কলকাতা: সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। এই নামটার সঙ্গেই জড়িয়ে বাঙালির আবেগ, বাঙালির অহংকার। বিশ্ব ক্রিকেটকে যে শাসন করার ক্ষমতা রাখে ভারত, তার বীজ একটা সময় পুঁতে দিয়েছিলেন তিনিই। চোখে চোখ রেখে ক্রিকেটের রাঘববোয়ালদের বিরুদ্ধে লড়াই করার মানসিকতা দেখিয়েছিলেন, দেখতে শিখিয়েছিলেন বাকিদের। যার ধারা পরবর্তীতে বয়ে নিয়ে গিয়েছেন ধোনি থেকে বিরাটরা। সৌরভের স্বর্ণোজ্জ্বল ইনিংসগুলোর মধ্যে অন্যতম লর্ডসে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ১৩১ রানের ইনিংসটি। যা তাঁর কেরিয়ারের প্রথম টেস্ট শতরানও। নিজের অভিষেক টেস্টেই ক্রিকেটের মক্কায় সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে বেহালা থেকে ভারতীয় ড্রেসিংরুমে জায়গা করাটা নেহাতই ফ্লুক ছিল না। আজকের ''ওস্তাদের মার'' সিরিজে সৌরভের সেই ইনিংস নিয়েই আমাদের প্রতিবেদন --
বাংলা থেকে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চাপানো ক্রিকেটার এর আগেও এসেছেন। তালিকায় পঙ্কজ রায়, প্রণব রায়, গোপাল বসু, সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো ব্যক্তিত্বরা। তবে সৌরভের মতো কাউকেই হয়ত কেরিয়ারে বারবার ধাক্কা সহ্য করতে হয়নি। গল্পের শুরুতে একটু ফ্ল্যাশব্যাকে যাওয়া যাক। ১৯৯০-৯১ রঞ্জি মরসুম। বাংলার হয়ে তরুণ সৌরভের পারফরম্যান্স নজর কেড়েছিল নির্বাচকদের। ছিয়ানব্বইয়ের যে ঐতিহাসিক ইনিংস নিয়ে এই প্রতিবেদন, তার ৪ বছর আগেই ওয়ান ডে অভিষেক হয়ে গিয়েছিল এই বাঁহাতি ব্যাটারের। কিন্তু ভাগ্য সহায় ছিল না। ক্যারিবিয়ানদের বিরুদ্ধে ১৯৯২ সালের সেই ম্যাচে মাত্র ৩ রান করে আউট হন। দল থেকে বাদ পড়়েন এরপরই। ফিরে আসার যে রাস্তাটুকু তৈরি ছিল, সেটাও বন্ধ হয়ে যায় কিছু 'উড়ো' বিতর্কে। খবর রটেছিল যে সৌরভের ঔদ্ধত্য নাকি নির্বাচক ও টিম ম্যানেজমেন্টের রোষের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এমনও অভিযোগ উঠেছিল যে মাঠে সতীর্থদের জন্য জল বওয়ার কাজ নাকি করতে রাজি হননি তিনি। যদিও পরবর্তীতে সেই অভিযোগ পুরোপুরি উড়িয়ে দিয়েছিলেন সৌরভ নিজেই। তবে মাঝখান থেকে এই সব বিতর্কে ভারতীয় দলের গ্রহ থেকে হঠাৎ করেই হারিয়ে যান তিনি। ফিরে আসতে হয় ঘরোয়া ক্রিকেটে। হাল ছাড়ার বান্দা কোনওদিনই তিনি ছিলেন না। আবার লড়াই শুরু করেন। ১৯৯৪-৯৫ সালে রঞ্জিতে ভাল পারফরম্যান্স, ১৯৯৫ সালে দলীপ ট্রফিতে ১৭১ রানের ইনিংস নির্বাচকদের বাধ্য করে সৌরভকে ফের জাতীয় দলের আঙিনায় ফিরিয়ে আনতে। ব্যাস আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৯৬ সালে ইংল্যান্ড সফরে সুযোগ চলে আসে।
মহম্মদ আজহারউদ্দিনের অধিনায়কত্বে সেবার ভারতীয় দল ইংল্যান্ডে উড়ে গিয়েছিল। প্রথম টেস্টে একাদশে জায়গা হয়নি সৌরভের। কিন্তু ওই যে কথায় আছে যে, কারও পৌষমাস তো কারও সর্বনাশ। নভজ্যোৎ সিংহ সিধুর চোট দরজা খুলে দেয়। ম্যাচে ওপেনিংয়ে নেমেছিলেন বিক্রম রাঠৌর। দলীয় ১৫ রানের মাথায় তিনি আউট হতে তিন নম্বরে ক্রিজে আসেন সৌরভ। পিটার মার্টিন, রনি ইরানি, ক্রিস লিউইস, ডমিনিক কর্ক সম্পন্ন ঘাতক বোলিং লাইন আপের সামনে বুক চিতিয়ে লড়াই শুরু করেন। সেই ম্যাচে সৌরভের সঙ্গে টেস্ট অভিষেক হয়েছিল রাহুল দ্রাবিড়েরও। মি. ডিপেন্ডেবল সেই ম্যাচে মাত্র ৫ রানের জন্য শতরান হাতছাড়া করলেও আর কোনও ভুল করেননি সৌরভ। ৪৩৫ মিনিট ক্রিজে থেকে ৩০১ বলে ১৩১ রানের ইনিংস খেলেন তিনি সেই ম্যাচে। যা সাজানো ছিল ২০ টি বাউন্ডারিতে।
সৌরভ একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ''সেদিন চা পানের বিরতির সময়ে যখন ড্রেসিংরুমে ফিরি, তখন আমি সদ্য সেঞ্চুরি পূরণ করেছি। লর্ডসের সেই ভরা স্টেডিয়ামে প্রতিটি শটের জন্য দর্শকদের অভিবাদন পাচ্ছিলাম। অদ্ভূত একটা মিশ্র অনুভূতি কাজ করছিল মনের মধ্যে। সচিন আমাকে চা অফার করেছিল তখন। প্রথম টেস্ট খেলছি, আমার মানসিক চাপের জায়গাটা ও বুঝতে পেরেছিল। তাই হয়ত আমাকে একটু মানসিকভাবে হালকা করার চেষ্টা করছিল সচিন।''
জিওফ্রে বয়কটের মতো ক্রিকেট ব্যাক্তিত্ব সৌরভের ইনিংসে এতটাই মোহিত হয়েছিলেন যে তাঁকে 'প্রিন্স অফ ক্যালকাটা' আখ্যা দেন। যেই নাম পরবর্তীতে বিশ্ববিখ্যাত হয়ে যায়।