কলকাতা: অলিম্পিক্সের মঞ্চে প্রথমবার দেশের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ বাংলার টেবিল টেনিস খেলোয়াড় সুতীর্থা মুখোপাধ্যায়ের সামনে। জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপের পাশাপাশি কমনওয়েলথ গেমস, সাফ গেমসেও টিটিতে সোনা জিতেছেন। এবার লক্ষ্য আরও বড়। নৈহাটি থেকে টোকিও, কেমন এই সফর, নির্বাসনের অন্ধকার পর্ব কাটিয়ে আলোয় ফিরলেন কীভাবে, কেরিয়ারে কোচ সৌম্যদীপ রায়ের ভূমিকা কী, এবিপি লাইভের সব প্রশ্নে অকপট সুতীর্থা। টোকিও রওনা হওয়ার আগে দিলেন একান্ত সাক্ষাৎকার।


জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পাশাপাশি সাফ গেমস, কমনওয়েলথ গেমসে সোনা রয়েছে বঙ্গকন্যার। কিন্তু অলিম্পিক্সের আসরে দেশের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ এই প্রথম। পাঁচ বছর আগে রিও অলিম্পিক্সের সময় তিনি টেবিল টেনিস থেকে নির্বাসিত ছিলেন। বয়স ভাঁড়ানোর গুরুতর অভিযোগ উটেছিল তাঁর বিরুদ্ধে। অন্ধকার সেই অধ্যায় কাটিয়ে আলোয় ফিরেছেন নৈহাটির তরুণী। অলিম্পিক্সেও তাঁর সাফল্যের প্রার্থনা চলছে গোটা বাংলা জুড়ে।


কীভাবে কাটিয়ে উঠেছিলেন কেরিয়ারের সেই কঠিন পর্ব? সুতীর্থা বলছেন, 'প্রত্যেকের জীবনেই চড়াই উৎরাই থাকে। আমার পরিবারের সকলে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। বিশেষ করে আমার মা। আমাকে সব সময় বোঝাতেন, হাল ছাড়লে চলবে না। সেই সঙ্গে আমার কোচ সৌম্য়দীপ রায় ও পৌলমী ঘটক। সৌম্যদীপদা ও পৌলমীদি আমাকে মা-বাবার মতো করে আগলে রেখেছিল। প্রতিভার পাশাপাশি কঠোর পরিশ্রম, নিষ্ঠা আর সংকল্প দিয়ে ওই জায়গা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছি।'


অলিম্পিক্সে দেশের প্রতিনিধিত্ব করা, কত বড় সুযোগ বলে মনে হচ্ছে? সুতীর্থার গলায় উচ্ছ্বাস। বলছেন, 'যে কোনও ক্রীড়াবিদেরই স্বপ্ন থাকে অলিম্পিক্সে দেশের প্রতিনিধিত্ব করা। আমি সেই সুযোগ পেয়েছি। আমার মা বন্ধুর মতো। মায়ের বরাবরের স্বপ্ন ছিল আমি অলিম্পিক্সের মঞ্চে দেশের হয়ে খেলি। সেই স্বপ্ন সার্থক হয়েছে। জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছি, সাফ গেমসে সোনা পেয়েছি, কমনওয়েলথে চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। বাকি ছিল শুধু অলিম্পিক্স। অধরা সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। টোকিওতে নিজের সেরাটা দেব।'


শনিবার রাতে দিল্লি থেকে টোকিওর উদ্দেশে পাড়ি দিচ্ছেন। কিটব্যাগে কোনও পয়মন্ত জিনিস রাখেন? সুতীর্থা বলছেন, 'পয়মন্ত তো অনেকেই মানেন। আমারও কিছু বিশ্বাস আছে। আমি কিটব্যাগে একটি বিশেষ জার্সি ও তোয়ালে রাখি। বিশ্বাস করি ওই দুটো আমার সঙ্গে থাকলে ভাল পারফর্ম করব।'


কোচ মিহির ঘোষের কাছে টেবিল টেনিসে হাতেখড়ি। অলিম্পিক্সে খেলতে যাওয়ার আগে শৈশবের কোচের আশীর্বাদও নিয়ে এসেছেন সুতীর্থা। বলছিলেন, 'মিহির কাকুর অবদান কোনওদিন ভুলব না। আমি টেবিল টেনিসে এসেছি ওঁর হাত ধরে। খেলা শিখিয়েছেন, বকাঝকা করেছেন। ওইটুকু না থাকলে এই জায়গায় পৌঁছতে পারতাম না। আমি মিহির কাকুর সঙ্গে দেখা করে প্রণাম জানিয়ে আশীর্বাদ নিয়ে এসেছি।'


সম্প্রতি সোনিপথে জাতীয় শিবির চলছিল। সেখান থেকে কয়েকদিনের ছুটিতে বাড়ি এসেছিলেন সুতীর্থা। যাদবপুরে ছিলেন। তারপর দিল্লি হয়ে টোকিও রওনা। সোনিপথে জাতীয় শিবিরে প্রস্তুতি কেমন হল? সুতীর্থা বলছেন, 'প্রস্তুতি ভালই হয়েছে। তবে আমি খুব খুশি যে আমার সঙ্গে কোচ সৌম্যদীপ রায় টোকিও যাচ্ছেন। সৌম্যদীপদা আমার খেলা ভীষণ ভাল বোঝে। সব সময় পাশে থাকে। পরামর্শ দেয়। গত ছ'বছর ধরে সৌম্যদীপদার কাছে প্র্যাক্টিস করছি। আমার খেলা আমূল বদলে গিয়েছে এখন। সৌম্যদীপদা সঙ্গে থাকায় আমার আত্মবিশ্বাসও অনেক বেশি। আশা করছি টোকিও থেকে ভাল কিছুই করে ফিরব।'


ভারতীয় টেবিল টেনিস দলের পদক সম্ভাবনা নিয়েও ইতিবাচক থাকছেন সুতীর্থা। শরথ কমল, মণিকা বাত্রার মতো খেলোয়াড়েরা রয়েছেন জাতীয় দলে। সুতীর্থা বলছেন, 'শরথ ভাই তো ভারতীয় টেবিল টেনিসে কিংবদন্তি। এটা নিয়ে চারবার অলিম্পিক্সে খেলছে। দারুণ ছন্দে রয়েছে। পদক জিততেই পারে। মণিকা বাত্রাও ভাল খেলছে। মণিকা ও শরথ ভাই মিক্সড ডাবলসে পদক পেতেই পারে। সত্যেন ভাই ছন্দে রয়েছে। পুরুষ দলেরও পদক সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা সকলেই সর্বস্ব দিয়ে ঝাঁপাব। নিজেদের সেরাটা দেব।'



ইউরোপের খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধে ঈর্ষণীয় রেকর্ড সুতীর্থার। তবে টেবিল টেনিসে ভীষণ শক্তিশালী মনে করা হয় চিন, চিনা তাইপে, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াকে। সুতীর্থাও তাই প্রস্তুতিতে কোনও খামতি রাখতে চান না। বলছেন, 'টেবিল টেনিসে এশীয় দেশগুলি খুব শক্তিশালী। তবে টেবিল টেনিস এমন একটি খেলা যেখানে আগে থেকে কৌশল ভেবে রাখা যায় না। এক একজনের বিরুদ্ধে এক এক রকম স্ট্র্যাটেজি নিতে হয়। খেলতে খেলতে দেখে নিতে হয় প্রতিপক্ষ কোথায় শক্তিশালী, কোথায় দুর্বল। সেই বুঝে মুহূর্তের মধ্য়ে নিজের খেলার নীল নকশা সাজিয়ে নিতে হয়। '


মনঃসংযোগ বাড়ানোর জন্য কী করেন? সুতীর্থা বলছেন, 'যোগাসন করি। ধ্যান করি। মনোবিদের পরামর্শ নিই। আমার নিজস্ব এক মনোবিদ আছেন। মাইন্ড গেম খেলি। প্রচুর টেবিল টেনিস ম্যাচ দেখি ইউটিউবে।'


অর্জুন পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন। তবে অলিম্পিক্স পদকই সুতীর্থার কাছে পাখির চোখ।