কলকাতা: টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাকিস্তানের কাছে পরাস্ত হওয়ার পরই কুৎসিত আক্রমণের শিকার মহম্মদ শামি। মাঠ থেকে বেরনোর সময় সরাসরি সমর্থকদের অশ্লীল মন্তব্য়ের নিশানা হয়েছিলেন। বাংলার পেসারকে ঘিরে সোশ্যাল মিডিয়াতেও চলছে প্রবল ট্রোলিং। এমনকী, তাঁকে 'দেশদ্রোহী' বলেও তোপ দাগা চলছে।


যে ঘটনা দেখে স্তম্ভিত মীররঞ্জন নেগি। শামির হেনস্থা তাঁকে মনে করিয়ে দিচ্ছে ৩৯ বছরের পুরনো তিক্ত স্মৃতি। যখন এশিয়ান গেমসের ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে ৭ গোলে হেরেছিল ভারতীয় হকি দল। যে ম্যাচে ভারতের গোলরক্ষার দায়িত্ব ছিল নেগির ওপর। ম্যাচের পর যাঁকে কাঠগড়ায় তোলা হয়েছিল। বেনজির আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। নেগির দুর্বিষহ সেই অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হয়েছিল বলিউডের সুপারহিট সিনেমা 'চক দে ইন্ডিয়া'-তে।


পাকিস্তানের কাছে ভারতের হারের পর শামিকে নিশানা হতে দেখে হতাশ নেগি। ইনদওর থেকে ফোনে এবিপি লাইভকে বললেন, 'আমাদের দেশে কেউ জিতলে মানুষ মাথায় বসিয়ে নাচানাচি করে। আর হারলে কুৎসিত আক্রমণ করা হয়। মনে আছে, আশির দশকে ভারত একটা ক্রিকেট ম্যাচ জেতার পর ইনদওরে ৭২ ফিট লম্বা ব্যাট তৈরি করা হয়েছিল। সেই ব্যাটে অজিত ওয়াড়েকর থেকে শুরু করে সকল ক্রিকেটারের অটোগ্রাফ নেওয়া হয়েছিল। তার পরেই ভারত পাকিস্তানের কাছে একটা ম্যাচ হেরে গিয়েছিল আর সেই ব্যাটে কালি ছেটানো হয়েছিল।'






বিষণ্ণ নেগি বলছেন, 'ভারতীয়দের আবেগ মাঝে মধ্যে মাত্রা ছাড়ায়। শামির সঙ্গে যা হচ্ছে অন্যায়। খেলোয়াড়েরাও মানুষ। সব সময় প্রত্যাশা পূরণ সম্ভব হয় না। অলিম্পিক্সেও তো দেখলাম, অনেকে আছে যাদের জাতীয় বা এশীয় পর্যায়ে রেকর্ড রয়েছে। কিন্তু অলিম্পিক্সে তার ধারেকাছে যেতে পারেনি। তাই বলে কি তাদের মুণ্ডপাত করা উচিত? নাকি দেশদ্রোহী তকমা দেওয়া উচিত? এটা একেবারেই অনভিপ্রেত।' যোগ করলেন, 'একজনের জন্য কি ম্যাচ হারে? শামির জন্যই কি পাকিস্তান জিতেছে? আমার জন্যই কি সাত গোল হজম করতে হয়েছিল ভারতকে? পুরো দল খারাপ খেললেই তো ম্যাচ হারে। ভারতের ব্যাটিং শুরুতেই কেঁপে গিয়েছিল। শামিকে আক্রমণ করা অন্যায়।'


শামির হেনস্থা বারবার তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ৩৯ বছর আগে। এশিয়ান গেমসের সেই ফাইনালে ১-৭ গোলে পাকিস্তানের কাছে বিধ্বস্ত হতে হয়েছিল ভারতকে। তারপর জঘন্য আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন নেগি নিজে। 'সিনেমায় তো কিছুই দেখায়নি। বাস্তব জীবনের সবটা রিল লাইফে দেখানো সম্ভবও নয়। ১৬ বছর ধরে যন্ত্রণায় ছটফট করেছি। রোজ মানসিকভাবে কুঁকড়ে থেকেছি। কোথাও গেলে লোকে বলত, এই তো মীর রঞ্জন নেগি, যে সাত গোল খেয়েছে। আপনি কটা ম্যাচ জিতিয়েছেন লোকে তা ভুলে যায়। শামি কি ভারতকে ম্যাচ জেতায়নি?, বলছিলেন নেগি। যোগ করলেন, 'আমার বন্ধু, এমনকী, পরিবারের লোকেরাও পরিচয় করাত যে, এই সেই লোক যে সাত গোল খেয়েছিল। যন্ত্রণায় ছটফট করতাম। রাতে ঘুমোতে পারতাম না। শামিরও ভীষণ খারাপ লাগছে নিশ্চয়ই।'


নেগির মনে পড়ে যাচ্ছে, পাকিস্তানের কাছে সাত গোল হজম করার পর কী দুঃসহ সময় কেটেছিল তাঁর। বলছেন, 'তখন সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না। তারপরেও এত কটূ কথা বলা হয়েছে যে, বাড়ি থেকে বেরতে পারতাম না। ১৯৮২ সালে প্রথমবার রঙিন টিভি এসেছে। সবাই ম্যাচ দেখেছিল। এখনকার গোলকিপাররা মুখ ঢাকা হেলমেট পরে। তখন তা ছিল না। রাস্তাঘাটে সকলে চিনে ফেলত। এমনকী, এক ট্যাক্সিচালকও আমাকে বলেছিল, নেগি সাব, আপনি এত টাকা নিয়ে কী করবেন? সকলে ধরেই নিয়েছিল যে, আমি পাকিস্তানের থেকে টাকা নিয়েছি।'


ইনদওরে বসেও ভারত-পাক টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ম্যাচ দেখেছেন নেগি। বলছেন, 'দল হিসাবে ভারত খেলতেই পারেনি। এক একদিন এরকম হয়।' যোগ করছেন, 'শামির ওপর দিয়ে কী ঝড় যাচ্ছে জানি। এই পরিস্থিতিতে কেউ সমর্থন না করলে ছন্দ বিগড়ে যাবে ওর। গাছ ঝড়ে হেলে গেলে পরিচর্যা করতে হয়। তাহলেই ফের খাড়া হয়ে যায়। শামিকেও এখন আগলে রাখতে হবে।'