারের সঙ্গে কথা বলল এবিপি আনন্দ।



অশোক ডিন্ডা

আইপিএলে প্রত্যেক দলের প্রায় সব ক্রিকেটারেরাই বিভিন্ন সংস্কারে বিশ্বাসী। আমি নিজে কলকাতা নাইট রাইডার্স, পুণে ওয়ারিয়র্স, দিল্লি ডেয়ারডেভিলস, রাইজিং পুণে সুপারজায়ান্টস, রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের হয়ে আইপিএল খেলেছি। প্রায় সব ফ্র্যাঞ্চাইজিতেই দেখেছি, ম্যাচ চলাকালীন দল ভাল জায়গায় থাকলে ড্রেসিংরুম বা ডাগআউটে কাউকে নড়াচড়া করতে দেওয়া হয় না। শৌচালয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হলে সেটা বিরতিতে সারতে হয়। অনেকে হোটেলে নির্দিষ্ট নম্বর রুম নেয়। অনেকে আবার হোটেলের নির্দিষ্ট তলায় ঘর বেছে নেয়। এরকম অনেক ক্রিকেটার রয়েছে যারা একটা জার্সি পরে ব্যাটিং করে, অন্য জার্সি পরে ফিল্ডিং। আমি নিজেও কিছু ব্যাপার মেনে চলতাম। টিমবাসে বরাবর পিছনের দিক থেকে দু নম্বর সারিতে জানলার ধারে বসি। বল করার সময় হেডব্যান্ড, রিস্টব্যান্ড পরি।





জাতীয় দলে, পরে আইপিএলে আরপিএসে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির নেতৃত্বে খেলেছি। মাহি ভাইকে দেখেছি, টিমবাসে একটা নির্দিষ্ট জায়গাতেই বসে। ডানদিকের কোণায় পিছনের সিটে। ক্যাপ্টেনরা সাধারণত টিমবাসের সামনে বসে। মাহি ভাই উল্টো। পিছনেই বসবে। আমি একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন ও পিছনের সিটে বসে। মজার জবাব পেয়েছিলাম। মাহি ভাই বলেছিল, ও যখন প্রথম জাতীয় দলে ঢুকেছিল, বাসে উঠে দেখেছিল, এই সিটটাই ফাঁকা আছে। সেই থেকে জাতীয় দল হোক বা আরপিএস, চেন্নাই সুপার কিংস। মাহি ভাই ওই জায়গাতেই বসে।





দাদিরও (সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়) এরকম অনেক বিশ্বাস ছিল। বাংলা দলে, পরে আইপিএলে কেকেআর-পুণে ওয়ারিয়র্সেও দেখেছি, দাদি জার্সি নম্বর নিয়ে বিশেষ সচেতন। ছন্দ না পেয়ে জার্সি নম্বর পাল্টেওছিল। ব্যাটের গ্রিপ নিয়েও দাদির পয়মন্ত কিছু বিশ্বাস ছিল। আইপিএল না হলেও আর একটা ঘটনা মনে পড়ছে। ২০১২ সালের এশিয়া কাপে বিরাট কোহলি প্রথম ম্যাচে রান পায়নি। পরের ম্যাচে আমার ট্রাউজার্স পরে সেঞ্চুরি করে। আমাকে বলেছিল, ট্রাউজার্স আনতে ভুলে গিয়েছে ও। তারপর আমাকে ব্যাগ থেকে ওর একটা নতুন ট্রাউজার্স দিয়ে দিল। পরে বুঝেছিলাম, আমার ট্রাউজার্স ওর কাছে পয়মন্ত হয়ে গিয়েছিল।



মনোজ তিওয়ারি

কেকেআরের ২০১২ সালের চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য ছিলাম। পাশাপাশি কিংস ইলেভেন পঞ্জাব, আরপিএসের হয়েও খেলেছি। বিদেশি কোচ ও ক্রিকেটারদেরও দেখেছি, অনেক ব্যাপারকে ওরা পয়মন্ত মনে করে। ড্রেসিংরুমে প্রত্যেকের বসার জায়গা নির্দিষ্ট হয়ে যায়। ড্রেসিংরুমে যে যেখানে প্রথম দিন বসে, গোটা টুর্নামেন্টে সেই জায়গাতেই বসে কাটায়। অনেকে আছে আউট হওয়ার পরেও প্যাড খোলে না। গৌতম গম্ভীর যেমন। ২০১২ সালের আইপিএলের ফাইনালে প্রথম ওভারেই ও আউট হয়ে গিয়েছিল। তারপর গোটা ম্যাচে ও প্যাড খোলেনি। ম্যাচটা কেকেআর জিতেছিল। প্রথমবার আইপিএল চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম আমরা।









অনেক প্লেয়ার আছে যারা বাঁ পায়ে আগে প্যাড পরে, অনেকে আছে থাই প্যাড আগে পরে। অনেকে আবার চার বা পাঁচে ব্যাট করলেও প্রথম থেকে হেলমেট পরে থাকে। কিংস ইলেভেন পঞ্জাবে অ্যান্ড্রু টাইকে দেখেছি। প্রত্যেক ম্যাচে আলাদা আলাদা প্রিন্টেড মোজা পরে নামত। আমি নিজে আগে থাই প্যাড পরি, তারপর বাঁ পায়ের প্যাড পরি। বাংলার ম্যাচেও দল ভাল জায়গায় থাকলে যে যেখানে বসে থাকে, সেখানেই বসতে বলা হয়। এই বিশ্বাসগুলো সকলের মধ্যে এমন থাকে যে, কাউকে আলাদা করে বলে দিতে হয় না।



দেবব্রত দাস

কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে খেলার সুবাদে বেশ কিছু ক্ষেত্রে দেখেছি, পয়মন্ত ব্যাপার-স্যাপার দলগুলো কীভাবে মেনে চলে। ২০১৩ সালের একটা ঘটনা মনে পড়ছে শুরুতেই। কেকেআরের ম্যাচ ছিল ইনদওরে। ওখানকার বিমানবন্দরে গিয়ে দেখি, দাঁড়িয়ে থাকা টিমবাস ও তার চালককে চেনা চেনা লাগছে। তারপর টের পাই, কলকাতাতেও এই বাসই আমাদের হোটেল থেকে মাঠে ও মাঠ থেকে হোটেলে নিয়ে যায়। সেটাকে এত পয়মন্ত মনে করা হতো যে, বাইরে খেলা থাকলেও আমাদের জন্য সেই বাস কলকাতা থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ইনদওরে বাসের চালক বলেছিলেন, আগের দিন রাতে কলকাতা থেকে উনি রওনা হয়ে গিয়েছিলেন। ওড়িশাতে খেলতে গিয়েও ওই টিমবাস পেয়েছি। ওই বাসে করেই বিমানবন্দর থেকে হোটেলে যেতাম, তারপর মাঠেও যেতাম।



চেন্নাই সুপার কিংস আবার ভিজিটিং টিমের ড্রেসিংরুম বানায় নিজেদের ইচ্ছে মতো। হতে পারে কোনও বিশ্বাস কাজ করে এর পিছনে। একবার আমরা চেন্নাইয়ে খেলতে গিয়ে দেখি, ড্রেসিংরুমের সব দেওয়াল কাচে মোড়া। একটা জায়গাও ফাঁকা নেই। পরে আমাদের সিইও বেঙ্কি মাইসোর সব আয়না কেকেআর ফ্ল্যাগ দিয়ে ঢেকে দেন।



২০১৮ সালে নির্বাসন কাটিয়ে যখন আইপিএলে ফিরল সিএসকে, চেন্নাইয়ে জল সমস্যার জন্য পুণেতে হোম ম্যাচ খেলেছিল ধোনিরা। চেন্নাইয়ে ওরা নিজেদের জন্য যে রকম ড্রেসিংরুম বানায়, পুণেতেও হুবহু সেইরকম ড্রেসিংরুম পাঠিয়েছিল।



সূর্যকুমার যাদব মুম্বই ইন্ডিয়ান্স থেকে কেকেআরে এসেছিল। ও গল্প করত যে, মুম্বই দলও অনেক সংস্কার মেনে চলে। মাঠে কে আগে ঢুকবে, মাঠ থেকে কে আগে টিমবাসে উঠবে, সবই ঠিক করা থাকে। মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের মালকিন নীতা অম্বানি প্রত্যেক ম্যাচে একইরকম শার্ট পরে মাঠে খেলা দেখতে যান। শুনেছি চেন্নাই সুপার কিংসে ম্যাচের দিন টিমমিটিং হতো না। বড় জোর ৩-৪ মিনিটের একটা জমায়েত। মহেন্দ্র সিংহ ধোনি বা কোচ স্টিফেন ফ্লেমিং ছোট্ট বক্তব্য রাখে। আবার মুম্বই ইন্ডিয়ান্সে প্রায় ঘণ্টাখানেক টিমমিটিং হয় যেখানে বক্তব্য রাখেন শুধু নীতা অম্বানি।



ইডেনে কেকেআরের ম্যাচ থাকলেই শাহরুখ খান প্রত্যেক ম্যাচে একই জায়গায় দাঁড়ান। তার চেয়েও তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে, উনি ম্যাচ শুরু হওয়ার ঠিক ২-৩ ওভার পরে মাঠে ঢোকেন। ওঁর বিশ্বাস, খেলা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরে মাঠে ঢুকলে কেকেআর জিতবে। তাই কলকাতায় হোক বা বাইরে, যে সমস্ত ম্যাচে শাহরুখ মাঠে থাকেন, একটু পরে ঢোকেন।



এছাড়া জাক কালিসকে দেখেছি, ব্যাট করতে নামার আগে দুটো ব্যাট প্রস্তুত রাখত। যে ব্যাটটা নিয়ে ম্যাচে খেলবে, সেটাকে রাখত কিটব্যাগের ওপর। আউট হয়ে ফেরার সময় কালিস ডাগআউটে এসে বলত, পিচে কী চলছে, অসমান বাউন্স, নাকি মন্থর উইকেট। বলেই ড্রেসিংরুমে চলে যেত। ওর বিশ্বাস ছিল, তাতেই দল ভাল খেলবে। গৌতম গম্ভীরকে দেখেছি, কোনও ম্যাচে রান পেলে যাকে দিয়ে ব্যাটের গ্রিপ পরাত, পরের ম্যাচেও তাকে দিয়েই ব্যাটের গ্রিপ লাগাত। লক্ষ্মীরতন শুক্লকে দেখেছি প্রত্যেক ম্যাচে নতুন গ্রিপ লাগিয়ে খেলত।



আর মনে রয়েছে রিকি পন্টিংয়ের সংস্কারের কথা। প্রত্যেক ম্যাচে ব্যাট করতে যাওয়ার আগে একই ভঙ্গিমায় বসে থাকত। ওটাকেই ও পয়মন্ত মনে করত।