সন্দীপ সরকার, কলকাতা: দাদা স্নেহাশিস গঙ্গোপাধ্য়ায় বাঁ হাতে ব্যাট করতেন। ছোটবেলায় তাঁর কিট নিয়ে খেলতে খেলতে বাঁহাতি ব্যাটারই হয়ে গিয়েছিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় (Sourav Ganguly)। যাঁর ব্যাটিং সৌন্দর্যে মুগ্ধ রাহুল দ্রাবিড় বলেছিলেন, অফসাইডে প্রথম ঈশ্বর। তারপর সৌরভ।
সাকিব হুসেনের (Sakib Hussain) জীবন বৃত্তান্ত আরও রোমাঞ্চকর। সিনেমার গল্পের মতো। বিহারের ১৯ বছর বয়সী তরুণ বোলিং শুরু করেছিলেন ব্যাট ও অন্যান্য কিট কেনার অর্থ ছিল না বলে। সেই বোলিংই এখন তাঁকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে জাতীয় দলে খেলার। তরুণ পেসারের প্রতিভা দেখে তাঁকে দলে নিয়েছিল কলকাতা নাইট রাইডার্স। প্রথম মরশুমে খেলার সুযোগ হয়নি। কিন্তু আইপিএল (IPL) চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য ছিলেন। এবারও কেকেআর (KKR) তাঁকে নিলাম থেকে দলে নিতে পারে বলে ইঙ্গিত।
বিহারের হয়ে বাংলার বিরুদ্ধে রঞ্জি ম্যাচ খেলবেন বলে বাংলায় এসেছিলেন। যে ম্যাচ ভেজা মাঠের জন্য ভেস্তে যায়। কল্যাণীতে বিহারের টিমহোটেলে বসে এবিপি আনন্দকে নিজের উত্থানের চমকপ্রদ কাহিনি শুনিয়েছিলেন সাকিব।
টেনিস বলে ক্রিকেট খেলা শুরু। বিহারের গোপালগঞ্জ জেলায় খেলতেন। সাকিব বলছিলেন, 'পেশাদার ক্রিকেটার হব কোনওদিন ভাবিনি। শখেই ক্রিকেট খেলা শুরু। প্রথমে টেনিস বলে খেলতাম। গোপালগঞ্জের টুনাগিরি ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হয়েছিলাম। সেখান থেকে সকলের উৎসাহ পাই। তারপরই এগিয়ে যাওয়া।'
শুরু থেকেই কি পেস বোলিং করবেন ঠিক করে নিয়েছিলেন? 'না ভাবিনি। আসলে অভাবের সঙ্গে লড়াই করে বড় হয়েছি। ব্যাটিংয়ের সরঞ্জাম খুব দামি। ব্যাট, প্যাড, গ্লাভস, হেলমেট মিলিয়ে প্রায় ১৫ হাজার টাকা পড়ত। সেই সময় অত টাকা কোথায়? খাব, না কিটব্যাগ কিনব? বল করতে গেলে সেসব কিছুই লাগে না। বল হাতে নাও আর বোলিং করে যাও। জুতোও কিনতে পারতাম না। অন্য কারও জুতো পরেই বল করতাম। সেই থেকেই জোরে বোলিং শুরু,' বলছিলেন সাকিব। যোগ করলেন, 'গোপালগঞ্জ জেলার ক্রিকেট সচিব ও অন্য কর্তারাও পাশে ছিলেন। বাড়ি থেকে কেউ বারণ করেনি। টুনাগিরি ক্রিকেট ক্লাবের সচিব, আমার কোচ রবিন সিংহ, মুকেশ ভাইয়া (ভারতীয় দলের ক্রিকেটার মুকেশ কুমার, যিনি বাংলার হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলেন) সবাই উৎসাহ দিয়েছেন। সকলের সমর্থনেই এই জায়গায় পৌঁছেছি।'
মুকেশের বাড়ি থেকে সামান্য দূরেই বাড়ি সাকিবের। বলছেন, 'আমার সেনাবাহিনিতে চাকরি করার ইচ্ছে ছিল। সেনাবাহিনির ট্রেনিং শুরু করেছিলাম। পাশাপাশি চলত ক্রিকেট। পরিবারে খুবই আর্থিক অনটন ছিল। ভেবেছিলাম দ্রুত সেনাবাহিনির চাকরি পেলে পরিবারের পাশে থাকতে পারব। সেই ভেবেই আর্মির প্রস্তুতি। আর সেনাবাহিনির প্রস্তুতি মানে ক্রিকেটের জন্য ফিটনেস ট্রেনিংও হয়ে যেত। সঙ্গে টেনিস বলে ক্রিকেট খেলাও চলত।' আরও বললেন, 'আমাদের জেলা থেকেই মুকেশ কুমারের উত্থান। অনেক কষ্ট করেছে মুকেশ ভাইয়া। ওর কাহিনি আমাকে প্রেরণা জোগাত। মুকেশ কুমারের বাড়ি থেকে ৫ কিলোমিটার দূরেই আমাদের বাড়ি। বাড়িতে আছেন বাবা-মা, চার ভাই ও দুই বোন। আমি মেজো ছেলে। বাবা আলি আহমেদ হুসেন চাষবাসের কাজ করেন। গ্রামে নিজেদের জমিতেই ফসল ফলান। আমার এক ভাই আকিব হুসেনও ক্রিকেট খেলে।'
টুনাগিরি অ্যাকাডেমির হয়ে ভাল খেলার পর বিহারের অনূর্ধ্ব ১৯ দলে সুযোগ পান সাকিব। সেখানে ভাল পারফর্ম করার পর সৈয়দ মুস্তাক আলি টি-২০ দলে ডাক। সেখানেও বল হাতে নজর কাড়ার পর চেন্নাই সুপার কিংসের নেটে ডাক পান ডানহাতি পেসার। সাকিবের কথায়, 'এক বছর ছিলাম সিএসকে শিবিরে। তারপর ট্রায়াল দিয়ে কলকাতা নাইট রাইডার্স দলে। সুযোগও পেয়ে যাই।'
টেনিস বল থেকে ডিউসে খেলা শুরু করে সমস্যা হয়নি? সাকিব বলছেন, 'প্রায় ৩ বছর ডিউস বলে খেলছি। টেনিস বল ছেড়ে ডিউসে খেলা শুরু করার পর শুরুর দিকে অসুবিধা হতো। বলের ওজনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সমস্যা হয়েছে। শুধু একটাই লক্ষ্য ছিল, জোরে বল করতে হবে। কোচও সেটাই বলেছিলেন যে, জোরে বল করে যাও।'
প্রিয় বোলার কে? সাকিব বলছেন, 'মহম্মদ সিরাজ ও মুকেশ ভাইয়া আমার প্রিয় বোলার। ওদের বোলিং দেখে ভাল লাগে। সময় পেলেই ওদের বোলিংয়ের ভিডিও দেখি। মুকেশ ভাইয়া আগলে রাখে। আইপিএলের সময় যশপ্রীত বুমরার সঙ্গেও কথা হয়েছিল। বলেছিল, আগে লাল বলের ভাল ক্রিকেটার হ। তাহলে সব ফর্ম্যাটেই সফল হবি।'
আইপিএল নিলামে নাইট শিবির তাঁকে নেওয়ার পরই মুম্বইয়ে কেকেআর অ্যাকাডেমিতে চলে গিয়েছিলেন সাকিব। সেখানে কেকেআরের সহকারী কোচ অভিষেক নায়ার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন। আর বোলিং কোচ ভরত অরুণ? জাতীয় দলের বোলিং কোচ থাকাকালীন যাঁর হাত ধরে বুমরা, মহম্মদ শামিদের উজ্জ্বল হয়ে ওঠা? 'ভরত স্যর বলেছিলেন, তোমার মধ্যে ঈশ্বরপ্রদত্ত দক্ষতা রয়েছে। সহজাত বোলিং করে যাও। সামান্য টেকনিক্যাল খুঁটিনাটি বলে দিয়েছেন,' বললেন সাকিব। যোগ করলেন, 'আমার অস্ত্র আউটস্যুইং। তবে ইনস্যুইংও করাতে পারি। আরও পরিশ্রম করতে হবে। গৌতম গম্ভীর স্যর বলেছেন, পরিশ্রম করে যাও। ভালই হবে। শুধু নিজের খেলা নিয়েই ভাবি। ক্রিকেট উপভোগ করতে বলেছেন কোচরা।'
বিহারের হয়ে দুটি টি-২০ ম্যাচ খেলেছেন। রঞ্জি অভিষেক হয়েছে কর্নাটকের বিরুদ্ধে। প্রিয় ফর্ম্যাট কোনটা? সাকিব বলছেন, 'লাল বল বা সাদা বল নিয়ে আলাদা ভাবনা নেই। একটাই পরিকল্পনা থাকে। ভাল বোলিং করে যেতে হবে। যেখানেই সুযোগ পাব উইকেট নিতে হবে। সারাদিনে যতই বোলিং করতে হোক না কেন, আমি তৈরি। নিজের সেরাটা দেব।'
কেকেআর মালিক শাহরুখের সঙ্গে তাঁর ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল। আইপিএলের সময় কী পরামর্শ দিয়েছিলেন এসআরকে? সাকিব বলছেন, 'শাহরুখ খান স্যর ভীষণ মাটির মানুষ। খুব সাপোর্টিভ। বলেছিলেন, তুমি ভাল করেছো বলেই এত দূর এসেছো। নিজের ওপর বিশ্বাস রাখো।'
আইপিএলের পর কেকেআরের ট্রেনার সাগর স্যরের কাছে প্রস্তুতি সেরেছেন। মিষ্টি ও তেল-মশলাদার খাবার এড়িয়ে চলেন। চেন্নাইয়ে এমআরএফ পেস ফাউন্ডেশনে কিংবদন্তি গ্লেন ম্যাকগ্রার কাছেও ক্লাস করেছেন সাকিব। আইপিএলে সুযোগ পাওয়ার পর জীবন কতটা বদলেছে? সাকিব বলছেন, 'জীবন পাল্টায়নি। যেমন ছিল, তেমনই আছি। শুধু আইপিএলের টাকায় বাড়িঘর সারিয়েছি। আইপিএলের পরে বাবাকে স্করপিও গাড়ি কিনে দিয়েছি।'
সামনে আইপিএলের মেগা নিলাম। তার আগে কেকেআর থেকে কোনও বার্তা? সাকিবের কথায়, 'আইপিএল নিলামের আগে কেকেআর দল থেকে শুধু বলেছে ফিট থাকো। বাকিটা আমরা দেখে নেব।'
আগামী ২-৩ বছরের মধ্যে ভারতের হয়ে খেলার স্বপ্ন দেখছেন বিহারের তরুণ।
আরও পড়ুন: বিকেল পাঁচটার মধ্যে! কবে ক্রিকেটারদের রিটেনশন তালিকা জানাতে হবে আইপিএলের দশ দলকে?
আপনার পছন্দের খবর আর আপডেট পাবেন আপনার পছন্দের চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম হোয়াটস অ্যাপেও। যুক্ত হোন ABP Ananda হোয়াটস অ্যাপ চ্যানেলে।