মুম্বই : গোটা টুর্নামেন্টে অপরাজিত। তাঁর নেতৃত্বে কার্যত স্বপ্নের দৌড় দিচ্ছে টিম ইন্ডিয়া। এহেন রোহিত শর্মা কেরিয়ারে কম কঠিন সময় দেখেননি। তবে, ২০১১ সালে বিশ্বকাপ দল থেকে বাদ পড়া তাঁর কেরিয়ারে টার্নিং পয়েন্ট বলে মনে করেন তাঁর শৈশবের কোচ ও মেন্টর দীনেশ লাড।


চার বছর আগে যখন ভারতের বিশ্বকাপ অভিযানে বিরাট কোহলির সহকারী হিসাবে ইংল্যান্ডের উদ্দেশে পাড়ি দিয়েছিলেন হিটম্যান, সেই সময় হিটম্যানের আরও লক্ষ লক্ষ ভক্তর মতো উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন ছোটবেলার কোচও। সেই সময় তিনি বলেছিলেন, "ওঁর কাছে বিশ্বকাপের অর্থ গোটা বিশ্ব। ২০১১ সালে যখন বাদ পড়েছিলেন, সেটা ছিল ওঁর কেরিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট। আশা করছি, এবার রোহিত ট্রফি হাতে ফিরবেন।" কিন্তু, সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি কোচের। কিন্তু এবার ? এই বিশ্বকাপে অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছেন রোহিত। ২০১৯-এও ট্রফি হাতে ফিরেছিলেন হিটম্যান। তবে, প্লেয়ার অফ দ্য টুর্নামেন্টের পুরস্কার হাতে। আসল পুরস্কার জয়ের পরিবর্তে যা কার্যত শান্ত্বনা হয়ে থেকেছিল। আইপিএল যৌথভাবে অন্যতম সফল অধিনায়কও রোহিত। সাদা বলের ক্রিকেটে দুনিয়ার অন্যতম ভয়ঙ্কর ব্যাটার তিনি। টেস্টে নির্ভরশীল ওপেনার হিসাবে নিজের জায়গা শক্তপোক্ত করেছেন। ২০২০ সালে খেল রত্ন পুরস্কারে ভূষিত করা হয় রোহিতকে। শুধু কী তাই ! শিষ্যের সাফল্যের স্বাদ ছুঁয়েছিল গুরুকেও। লাড, যিনি কিনা শার্দুল ঠাকুরকেও কোচিং দিয়েছিলেন, তাঁকে দ্রোণাচার্য পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়।


বরাবর নিজের কাঁধে ভার বহন করতে সিদ্ধহস্ত রোহিত। তাঁর যখন ১২ বছর বয়স, তখন তাঁর বাবা টাকা ধার করে রোহিতকে বোরিভেলির ক্রিকেট ক্যাম্পে পাঠিয়েছিলেন। সেই সময় দাদু-ঠাকুমা ও কাকা রবির সঙ্গে থাকতেন রোহিত। সেই ক্যাম্পে কোচিং দিতেন লাড। প্রথমে রোহিতের অফস্পিন দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন কোচ। তিনিই তাঁর কাকা রবিকে বুঝিয়ে রোহিতকে স্বামী বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করে দেন। এমনকী তাঁর ফি ছাড়েরও ব্যবস্থা করেন। শীঘ্রই স্কুল ম্যানেজমেন্টের সুনজরে চলে আসেন রোহিত। বাড়তে থাকে স্থানীয় ক্রিকেট কমিউনিটির প্রত্যাশাও। অফস্পিনের জাদুতে সকলের নজর কাড়তে থাকেন রোহিত। সেই সময় একদিন নেটে আসতে দেরি করেন কোচ লাড। একটু পরে ঢুকে তিনি দেখেন, রোহিত শ্যাডো প্র্যাক্টিস করছেন। তাঁর ব্যাটিংটাও ভাল লাগে তাঁর। কোচ লাড বুঝতে পারেন, রোহিত ব্যাটও করতে পারবেন। রোহিতের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে, লাড তাঁর মুম্বইয়ের ক্রিকেট বন্ধুদের বোঝান যে, বান্দ্রা বাইরেও উঠতি ক্রিকেটারদের দিকে নজর দিতে। 


আন্ডার-১৬ সিলেকশন ট্রায়াল থেকে বাদ পড়ে প্রাথমিক ধাক্কা খান রোহিত। কিন্তু, বিসিসিআই বয়স সংক্রান্ত নিয়ম পরিবর্তন করায় তাঁর ভাগ্য ফিরতে থাকে। আন্ডার-১৫ ও আন্ডার-১৭ ক্যাটেগরির জেরে আরও এক বছর পেয়ে যান রোহিত। তাঁর প্রতিভা সেই সময় নজর কাড়ছে। মুম্বইয়ের সিলেকশন ট্রায়ালে প্লেয়ার অফ দ্য টুর্নামেন্ট টাইটেল জিতে নেন হিটম্যান। 


এরপর নিজের বিল্ডিংয়েই রোহিত ও তাঁর পরিবারকে একটি বাড়ি খুঁজে পেতে সাহায্য করেন লাড। প্রতিভাবান ক্রিকেটার খুঁজে বের করার মাস্টার ভাসো পরঞ্জাপের চোখে পড়েন রোহিত। তাঁর তত্ত্বাবধানে আন্ডার-১৭ স্কোয়াডে জায়গা হয়ে যায় হিটম্যানের। এমনকী একাদশেও ঢুকে পড়েন। এমনকী পরঞ্জাপে সেই সময়ে চিফ জুনিয়র সিলেক্টর প্রবীণ আমরেকে স্থানীয় একটি ম্যাচে রোহিতকে ব্যাট করতে দেখার ব্যবস্থাও করে দিন। ২০০৪ নাগাদ মুম্বইয়ের উঠতি তারকা ক্রিকেটার হিসাবে নজর কাড়তে শুরু করে দেন রোহিত। ২০০৬ সালে আন্ডার-১৯ বিশ্বকাপে জায়গাও করে নেন।   


এরপর ২০০৭ সালে বেলফাস্টে আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক রোহিতের। ভারতের টি২০ বিশ্বকাপ স্কোয়াডে (সেই বছরই দক্ষিণ আফ্রিকায়) তরুণ সদস্য হিসাবে পেছনের সারিতে চলে যান সেই সময়। আবার এগিয়ে আসেন কোচ। তবে, এবার আর কোচ হয়ে নয়। মেন্টর হিসাবে। মেন্টর লাড বলেন, "আমি ওঁকে বলি, সিনিয়রদের থেকে শিখতে। আর যা করছেন তা উপভোগ করতে। সেই সময় চোট পেয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ম্যাচ থেকে ছিটকে যান যুবরাজ। ব্যাট করার সুযোগ পান রোহিত। সেই সময় নিজের সবটা উজার করে দিয়ে অর্ধ শতরান করেন রোহিত। প্রতিভা আর ভাগ্য।" বাকিটা তো ইতিহাস। টিম ইন্ডিয়ার ঐতিহাসিক অভিযানের পর দেশে ফিরে মুম্বই বিমানবন্দর থেকে ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়াম পর্যন্ত হাজার হাজার ফ্যানের অভ্যর্থনা। বাসে চড়ে সেই ঐতিহাসিক যাত্রার সাক্ষী ছিলেন রোহিতও।