কলকাতা: এ যেন ঠিক মুম্বইয়ের শিবাজি পার্কের সেই বিখ্যাত অনুশীলনের কাহিনি! ব্যাট করে যাচ্ছে খুদে সচিন তেন্ডুলকর। যাকে বিস্ময়-বালক হিসাবে চিনতে শুরু করেছে মুম্বই। আর স্টাম্পসের ওপর কয়েন রেখে পর্যবেক্ষণ করছেন রমাকান্ত আচরেকর। কোনও বোলার খুদেকে আউট করতে পারলেই কয়েনটা তার। আর বালক অপরাজিত থাকলে? ব্যাটিংয়ের শেষে সেই কয়েন প্রাপ্তি।


অনেকটা আচরেকর স্যারের আদলেই ছাত্রকে প্রশিক্ষণ দিতেন কিশোর ত্রিবেদী। আমদাবাদের নির্মাণ স্কুলের মাঠে বাইশ গজের নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে দিতেন কয়েন। খুদে পেসারদের নির্দেশ দিতেন, সেই কয়েনের ওপর বল ফেলতে। আর এক ছাত্র নিখুঁত নিশানায় বারবার বল ফেলতেন ঠিক কয়েনের ওপরই। যে ছাত্রকে পরে ক্রিকেটবিশ্ব চিনবে যশপ্রীত বুমরা নামে!



ত্রয়োদশ আইপিএলে বল হাতে ফের ভয়ঙ্কর ফর্মে বুমরা। মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের হয়ে ৬ ম্যাচে নিয়েছেন ১১ উইকেট। আগের ম্যাচে রাজস্থান রয়্যালসের বিরুদ্ধে ৪ উইকেট নিয়েছেন। যে পারফরম্য়ান্স দেখে মুগ্ধ জাতীয় দলের কোচ রবি শাস্ত্রীও।

ডানহাতি পেসার বুমরার মারণাস্ত্র ইয়র্কার। ঘণ্টায় ১৪৫ কিলোমিটার গতিতে ব্যাটসম্যানের পায়ের ডগায় আছড়ে পড়া ডেলিভারি সারা বিশ্বে সম্ভ্রম কুড়িয়ে নিয়েছে। নিখুঁত ইয়র্কারে তাবড় ব্যাটসম্যানদের ঘুম ছুটিয়েছেন বুমরা। কীভাবে এত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল গুজরাতের পেসারের ইয়র্কার?



‘অনুশীলন। কঠোর সাধনা। প্র্যাক্টিস মেকস আ ম্যান পারফেক্ট, এই আপ্তবাক্যের অন্যতম সেরা উদাহরণ বুমরা,’ আমদাবাদ থেকে ফোনে বলছিলেন কিশোর। যাঁর প্রশিক্ষণে বুমরার ক্রিকেটে হাতেখড়ি। এবিপি আনন্দকে কিশোর বললেন, ‘আমদাবাদের নির্মাণ হাইস্কুলের ক্রিকেট অ্যাকাডেমির দায়িত্বে ছিলাম আমি। যশপ্রীতের মা দলজিৎ ওই স্কুলেরই ভাইস প্রিন্সিপাল ছিলেন। খুব ছোটবেলা বাবাকে হারায় যশপ্রীত। মায়ের সঙ্গেই স্কুলের অ্যাকাডেমিতে প্র্যাক্টিসে আসত। তখন ওর ১৪ বছর বয়স। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ত। নেটে প্রথম ওকে বল করতে দেখে বেশ অবাক হয়েছিলাম। অদ্ভুত অ্যাকশন। বলের গতি খুব একটা বেশি ছিল না। আমি কথা বলি ওর সঙ্গে। বলি, তোমার মা স্কুলের শিক্ষিকা। তুমি রোজ প্র্যাক্টিসে এসো।’



তারপর? কিশোর বলছিলেন, ‘কয়েকদিন পর দেখলাম ওর বলের গতি বেড়েছে। তবে নিয়ন্ত্রণ ছিল না। একটা বল অফস্টাম্পের বাইরে করছে, তো পরেরটা লেগস্টাম্পের বাইরে। কোনও বল আবার ফুলটস। বলের গতি বাড়াতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছিল। ধীরে ধীরে সেই সমস্যা কেটে যায়। স্কুলের অনূর্ধ্ব ১৬ দলে সুযোগ পায়।’



শুরু থেকেই কি এত নিখুঁত ইয়র্কার করেন বুমরা? ২৬ বছরের পেসারের শৈশবের কোচ বললেন, ‘আমার অ্যাকাডেমিতে ইয়র্কার প্র্যাক্টিসের আলাদা সেশন ছিল। পিচের নির্দিষ্ট জায়গায় কয়েন রেখে দিতাম। ঠিক ব্যাটসম্যানদের ব্লক হোলের জায়গায়। তারপর ক্যাম্পের সব পেসারদের বলতাম, টানা বল করে যাও। আর পিচের কয়েনের ওপর দশটা বল ফেলো। সে পাঁচ মিনিট লাগুক বা দু ঘণ্টা, যতক্ষণ না দশটা বল কয়েনের ওপর ফেলতে পারবে, ততক্ষণ না পাবে বিশ্রাম, না দেওয়া হবে পানীয় জল। খুব কঠোর নিয়ম করেছিলাম।’ কিশোর যোগ করলেন, ‘বুমরা শুরু থেকেই সেই প্র্যাক্টিসে নজর কেড়ে নিয়েছিল। প্রথম দিন হয়তো দু-একটা বল কয়েনে ফেলতে পেরেছিল। কিন্তু প্রত্যেক দিনের প্র্যাক্টিসে ওর নিয়ন্ত্রণ বাড়তে থাকল। কয়েকদিনের মধ্যেই ও দশটা বল কয়েনে ফেলতে পারত। সেই সঙ্গে ইয়র্কার করার সময় বল রিলিজ করবে কীভাবে, সেটা নিয়েও আলাদা করে কথা বলেছিলাম। প্র্যাক্টিস করতে করতেই ও নিখুঁত হতে শুরু করে। আজ বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ইয়র্কার বেরোয় বুমরার হাত থেকেই।’



স্কুল ক্রিকেটে বুমরার বলের গতি ভয় ধরাত প্রতিপক্ষ দলে। কিশোর বললেন, ‘স্কুলের ক্রিকেট দলের হয়ে ও ভাল খেলতে শুরু করে। স্কুলের সব ম্যাচেই ৩-৪টি করে উইকেট পেত। ওর বলে ব্যাটসম্যানেরা আঘাত পেত। ভয় পেত ওর বলের গতিকে। তারপর আমদাবাদ জেলা দলে সুযোগ পায়। সেখানে ভাল পারফর্ম করে গুজরাত রাজ্য দলে ডাক পায়।’



বুমরার বোলিং অ্যাকশন বদলানোর জন্য অনেকেই পরামর্শ দিয়েছিলেন কিশোরকে। তবে অভিজ্ঞ কোচ কান দেননি। কিশোর বলছিলেন, ‘অনেকে বলেছেন, ওর অ্যাকশন পাল্টে দিন। এই অ্যাকশনে বল করলে চোট-আঘাত লাগবে। আমি সেসব কথায় কান দিইনি। সকলকে বলি, এই ব্যতিক্রমী অ্যাকশনই ওর মূল অস্ত্র। তাছাড়া এটাই ওর সহজাত অ্যাকশন। তাই চোট লাগবে না। লাইন-লেংথ ঠিক রাখতে পারলে কেন অ্যাকশন পাল্টাতে যাব! অ্যাকশন বদলালে ওর বোলিংয়ের ধার চলে যেত।’ যোগ করলেন, ‘ছোট রান আপেও ঘণ্টায় ১৪০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে বল করে বুমরা। মাঝে মাঝে আমিও অবাক হতাম। তবে ওর এই ছন্দ সহজাত।’ কিশোরের ছেলে সিদ্ধার্থ ত্রিবেদীও পেসার ছিলেন। রঞ্জি ট্রফি, আইপিএলে খেলেছেন। কিশোর বললেন, ‘সিদ্ধার্থের সঙ্গে একসঙ্গে প্র্যাক্টিস করত বুমরা। ততদিনে সিদ্ধার্থ রঞ্জি ট্রফি ও আইপিএল খেলছে। ওকে পরামর্শ দিত। সব সময় আগলে রাখতে সিদ্ধার্থ।’



এখন বল হাতে বুমরার দাপট দেখে উচ্ছ্বাসে ভাসেন প্রবীণ কোচ। কিশোর বলছেন, ‘বুমরা পরিশ্রম করেছে। তার পুরস্কার পাচ্ছে। আরও অনেক দিন বিশ্বক্রিকেটকে বল হাতে শাসন করবে ও।’