কুয়ালালামপুর: জানুয়ারিতে এশিয়ান কাপের মূলপর্বে খেলার প্রস্তুতি হিসেবে ২২ বছর পর মারডেকা টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছিল ভারতের সিনিয়র দল। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা তেমন ভাল হল না সুনীল ছেত্রী ও তাঁর দলের। শুক্রবার কুয়ালা লামপুরের বুকিত জলিল স্টেডিয়ামে প্রায় ৮৭ হাজার দর্শকে ঠাসা স্টেডিয়ামে ফিফা ক্রমতালিকায় তাদের চেয়ে ৩২ ধাপ পিছিয়ে থাকা মালয়েশিয়ার বিরুদ্ধে সমানে সমানে লড়াই করেও জয়ের হাসি হাসতে পারল না ভারত।



এ দিন শুধু যে প্রতিপক্ষের এগারোজন ফুটবলারের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে সুনীলদের, তা নয়। গ্যালারির অন্তত ৮৫ হাজার দর্শকের চিৎকারও সহ্য করে ম্যাচে মনোনিবেশ করতে হয় তাদের। এখানেও শেষ নয়। থাইল্যান্ডের রেফারির একাধিক ভুল সিদ্ধান্তেরও শিকার হতে হয় ভারতীয় দলকে। এমনকী তাদের একশো শতাংশ ন্যায্য গোলও দেওয়া হয়নি তাদের। এই গোলটি দিলে ভারত ৩-৩ করে ম্যাচের ছবিটাই পাল্টে দিতে পারত। কিন্তু সে সুযোগ পায়নি তারা।

এ দিন সাত মিনিটের মাথায় গোল করে দলকে এগিয়ে দেন মালয়েশিয়ার ডিয়নজন কুলস্। ১৪ মিনিটের মাথায় সেই গোল শোধ করেন নাওরেম মহেশ সিং। প্রথমার্ধে ভারতীয় রক্ষণের ভুল কাজে লাগিয়ে আরও দুটি গোল করে এগিয়ে যায় আয়োজকরা। ২০ মিনিটের মাথায় পেনাল্টি থেকে গোল করেন আরিফ আইমান ও ৪২ মিনিটে ফয়জল হালিম ব্যবধান আরও বাড়ান। দ্বিতীয়ার্ধে, ৫১ মিনিটের মাথায় ব্যবধান কমান ভারত অধিনায়ক সুনীল ছেত্রী। কিন্তু তার পরেও, ৬১ মিনিটের মাথায় শেষ গোলটি করেন কোরবিন লরেন্স।

এ দিন সুনীল ছেত্রী, লালিয়ানজুয়ালা ছাঙতে ও নাওরেম মহেশ সিংকে সামনে রেখে ৪-৩-৩-এ দল সাজায় ভারত। আনোয়ার আলি, শুভাশিস বোসদের নাম এ দিন টিম লিস্টেই ছিল না, সম্ভবত তাঁদের চোটের জন্য। অনিরুদ্ধ থাপা, উদান্ত সিং, লালচুঙনুঙ্গা, নন্দকুমার শেখরদের রিজার্ভ বেঞ্চে রাখা হয়। অন্য দিকে, আব্দুল রশিদ, আরিফ আইমানদের সামনে রেখে ৪-২-৩-১-এ খেলা শুরু করে আয়োজক মালয়েশিয়া।

প্রথম মিনিটেই বক্সের বাইরে থেকে নেওয়া সহাল আব্দুল সামাদের গোলমুখী ভলি বারে লেগে ফিরে আসে। শুরু থেকেই এ দিন দুই দলের ফুটবলারদের মধ্যে পরষ্পরের বিরুদ্ধে মেজাজ হারানোর প্রবণতা দেখা যায়। স্টেডিয়ামের পরিবেশও ছিল বেশ সরগরম। প্রায় ৮৭ হাজার সমর্থকের উল্লাস আয়োজক দেশের ফুটবলারদের চাঙ্গা করে তোলার পক্ষে ছিল যথেষ্ট।

এর মধ্যেও গতিময় ফুটবল খেলে প্রতিপক্ষের সঙ্গে সমানে পাল্লা দিয়ে যান ভারতীয়রা। মালয়েশিয়া মূলত ডানদিকের উইং দিয়ে ভারতের অঞ্চলে বারবার হানা দেয়। সাত মিনিটের মাথায় প্রথম গোল পায় মালয়েশিয়া। এক্ষেত্রে ভারতীয় রক্ষণের ঢিলেমি অবশ্যই ছিল।

ডানদিক থেকে কর্নার কিকে তোলা এনড্রিকের বল বক্সের মধ্যে সন্দেশ ঝিঙ্গনের ভুলে পেয়ে যান নুয়া হামজা। তিনি গোলের ডানদিকে ডিয়নজোহানের কাছে বল পাঠান। অসাধারণ হাফ ভলিতে বল জালে জড়িয়ে দেন ডিয়ন (১-০)। ভারতের তিন ডিফেন্ডার তখন ওখানে থাকা সত্ত্বেও তাঁকে আটকাতে পারেননি।

ভারত অবশ্য সমতা আনতে খুব বেশি সময় নেয়নি। ১৪ মিনিটের মাথায় দুরন্ত এক প্রতি আক্রমণ থেকে গোল করেন নাওরেম মহেশ সিং। ডানদিক দিয়ে ওঠা লালিয়ানজুয়ালা ছাঙতের ক্রস বক্সের মধ্যে এসে পড়লে তা দুর্দান্ত ব্যাকহিল করে মহেশের কাছে পাঠান সহাল। দুর্দান্ত গতিতে সোজা গোলে শট নেন মহেশ (১-১)।

কিন্তু এর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই প্রতিপক্ষকে কার্যত পেনাল্টি উপহার দেন নিখিল পূজারি। বক্সের মধ্যে মালয়েশিয়ান ফরোয়ার্ড ড্যারেনের গোড়ালিতে পিছন থেকে টোকা মারেন নিখিল। তাতে মাটিতে পড়ে যান ড্যারেন এবং পেনাল্টি আদায় করে নেন তিনি। পেনাল্টি কিকে যে দিকে শট মারেন আরিফ আইমান, সে দিকেই ডাইভ দেন গোলকিপার গুরপ্রীত। কিন্তু তাঁর দস্তানার কয়েক সেন্টিমিটার দূর দিয়ে বল গোলে ঢুকে যায় (২-১)। এই পেনাল্টির সিদ্ধান্ত নিয়ে ভারতীয় ফুটবলাররা ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

ফিফা ক্রমতালিকায় ভারতের চেয়ে প্রায় ৩২ ধাপ পিছিয়ে থাকলেও এ দিন ঘরের মাঠের সুবিধা নিয়ে দাপুটে ফুটবল খেলে মালয়েশিয়া। শুরুর দিকে তারা মূলত ডানদিক দিয়ে আক্রমণ করলেও পরে ক্রমশ বাঁ দিকের উইং দিয়েও আক্রমণ শুরু করে। ২৯ মিনিটের মাথায় আকাশ মিশ্রর ভুলকে কাজে লাগিয়ে বল গোলের দিকে ঠেলে দেন আইমান। কিন্তু তা গোললাইনের সামনে দিয়ে দূরের পোস্টের বাইরে চলে যায়।

এ দিন প্রথমার্ধে ভারতীয় দলকে বেশ চাপে রাখে মালয়েশিয়া। তারা সব মিলিয়ে চারটি শট গোলে রাখে, ভারত দুটি। তবে শেষ দিকে সমতা আনার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে ভারত। এ জন্য কিছুটা হাইলাইন ফুটবলও খেলতে শুরু করে তারা। এই সুযোগ কাজে লাগিয়েই তৃতীয় গোলটি করে ফেলে মালয়েশিয়া। ৪২ মিনিটের মাথায় নিজেদের বক্সের সামনে বলের নিয়ন্ত্রণ হারান মেহতাব সিং, যা থেকে বল পেয়ে ফয়জল হালিমকে পাস দেন আইমান। বক্সে ঢুকে গুরপ্রীতকে টপকে জালে বল জড়াতে বিন্দুমাত্র ভুল করেননি ফয়জল (৩-১)। প্রথমার্ধে বল পজেশন ভারতেরই বেশি (৫৫-৪৫) থাকলেও গোলের দিক থেকে পিছিয়ে পড়ে তারা।

দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকে মালয়েশিয়া তাদের চাপে রাখলেও ৫১ মিনিটের মাথায় যে প্রতি আক্রমণের সুযোগটি পায় ভারত, তা থেকেই ব্যবধান কমিয়ে আনে। বাঁ দিক থেকে মহেশের মাপা ক্রস পান বক্সের মধ্যে ডানদিকে থাকা ছাঙতে। তাঁর সঙ্গেই বাঁদিকে গোলের সামনে চলে আসেন সুনীল ছেত্রী। অবধারিত ভাবে তাঁকেই বল দেন ছাঙতে এবং আলতো টোকায় জালে বল জড়িয়ে দেন সুনীল (৩-২)। দু’জনের মাঝখানে কোরবিন লরেন্স থাকলেও তিনি ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যাওয়ায় গোল আটকাতে পারেননি।

কিন্তু ৫৭ মিনিটের মাথায় যে ঘটনাটি ঘটে, তা অবিশ্বাস্য বললেও কম বলা হয়। বক্সের ডানদিক থেকে ছাঙতের গোলমুখী শট গোলকিপারের গায়ে লেগে গোললাইন পার করে যাওয়ার পর তা ডিয়নজোহান ক্লিয়ার করেন। রেফারি কিন্তু গোলের বাঁশি বাজাননি! বারবার টিভি রিপ্লে দেখার অনুরোধ করেন ভারত অধিনায়ক সুনীল ছেত্রী। কিন্তু তাতেও কর্ণপাত করেননি রেফারি। পেনাল্টি, অফসাইড, ফ্রি কিক নিয়ে অনেক বিতর্ক হয় ঠিকই। কিন্তু গোললাইন পার করে যাওয়ার পরেও গোল না দেওয়ার সিদ্ধান্ত বিরল। যা এদিন করে দেখান থাইল্যান্ডের রেফারি মোঙ্কোলচাই পেছরি।

একশো শতাংশ ন্যায্য গোল না পেয়ে হতাশ ভারতীয়রা যখন খেলায় ফেরার চেষ্টা শুরু করছেন, তখনই মালয়েশিয়া তাদের চতুর্থ গোলটি পেয়ে যায়। রক্ষণের ভুলেই গোললাইনের সামনে থেকে জালে বল জড়িয়ে দেন কোরবিন লরেন্স (৪-২)। ছাঙতের গোলটি নাকচ না হলে হয়তো ছবি অন্যরকম হত। মহেশ ও ছাঙতে এ দিন দুই উইংয়ে প্রতিপক্ষকে বেশ ব্যস্ত রাখেন।

সুনীলকে ৬৩ মিনিটের মাথাতেই তুলে নেন ভারতীয় কোচ ইগর স্টিমাচ। তাঁর জায়গায় নামান লিস্টন কোলাসোকে। একই সঙ্গে আকাশ মিশ্রর বদলে নামানো হয় রোশন নাওরেমকে। আক্রমণের চেষ্টা এর পরেও চালিয়ে যায় ভারত। ৬৯ মিনিটের মাথায় ছাঙতের ভলি বারে লেগে ফিরে আসে। ৭৩ মিনিটের মাথায় মহেশের ক্রসে গোল লাইনের সামনে যে সুবর্ণ সুযোগ নষ্ট করেন সহাল, তাও কম অবিশ্বাস্য নয়। গোলের সামনে থেকে গোলকিপারের গায়ে শট মারেন সহাল। শেষ দিকে আক্রমণের ধার বাড়াতে ৮১ মিনিটের মাথায় ডিফেন্ডার নিখিল পূজারিকে তুলে নিয়ে ফরোয়ার্ড নন্দকুমার শেখরকে নামায় ভারত।

শেষ দশ মিনিটে দেখা যায়, মালয়েশিয়া বক্সের মধ্যে প্রায় আট-ন’জন মোতায়েন করে দিয়েছে এবং ভারতের প্রায় অর্ধেক দলই তখন প্রতিপক্ষের গোল এরিয়ায়। ৮৬ মিনিটের মাথায় সুরেশের শট বারের ওপর দিয়ে উড়ে যায়। ৮৮ মিনিটের মাথায় বক্সের বাইরে থেকে নেওয়া কোলাসোর জোরালো শট দখলে নিয়ে নেন গোলকিপার। পাঁচ মিনিট বাড়তি সময় পেয়েও অবশ্য আর গোলের সংখ্যা বাড়াতে পারেনি ভারত।