কলকাতা: ফারাকটা এক মাস এক সপ্তাহের। অথচ আমূল বদলে গিয়েছে ঋদ্ধিমান সাহার জগৎ।

২৬ সেপ্টেম্বর। আবু ধাবির শেখ জায়েদ স্টেডিয়ামে কলকাতা নাইট রাইডার্সের বিরুদ্ধে সুযোগ পেলেন। চার নম্বরে ব্যাট করতে নেমে ৩১ বলে ৩০ রানে আটকে গেলেন ঋদ্ধি। সানরাইজার্স হায়দরাবাদ ম্যাচ হারার পর প্রশ্ন উঠল তাঁর মন্থর ব্যাটিং নিয়ে। প্রথম একাদশ থেকে বাদই পড়ে গেলেন বাংলার উইকেটকিপার।

৩ নভেম্বর। শারজায় মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের বিরুদ্ধে ঝলসে উঠল ঋদ্ধির ব্যাট। মরণ-বাঁচন ম্যাচে ওপেন করতে নেমে ৪৫ বলে অপরাজিত ৫৮ রান করলেন বঙ্গ তারকা। ডেভিড ওয়ার্নারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাউন্ডারি-ওভার বাউন্ডারি হাঁকালেন। আরও তাৎপর্যপূর্ণভাবে, দুরন্ত হাফসেঞ্চুরিতে কেকেআরের প্লে-অফের স্বপ্নের সলিলসমাধি ঘটিয়ে দিলেন ঋদ্ধি।

সেই কেকেআর, যাদের হয়ে এক সময় খেলেছেন ঋদ্ধি। অথচ দেশ তথা বিশ্বের সেরা উইকেটকিপারের তকমা পেলেও আর সুযোগ জোটেনি নাইট শিবিরে। বাংলার তারকা নিলামের টেবিলে বাংলার আইপিএল দলের কাছেই উপেক্ষিত থেকেছেন। সেই উপেক্ষার জবাব? ঋদ্ধির ব্যাটিং তাণ্ডবের পরের দিন তাঁর স্ত্রী রোমি বললেন, ‘জবাব দেওয়া নিয়ে ও ভাবে না। আমরা সকলে সানরাইজার্স হায়দরাবাদ প্লে অফে উঠবে কি না, তা নিয়েই ভাবছিলাম। আমি তো জানতামই না কেকেআর ছিটকে গেল। পাপালিও ম্যাচটা সেভাবে দেখেনি। আর উপেক্ষার জবাব কি না, সেটা বাংলার মানুষ বলুক।’

প্রথম একাদশ থেকে বাদ পড়ার পর ফের সুযোগ পেয়েই ব্যাটিং বিক্রম দেখাচ্ছেন ঋদ্ধি। দিল্লি ক্যাপিটালসের বিরুদ্ধে ৪৫ বলে বিধ্বংসী ৮৭ রান। রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের বিরুদ্ধে কঠিন পিচে ৩২ বলে ৩৯ করে দলের সর্বোচ্চ স্কোরার। মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের বিরুদ্ধে হাফসেঞ্চুরি। স্বপ্নের প্রত্যাবর্তন? রোমি বলছেন, ‘কামব্যাকটা ওর কাছে খুব স্বাভাবিক। চোটের কারণে বারবার ছিটকে গিয়েছে। চোটের জন্য প্রায় এক বছর মাঠের বাইরে ছিল। কাঁধের চোটের পর অনেকে ভাবতেই পারেননি যে, ও ফের ক্রিকেট মাঠে নামবে।’

হায়দরাবাদের প্রথম একাদশে সুযোগ না পেয়ে হতাশ হননি? রোমি বলছেন, ‘অনেক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে পাপালি। তবে ও শান্ত থাকতে জানে। ওকে আমি কুল কিউকাম্বার বলি। রাগের প্রকাশ নেই। মাঠে ঝগড়া করা বা স্লেজিং করা ওর ধাতে নেই। সব পরিস্থিতিতেই শান্ত, সংযত থাকতে পারে। কখনও ওর ওপর চাপটা আশপাশের মানুষদের বুঝতে দেয় না। হাহুতাশ করে না। দলে সুযোগ পাওয়ার ব্যাপারটা নির্বাচকদের ওপর ছেড়ে দেয়। আর প্র্যাক্টিস কখনও বন্ধ করেনি। করোনা আবহে প্রায় ৬ মাস মাঠের বাইরে। রঞ্জি ফাইনালের পর আইপিএল খেলল। ব্যাট ধরেনি। শুধু ফিজিক্যাল ট্রেনিং করেছে। তার পরেও রান করেছে। উইকেটের পিছনে তো খুব ভাল পারফরম্যান্স।’

রোমি যোগ করলেন, ‘২০১৪ সালে আইপিএল ফাইনালে সেঞ্চুরি করার পরেও আনন্দ করেনি। কারণ ওর দল হেরেছিল। তবে সানরাইজার্স হায়দরাবাদের হয়ে শেষ দুটো ইনিংসের পর পাপালি ভীষণ খুশি। অধিনায়ক ডেভিড ওয়ার্নার-সহ দলের সকলেই খুশি।’ অতিমারী পরিস্থিতিতে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে ছেড়ে এতদিন বাইরে কাটানো। সংযুক্ত আরব আমিরশাহি থেকে ভিডিও কলে রোজই সন্তানদের সঙ্গে কথা বলছেন ঋদ্ধি। রোমি বলছেন, ‘কোনও বিকল্প নেই। পরিবার আর এত ছোট দুই সন্তানকে ছেড়ে এতদিন বাইরে থাকলে উদ্বেগ তো হয়ই। কিন্তু মাঠে নামলে ও নিজের সেরাটা দেয়। ক্রিকেটে মনোনিবেশ করে।’

বঙ্গ ক্রিকেটারের শৈশবের কোচ জয়ন্ত ভৌমিকও ছাত্রের দুরন্ত প্রত্যাবর্তনে উচ্ছ্বসিত। বলছিলেন, ‘করোনার জন্য দীর্ঘদিন প্র্যাক্টিসের মধ্যে ছিল না। ওখানে গিয়েও কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয়েছিল। কেউই টুর্নামেন্টের শুরুর দিকে টাচে ছিল না। জনি বেয়ারস্টো ইংল্যান্ড দলের হয়েও কিপিং করে না। উইকেটকিপারের দায়িত্ব সামলায় জশ বাটলার। আমার মনে হয়েছিল উইকেটকিপার হিসাবে ঋদ্ধিকেই দায়িত্ব দেওয়া উচিত। কিংবদন্তি সচিন তেন্ডুলকরও সেটাই বলেছে।’ জয়ন্ত যোগ করলেন, ‘পাপালির সঙ্গে প্রায় রোজই কথা হয়। তবে প্রথম একাদশে সুযোগ না পাওয়া নিয়ে ও ভাবে না। কেকেআরের বিরুদ্ধে ৩১ বলে ৩০ রান করেছিল। কিন্তু সেদিন পিচ বেশ কঠিন ছিল। হায়দরাবাদ মাত্র ১৪২ রান তুলেছিল। কেউই খুব ঝোড়ো ব্যাটিং করেনি। তবু পাপালি বাদ পড়ে। তবে ফিরে এসে নিজেকে প্রমাণ করল।’

শৈশবের কোচের মতে, জবাব নয়, নিজের কাজটা করেছেন ঋদ্ধি। বলছেন, ‘প্লে অফে যেতে গেলে হায়দরাবাদকে জিততেই হতো। হায়দরাবাদ জিতলে কেকেআরের বিদায়ঘণ্টা তো বাজারই ছিল। মরণবাঁচন ম্যাচ ছিল।’ তবে কেকেআরে বাংলা ক্রিকেটারদের ব্রাত্য থাকতে দেখে হতাশ জয়ন্ত। ‘বলছি না পাপালিকেই নিতে হতো। তবে কেকেআর বাংলা থেকে কোনও একজন ক্রিকেটারকেও পায় না! যারা যোগ্য, তাদের সুযোগ দেওয়া হয় না কেন!’ ছাত্রের সাফল্যের দিনই প্রশ্ন গর্বিত কোচের।