ভুবনেশ্বর: কলিঙ্গ সুপার কাপ (Kalinga Super Cup) সেমিফাইনালে উঠবে কারা, মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট (MBSG) না ইস্টবেঙ্গল এফসি (EBFC), তার ফয়সালা হয়ে যাবে শুক্রবার সন্ধ্যায় এই দুই দলেরই দ্বৈরথে। অর্থাৎ, মরশুমের তৃতীয় কলকাতা ডার্বি কার্যত হতে চলেছে টুর্নামেন্টের কোয়ার্টার ফাইনাল। তবে মোহনবাগানের সামনে যেমন জয় ছাড়া শেষ চারে যাওয়ার আর কোনও রাস্তা নেই, ইস্টবেঙ্গলের সামনে এই ম্যাচ ড্র করেও শেষ চারে যাওয়ার রাস্তা খোলা আছে। 


সুপার কাপ লিগ টেবলে দুই দলেরই পয়েন্ট সংখ্যা সমান (৬)। দুই দলের গোলপার্থক্যও সমান (২)। তফাৎ শুধু একটা জায়গাতেই এবং তা গোলসংখ্যায়। ইস্টবেঙ্গল যেখানে পাঁচ গোল দিয়ে তিন গোল খেয়েছে, সেখানে মোহনবাগান চার গোল দিয়ে দুই গোল খেয়েছে। একটি গোল বেশি দেওয়ার কারণেই শুক্রবার ভুবনেশ্বরের কলিঙ্গ স্টেডিয়ামে এক ধাপ এগিয়ে থেকে নামছে লাল-হলুদ শিবির। 


শুক্রবার হার-জিতের ফয়সালা হলে জয়ী দল বেশি পয়েন্ট পেয়ে স্বাভাবিক নিয়মেই শেষ চারে পৌঁছে যাবে। কিন্তু ম্যাচ ড্র হলে গোলসংখ্যায় এগিয়ে থেকে সেমিফাইনালের ছাড়পত্র পেয়ে যাবে ইস্টবেঙ্গলই। 


এগিয়ে কারা, পিছিয়ে কারা?


সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স, আধিপত্য বিস্তার করে টানা দুটি ম্যাচ জেতা ও বেশি গোল করার জন্য হয়তো ইস্টবেঙ্গলকে এই ম্যাচে এগিয়ে রাখছেন মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, গৌতম সরকারের মতো বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু সেই সঙ্গে তাঁরা এও স্বীকার করে নিয়েছেন যে, কলকাতা ডার্বিতে ভবিষ্যদ্বাণী করা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। 


টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচে হায়দরাবাদ এফসি-কে ৩-২-এ হারানোর পর ইস্টবেঙ্গল দ্বিতীয় ম্যাচে শ্রীনিধি ডেকান এফসি-কে হারায় ২-১-এ। অন্যদিকে, মোহনবাগান ডেকান ও হায়দরাবাদ- দুই প্রতিপক্ষকেই হারায় ২-১-এর ব্যবধানে। ইস্টবেঙ্গলকে দুই ম্যাচেই যতটা আধিপত্য নিয়ে ম্যাচ জিততে দেখা গিয়েছে, মোহনবাগানকে ততটা দাপুটে ফুটবল খেলে জিততে দেখা যায়নি। দুই ম্যাচেই তারা এক গোলে পিছিয়ে থাকার পর জেতে। 


মোহনবাগানের সাতজন ফুটবলার কাতারে জাতীয় দলের শিবিরে রয়েছেন এবং তিনজন নির্ভরযোগ্য ফুটবলার চোট পেয়ে মাঠের বাইরে বসে, চোট সারানোর প্রক্রিয়া চলছে তাঁদের। সেই জায়গায় ইস্টবেঙ্গলের মাত্র দু’জন জাতীয় শিবিরে এবং হরমনজ্যোৎ সিংহ খাবরা ছাড়া বড় কোনও চোট-আঘাত সমস্যা নেই তাদের। সেই জন্যই দলীয় শক্তির দিক থেকে এগিয়ে রয়েছে লাল-হলুদ শিবির। কিন্তু ডার্বি এমন এক ম্যাচ, যেখানে এটাই যথেষ্ট নয়। 


নজর বিদেশিদের ওপর  


দুই দলেরই বিদেশিরা সবাই সুস্থ ও মাঠে নামার জন্য তৈরি। তাই শুক্রবারের এই ডার্বিতে দুই দলের বিদেশিদের দিকেই তাকিয়ে থাকবেন সমর্থকেরা। যাদের বিদেশিরা ভাল ফুটবল খেলতে পারবেন, তারাই হয়তো শেষ হাসি হাসবে। ধারে ও ভারে, খাতায়-কলমে লাল-হলুদ শিবিরের বিদেশিদের চেয়ে সবুজ-মেরুন শিবিরের বিদেশি ফুটবলাররা এগিয়ে। মোহনবাগানের ড্রেসিংরুমে দু’জন বিশ্বকাপার ও একজন ইউরো কাপার আছেন যেখানে, সেখানে ইস্টবেঙ্গলের লাইন-আপে কোনও বিশ্বকাপার বা ইউরো কাপার নেই। রয়েছেন আইএসএলেই খেলা কয়েকজন অভিজ্ঞ তারকা। 


ধারে ও ভারে এগিয়ে থাকলেও মোহনবাগানের বিশ্বকাপার-জুটি জেসন কামিংস ও দিমিত্রি পেট্রাটসকে তাঁদের সেরা ফর্মে পাওয়া যাচ্ছে না। ইউরো কাপার আরমান্দো সাদিকু সদ্য সুস্থ হয়ে হয়তো শুক্রবার মাঠে ফিরবেন। ফলে দলের ছয় বিদেশিকেই পাবে মোহনবাগান। কিন্তু শুক্রবার সন্ধ্যায় কেমন ফর্মে থাকবেন তাঁরা, সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। 


ইস্টবেঙ্গলের ব্রাজিলীয় ফরওয়ার্ড ক্লেটন সিলভা প্রথম ম্যাচে জোড়া গোল করেন। তৃতীয় গোলটি দেন সল ক্রেসপো। পরের ম্যাচে জর্ডন থেকে আসা হিজাজি মাহের ও হাভিয়ে সিভেরিওর গোলে জয় পায় লাল-হলুদ বাহিনী। অর্থাৎ বিদেশিরাই ইস্টবেঙ্গলকে জেতাচ্ছেন। মোহনবাগানের প্রথম ম্যাচে কামিংস ও সাদিকু গোল পেলেও পরের ম্যাচে প্রথমে প্রতিপক্ষের এক আত্মঘাতী গোলে ও পরে পেনাল্টি থেকে পাওয়া পেট্রাটসের গোলে জেতে তারা। 


সৌভাগ্য, বাড়তি অক্সিজেন 


যে ভাবে নিজেদের দূর্গ সামলে প্রতিপক্ষের জালে বল জড়ানোর পরে নিজেদের ভুলে গোল হজম করেছে ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগানের ক্ষেত্রে কিন্তু ব্যাপারটা সে রকম না। দুই ম্যাচেই আগে গোল হজম করেছে মোহনবাগান, তার পরে তা শোধ করে জয় পেয়েছে। আর দ্বিতীয় ম্যাচে তাদের জয়টা কার্যত হায়দরাবাদ এফসি-র কাছে উপহার পাওয়া। না হলে ৮৮ মিনিট পর্যন্ত এক গোলে পিছিয়ে থাকার পরও ২-১ গোলে জয় এই স্তরের ফুটবলে খুব একটা দেখা যায় না। এ রকম জয়ের জন্য সৌভাগ্য প্রয়োজন। শুক্রবারের ডার্বিতেও সবুজ-মেরুন ফুটবলারদের সঙ্গে যা থাকে কি না, সেটাই দেখার। 


তবে একটা ঘটনা এই গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের আগে তাদের শিবিরে বাড়তি অক্সিজেন জোগাতে পারে এবং তা হল তাদের নতুন হেড কোচ আন্তোনিও লোপেজ হাবাসের উপস্থিতি। ইন্ডিয়ান সুপার লিগের ইতিহাসে অন্যতম সফল কোচের উপস্থিতি, তাঁর শরীরী ভাষা ও ফুটবলারদের মানসিক ভাবে চাঙ্গা করার পদ্ধতির যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। প্রথম দু’ম্যাচে হাবাস সশরীরে মোহনবাগান শিবিরে উপস্থিত থাকতে পারেননি। এই ম্যাচের আগে তাঁর উপস্থিতি হয়তো পেট্রাটসদের বাড়তি মানসিক শক্তি জোগাবে। 


এ পর্যন্ত এ মরশুমে দু’বার মুখোমুখি হয়েছে কলকাতার দুই প্রধান ও ঐতিহ্যবাহী ক্লাব। দু’বারই মরশুমের শুরুতে ডুরান্ড কাপে। প্রথমবার জেতে ইস্টবেঙ্গল। সে ছিল ৫৫ মাস পরে তাদের ডার্বি-জয়। কিন্তু মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে সেই টুর্নামেন্টেরই ফাইনালে তাদের হারতে হয় সেই মোহনবাগানের কাছেই। অথচ সেই ম্যাচে ফেভারিটের আসনে ছিল ইস্টবেঙ্গলই। এমন ঘটনা অবশ্য নতুন নয়। কলকাতা ডার্বির ফেভারিটদের হারের ঘটনা বহুবার ঘটেছে অতীতে। তাই এই ম্যাচে ইস্টবেঙ্গলকে সতর্ক থাকতে হবে। 


জয়ই একমাত্র লক্ষ্য 


ড্র করলেই সেমিফাইনালে উঠে যাবে তারা, দলের ছেলেদের মধ্যে থেকে এই মানসিকতাকে পুরোপুরি বিদায় করে দিতে চান লাল-হলুদ বাহিনীর স্প্যানিশ কোচ কার্লেস কুয়াদ্রাত। বৃহস্পতিবার সাংবাদিক বৈঠকে তিনি বলেন, “দুই দলই এই ম্যাচে উজ্জীবিত হয়ে মাঠে নামবে। ফুটবলে ড্র করার মানসিকতা নিয়ে নেমে হারার উদাহরণ অনেক আছে। আমরা তাই কাল জিততেই নামব। জয় ছাড়া কিছু ভাবছিই না”। কোচের সঙ্গে একমত দলের সেরা গোলদাতা ক্লেটন সিলভাও। তিনি বলেন, “আমাদের কাল জিততেই হবে। ডার্বি ভারতীয় ফুটবলের সেরা ম্যাচ। এই ম্যাচের অংশ হতে পারাটা সৌভাগ্যের ব্যাপার”। 


কুয়াদ্রাত বলেন, “আমরা ভাল প্রস্তুতি নিয়েছি এবং যথেষ্ট ফোকাসড্। এই টুর্নামেন্টে আমরা ছয় বিদেশি খেলাতে পারব। অন্য টুর্নামেন্টের থেকে এই একটা ব্যাপারই আলাদা। বাকি সবই এক। আমাদের খেলোয়াড়দের হার না মানা মানসিকতাতেও কোনও পরিবর্তন হয়নি। এ জন্যই আমি খুশি”। 


নতুন কোচ হাবাস শিবিরে যোগ দিলেও শুক্রবার দলের সঙ্গে মাঠে থাকতে পারছেন না। তাই সাংবাদিক বৈঠকে ভারপ্রাপ্ত কোচ ক্লিফোর্ড মিরান্ডাই ছিলেন। তিনি বলেন, “এটা শুধু ডার্বি নয়, সেমিফাইনালে ওঠার লড়াইও। এটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ আমাদের কাছে। অতিরিক্ত চাপ না নিয়ে আর পাঁচটা ম্যাচের মতোই দেখছি এই ম্যাচটাকে। পুরো দল পেলে তো ভালই হত। কিন্তু যারা খেলছে, তারা একশো শতাংশই দিচ্ছে”। 


দলের অস্ট্রেলীয় ডিফেন্ডার ব্রেন্ডান হ্যামিল এই ম্যাচ নিয়ে বলেন, “আমার সৌভাগ্য যে আগেও ডার্বি খেলার সুযোগ আমার হয়েছে। তাই জানি, সমর্থকদের কাছে এই ম্যাচের আকর্ষণ ও গুরুত্ব কতটা। আমাদের কাছেও রোমাঞ্চকর। আমরা এই ম্যাচ খেলতে ভালবাসি এবং এর জন্য কোনও বাড়তি মোটিভেশনের প্রয়োজন নেই। এই ম্যাচে জিততে পারলে আমাদের সামনে চ্যাম্পিয়ন হয়ে এশীয় স্তরের টুর্নামেন্টে খেলার সুযোগও আসবে। এই জন্যও ম্যাচটা গুরুত্বপূর্ণ”। 


ডার্বি ঘিরে উত্তাপ বাড়ছে দুই শিবিরেই। (তথ্যসূত্র - ISL Media)


আরও পড়ুন: বাংলা ক্রিকেট দলকে উদ্বুদ্ধ করতে ১৪ বছর পর ইডেনে অভীক


আপনার পছন্দের খবর আর আপডেট এখন পাবেন আপনার পছন্দের চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম হোয়াটস অ্যাপেও। যুক্ত হোন ABP Ananda হোয়াটস অ্যাপ চ্যানেলে