মুম্বই: সোমবার রাত সোয়া দশটাতেও যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনের গ্যালারিতে বাহান্ন হাজারেরও বেশি মানুষ। বেশিরভাগের হাতেই সবুজ-মেরুন পতাকা, গায়ে সবুজ-মেরুন জার্সি। টানটান উত্তেজনায় তখন কাঁপছে সারা স্টেডিয়াম। সবার মনেই একই প্রশ্ন, হিরো আইএসএলের ফাইনালে উঠবে কারা? গতবারের চ্যাম্পিয়ন হায়দরাবাদ এফসি, না গত মরসুমে এই হায়দরাবাদের কাছে হেরেই সেমিফাইনাল থেকে ছিটকে যাওয়া এটিকে মোহনবাগান?  


নির্ধারিত ৯০ মিনিট ও অতিরিক্ত ৩০ মিনিটের ওপেন প্লে-তে কোনও গোল না হওয়ার পর হায়দরাবাদের জোয়াও ভিক্টর গোল করে শুরু করেন রুদ্ধশ্বাস টাই ব্রেকার। কিন্তু ডানদিকে ঝাঁপিয়ে হাভিয়ে সিভেরিওর শট আটকে দেন গোল্ডন গ্লাভজয়ী বিশাল কয়েথ। সবাইকে অবাক করে দিয়ে তাদের সর্বোচ্চ গোলদাতা বার্থোলোমিউ ওগবেচের শট পোস্টে লেগে ফিরে আসে। তখনই জয়ের সেলিব্রেশন শুরু হয়ে যায় গ্যালারিতে। এটিকে মোহনবাগানের দিমিত্রিয়স পেট্রাটস, ফেদরিকো গায়েগো ও মনবীর সিং জালে বল জড়িয়ে দিলেও ব্রেন্ডান হ্যামিল গোলের বাইরে বল পাঠানোয় উত্তেজনার পারদ চরমে ওঠে।


হায়দরাবাদের দুই তরুণ সদস্য রোহিত দানু ও রেগন সিং ভুল না করায় শেষ শট নিতে যাওয়া সবুজ-মেরুন অধিনায়ক প্রীতম কোটালের ওপরই এসে পড়ে যাবতীয় চাপ। কিন্তু গোলে বল রাখতে বিন্দুমাত্র ভুল করেননি অভিজ্ঞ প্রীতম এবং তাঁর এই গোলের পরই আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে শব্দের বিষ্ফোরণ ঘটে যুবভারতীতে। হিমাচলের বিশালের সেভ ও বঙ্গসন্তান প্রীতমের এই গোলই বহু আকাঙ্খিত জয় এনে দেয় সবুজ-মেরুন বাহিনীকে।   


গতবারের চ্যাম্পিয়ন হায়দরাবাদ এফসি-কে টাইব্রেকারে ৪-৩-এ হারিয়ে গতবারের সেমিফাইনালে হারের বদলা নিল এটিকে মোহনবাগান। দ্বিতীয়বার হিরো আইএসএল ফাইনালে উঠল তারা। আগামী শনিবার গোয়ার জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে তারা বেঙ্গালুরু এফসি-র মুখোমুখি হবে। যারা রবিবার লিগশিল্ড জয়ী মুম্বই সিটি এফসি-কে আর এক রুদ্ধশ্বাস পেনাল্টি শুটে হারিয়ে আগেই ফাইনালে জায়গা করে নিয়েছে।


হিরো আইএসএলের অভিষেক মরশুমেই ফাইনালে উঠেছিল এটিকে মোহনবাগান। কিন্তু সে বার ফাইনালে তাদের হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় মুম্বই সিটি এফসি। এ বার ফের ট্রফি জয়ের সুযোগ কলকাতার ঐতিহ্যবাহী ক্লাবের সামনে। এ বার তারা পারবে কি? এই প্রশ্নের জবাব পেতে শনিবার রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে।    


এ দিন দু’টি পরিবর্তন করে প্রথম এগারো নামায় এটিকে মোহনবাগান। পুইতিয়ার জায়গায় গ্ল্যান মার্টিন্স ও লিস্টন কোলাসোর জায়গায় কিয়ান নাসিরি শুরু করেন। অন্য দিকে, হায়দরাবাদ এফসি এ দিন শুরু থেকেই খেলায় তাদের সর্বোচ্চ গোলদাতা বার্থোলোমিউ ওগবেচেকে। ছিলেন না হাভিয়ে সিভেরিও।


প্রথম মিনিটেই কিয়ানকে গোলের বল বাড়িয়ে দেন ডানদিক দিয়ে ওঠা কার্ল ম্যাকহিউ। ঠিকমতো বলে হেড করতে পারলে শুরুতেই গোল পেয়ে যেতেন। কিন্তু পারেননি। শুরু থেকেই এ দিন প্রতিপক্ষকে চাপে রাখার প্রবণতা দেখা যায় এটিকে মোহনবাগানের খেলায়। আগের দিন যে কোচ হুয়ান ফেরান্দো বলেছিলেন, ম্যাচটা ৯০ মিনিটেই জিততে চান তাঁরা, তাদের খেলাতেও সেই বিবৃতিরই প্রতিফলন দেখা যায়। কিন্তু একাধিক গোলের সুযোগ নষ্ট হওয়ায় তাদের সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।


ম্যাচের বয়স দশ মিনিট হওয়ার পর থেকে ক্রমশ পাল্টা আক্রমণ শুরু করে হায়দরাবাদ এবং ১৫ মিনিটের মাথায় বক্সের মধ্যে বোরহা হেরেরা গোলে শট মারার মতো বল পেয়ে যান। কিন্তু গোলে শট নেওয়ার আগেই তাঁর পা থেকে বল ছিনিয়ে নেন আশিস রাই। এর দু’মিনিটের মধ্যেই অবশ্য জবাব দেয় সবুজ-মেরুন বাহিনী এবং বাঁ দিক থেকে শুভাশিস বোসের ক্রসে গোলমুখী হেড করেন মনবীর সিং। যা আটকে দেন হায়দরাবাদের গোলকিপার গুরমিত সিং।


কুড়ি থেকে ২৩ মিনিটের মধ্যে এটিকে মোহনবাগানের খেলোয়াড়দের পরপর তিনটি শট অল্পের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। বক্সের বাইরে থেকে নেওয়া গ্ল্যান মার্টিন্সের দূরপাল্লার শট দ্বিতীয় পোস্টের বাইরে চলে যায়। মনবীর সিংয়ের আরও একটি দূরপাল্লার শট ক্রসবারে লেগে ফিরে আসে। এই দুইয়ের মাঝে দিমিত্রিয়স পেট্রাটস বক্সের মধ্যে থেকে গোলে যে কোণাকুনি শট নেন, তাও দ্বিতীয় পোস্টের বাইরে দিয়ে বেরিয়ে যায়। এই সময় প্রতিপক্ষকে প্রচণ্ড চাপে রেখেছিলেন হুগো বুমৌসরা।


চাপ কাটিয়ে নিতে পারলেও হায়দরাবাদ কিন্তু অ্যাটাকিং থার্ডে বেশি কার্যকরী হয়ে উঠতে পারেনি। কার্ল ম্যাকহিউ, গ্ল্যান মার্টিন্স মাঝমাঠেই তাদের অ্যাটাকারদের আটকে দিচ্ছিলেন বারবার। বার্থোলোমিউ ওগবেচেকেও এ দিন কড়া পাহাড়ায় রাখেন তাঁরা। নাইজেরীয় তারকার কাছে বল পৌঁছতেই দিচ্ছিলেন না। তাঁকে জায়গাও দিচ্ছিলেন না প্রীতম, স্লাভকোরা। প্রথমার্ধে গতবারের চ্যাম্পিয়নদের একটিও গোলমুখী শট নিতে দেয়নি সবুজ-মেরুন ব্রিগেড। কলকাতার দল তিনকাঠির মধ্যে মাত্র একবার বল রাখতে পারে।


দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে কিয়ানের জায়গায় লিস্টন কোলাসোকে নামায় এটিকে মোহনবাগান। এই অর্ধে অবশ্য শুরু থেকেই আক্রমণ-প্রতি আক্রমণের ঝড় বয়নি। বরং দুই দলেরই বল দখল বাড়িয়ে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ রাখার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু দশ মিনিট পর থেকেই চাপ বাড়ায় এটিকে মোহনবাগান এবং প্রথম প্রতি আক্রমণেই পেট্রাটস বক্সে ঢুকে সোজা গোলে শট নেন, যা আটকে দেন গোলকিপার। এর পরে দু’মিনিটের মধ্যে পরপর তিনটি কর্নার পায় সবুজ-মেরুন বাহিনী। কিন্তু কোনওটিতেই সফল হয়নি তারা। এই সময় থেকে ফের হায়দরাবাদের ওপর থেকে চাপ বাড়াতে শুরু করে হোম টিম।


৬৭ মিনিটের মাথায় হেরেরার জায়গায় নেমে ওগবেচের কাছ থেকে দলনেতার আর্মব্যান্ড নিয়ে নেন জোয়াও ভিক্টর। ফলে তাদের আক্রমণের প্রবণতাও ক্রমশ বাড়ে। ৭২ মিনিটের মাথায় বক্সের বাইরে বিপজ্জনক জায়গা থেকে ফ্রি কিক পেয়েও অবশ্য তা কাজে লাগাতে পারেনি তারা। বারের অনেক ওপর দিয়ে ফ্রি কিক উড়িয়ে দেন মহম্মদ ইয়াসির।


চেনা ছন্দে না থাকা হুগো বুমৌসকে তুলে নিয়ে ফেদরিকো গায়েগোকে নামানো হয় ৭৩ মিনিটের মাথায়। উদ্দেশ্য ছিল আক্রমণের ধার বাড়ানো। কিন্তু খেলা যত ৯০ মিনিটের সময়সীমার দিকে এগোয়, তত তাদের আক্রমণের ধার কমতে শুরু করে। তবে ৮১ মিনিটের মাথায় বাঁ দিকের উইং থেকে যে ফ্রিকিক নেন পেট্রাটস, দ্বিতীয় পোস্টের সামনে সেই বলে মাথা ছোঁয়াতে পারলে গোল পেতেন স্লাভকো দামিয়ানোভিচ। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হন।


ম্যাচের একেবারে শেষ দিকে, ৮৬ মিনিটের মাথায় জয়সূচক গোল তুলে নেওয়ার উদ্দেশ্যে জোয়েল চিয়ানিজের জায়গায় হাভিয়ে সিভেরিওকে নামায় হায়দরাবাদ। তবে আক্রমণে ধার বাড়ানোর চেয়ে রক্ষণেই বেশি মনোনিবেশ করতে দেখা যায় হলুদ জার্সিধারীদের। ৮৯ মিনিটের মাথায় বক্সের মাথায় বল পেয়েও ডিফেন্ডারদের তৎপরতায় গোলে শট নিতে পারেননি পেট্রাটস।


শেষ দশ মিনিটে গোল পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে এটিকে মোহনবাগান। এই সময়ে পরপর চারটি কর্নারও আদায় করে নেয় তারা। কিন্তু কোনওটাই কাজে লাগাতে পারেনি। ৯০ মিনিটের খেলায় এ দিন দশটি কর্নার পায় হোম টিম। কিন্তু একটি থেকেও গোল তুলে নিতে পারেনি তারা। তিনটি শট গোলে রাখলেও হায়দরাবাদ একটির বেশি শট গোলে রাখতে পারেনি। ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে।


অতিরিক্ত সময়ে এটিকে মোহনবাগানের পারফরম্যান্সে গোলের চেষ্টা দেখা গেলেও হায়দরাবাদকে কার্যত নির্বিষ মনে হয়য়। ক্লান্তি তাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে। ৯৭ মিনিটের মাথায় লালরিনলিয়ানা হ্নামতে, যিনি মার্টিন্সের জায়গায় মাঠে আসেন, তিনি বক্সের বাইরে থেকে দূরপাল্লার জোরালো শট নেন গোলে। কিন্তু অল্পের জন্য গোলের বাইরে দিয়ে চলে যায়। ১০৪ মিনিটের মাথায় ডান দিক থেকে গায়েগোর দেওয়া ক্রসে গোলের সুযোগ পেয়ে যান কোলাসো। কিন্তু তাঁর পায়ে বল পৌঁছনোর আগেই তা ক্লিয়ার করে দেন নিখিল পূজারী।


অতিরিক্ত সময়ের দ্বিতীয়ার্ধে ইয়াসিরের জায়গায় আব্দুল রাবি মাঠে আসায় হায়দরাবাদের আক্রমণে কিছুটা হলেও গতি আসে। কিন্তু এটিকে মোহনবাগানের রক্ষণ ছিল বেশ তৎপর। ফলে তাদের কোনও চেষ্টাই সফল হয়নি। এই আধঘণ্টায় কোনও দলই একটিও শট গোলে রাখতে পারেনি। ফলে পেনাল্টি শুট আউট ছাড়া ফয়সালার আর কোনও রাস্তা ছিল না। দুই গোলকিপারের দিকেই তখন ছিল যুবভারতীর গ্যালারিতে থাকা প্রায় ৫২ হাজার ফুটবলপ্রেমীর নজর। কিন্তু শেষ হাসি হাসেন বিশাল কয়েথই।