কলকাতা: রবিবারের দুপুর। কলকাতা ময়দানের তালতলা মাঠে বিজয়া স্পোর্টস ক্লাবের হয়ে ইনিংস ওপেন করতে নামল ছোটখাট চেহারা। মাঠের চারপাশে জড়ো হওয়া ক্রিকেটপ্রেমীদের মধ্যে বলাবলি শুরু হয়ে গেল, কপাল সঙ্গ দিলে এই ছেলে নির্ঘাৎ ভারতীয় দলে (Team India) খেলত। কেউ কেউ বললেন, এরকম প্রতিভা বাংলা ক্রিকেটে বড় একটা আসেনি। সেই সঙ্গে চর্চা চলল, কতটা মনের জোর থাকলে মৃত্যুর মুখ থেকে এভাবে মাঠে ফেরা যায়!


নাটকীয় প্রত্যাবর্তন


শুভজিৎ পাল (Subhojit Paul)। এক সময় বাংলার উদীয়মান ক্রিকেটারদের মধ্যে অন্যতম সেরা প্রতিভা মনে করা হতো। কিন্তু দল থেকে বাদ পড়ার হতাশা ও ব্যক্তিগত জীবনের ঝড় সামলাতে না পেরে গলায় অ্যাসিড ঢেলেছিলেন। আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়-ইরফান পাঠান-সুরেশ রায়নাদের একসময়কার সতীর্থ। দিনের পর দিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষেছেন। হার মানেননি। শ্বাসনালী অ্যাসিডে দগ্ধ। কার্যত হারিয়েছেন বাকশক্তি। অভিমানে ক্রিকেট থেকেই দূরে ছিলেন। অবশেষে বরফ গলেছে। ফের বাইশ গজে প্রত্যাবর্তন ঘটিয়েছেন শুভজিৎ। চলতি মরসুমে সিএবি আয়োজিত স্থানীয় ক্রিকেটে খেলছেন বিজয়া স্পোর্টস ক্লাবের হয়ে। দশ বছর পর ক্লাব ক্রিকেটে ফেরা। মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে এবিপি লাইভকে শুভজিৎ বললেন, 'বিজয়া স্পোর্টস ক্লাবের প্রস্তাব পেয়ে ফেরাতে পারিনি। দশ বছর পর ময়দানে ফিরেছি। দ্বিতীয় ডিভিশন লিগে ৩টি ম্যাচ খেলেছি। একটি ম্যাচে উইকেটকিপিংও করেছি।'


সেকেন্ড ইনিংস


শুভজিতের ময়দানে ফেরার নেপথ্যে বিজয়া স্পোর্টস ক্লাবের কোচ সঞ্জীব পাণ্ডে। তিনি বলছিলেন, 'ওর মতো প্রতিভা বাংলা ক্রিকেটে খুব কম এসেছে। কিন্তু দুর্ঘটনার পর থেকে মাঠে আসত না। ওকে খেলার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, ময়দানকে কিছু দেওয়ার রয়েছে ওর।' সঞ্জীব যোগ করলেন, 'ও ভীষণ রোমাঞ্চিত। ওর অভিজ্ঞতা দলের তরুণদের সঙ্গে ভাগ করে নেয়। আমাদের উইকেটকিপার মণীশ কুমার একটা ম্যাচে ভালভাবে বল ধরতে পারছিল না। শুভজিৎ নিজে ১০ ওভার উইকেটকিপিং করে ওকে দেখিয়ে দেয়। কোথায় ভুলভ্রান্তি হচ্ছিল শুধরে দেয়। এন সি চট্টোপাধ্যায় টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে আমাদের হয়ে ইনিংস ওপেন করছে। ভীষণ ইতিবাচক থাকছে।' জানা গেল, পরের মরসুমে শুভজিৎকে দলে নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে প্রথম ডিভিশনের একটি ক্লাব।


আলো-আঁধারি


বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে নজরকাড়া পারফরম্যান্স, বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেটে সাফল্য়, অনূর্ধ্ব ১৯ ভারতীয় দলে সুযোগ, বাংলার হয়ে রঞ্জি ট্রফি অভিষেক। শুভজিতের কেরিয়ারের শুরুর দিকে পুরোটাই যেন উত্তরণের কাহিনী। তবে রঞ্জি অভিষেক সুখের হয়নি। ইডেনে তামিলনাড়ুর বিরুদ্ধে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়-দীপ দাশগুপ্তদের দলের হয়ে ওপেন করে দুই ইনিংসেই ব্য়র্থ। রান সাকুল্যে ৩। বাংলা দলের প্রথম একাদশে আর সুযোগ পাননি। হতাশা থেকেই আরও অনেকের সঙ্গে বিতর্কিত ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগ বা আইসিএলে নাম লেখানো। পরে সেখান থেকে ক্রিকেটের মূল স্রোতে ফিরতে চেয়েছিলেন। পারেননি। তাঁর আচরণ নিয়েও অনেক অভিযোগ উঠেছে। সেই সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনে ঝড়। সামলাতে না পেরে আত্মহত্যার চেষ্টা। অ্যাসিডের দহনে শ্বাসনালী দলা পাকিয়ে যাওয়া।


হারানো সুর


যমে-মানুষে টানাটানির পর প্রাণরক্ষা হয়েছে বাংলার এক সময়ের সাড়া জাগানো উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যানের। অ্যাসিডের জ্বালায় ভোকাল কর্ড পুড়ে গিয়েছে। তারপর থেকে আর কথা বলতে পারেন না এক সময় বাংলার সাড়া জাগানো ক্রিকেটার। ঠোঁট নাড়েন। মুখ দিয়ে সামান্য যেন আওয়াজ বেরোয়। তবে এতটাই ক্ষীণ যে, শোনা যায় না বললেই চলে। ফিসফিসে স্বর আর ঠোঁট ও মুখের নড়াচড়া দেখে অনুমান করে নিতে হয়। গলার ক্ষত ঢাকতে স্কার্ফ পরে থাকেন। রবিবার ম্যাচেও নেমেছিলেন জার্সির নীচে স্কার্ফজাতীয় কিছু একটা পরে। বিশেষ পরিচিত ছাড়া ফোন ধরেন না বড় একটা। গলা ছেড়ে কথা বলতে পারেন না যে! বরং হোয়াটসঅ্যাপে স্বচ্ছন্দ। মতামত আদান-প্রদানের জন্য মোবাইলে টাইপ করাই এখন শুভজিতের কাছে সেরা বিকল্প।


প্রতিশ্রুতি


ঋদ্ধিমান সাহার আগে রঞ্জি ট্রফিতে (Ranji Trophy) বাংলার হয়ে অভিষেক হয়েছিল শুভজিতের। তামিলনাড়ুর বিরুদ্ধে ইডেনে দু'ইনিংসেই ব্যর্থ হন। প্রথম ইনিংসে করেছিলেন ৩ রান। দ্বিতীয় ইনিংসে ০। সবুজ উইকেটে বাংলার ব্যাটিং বিপর্যয় হয়েছিল। তামিলনাড়ুর কাছে ২২২ রানে হেরে গিয়েছিল বাংলা। শুভজিতের কাছে বাংলার প্রথম একাদশের দরজা আর কখনও খোলেনি। ২০১২-১৩ সালে টাউন ক্লাবের হয়ে শেষ সিএবি-র টুর্নামেন্ট খেলেছিলেন। তারপর থেকেই ময়দান থেকে দূরে ছিলেন। তবে ফেরার পর থামতে চান না। সে যতই বয়স ৩৭ হোক না কেন। শুভজিৎ বলছেন, 'লিগে হাইকোর্টের বিরুদ্ধে ৪৮ রান করেছিলাম। মোটামুটি রান পাচ্ছি। ভীষণ ভাল লাগছে। আরও রান করতে চাই। ফের যেন ক্রিকেট উপভোগ করতে শুরু করেছি।'


আরও পড়ুন: এরপরেও প্লে-অফে যেতে পারে মুম্বই? এবিপি লাইভের প্রশ্নে কী বললেন বুমরা?