প্রথমেই একটা স্বীকারোক্তি থাকুক। আমি বাচিক শিল্পী নই। বাচিক শিল্পে আমার কোন প্রথাগত শিক্ষা বা স্বতঃস্ফূর্ত দক্ষতা নেই। এক মেঠো রিপোর্টার কীভাবে টেলিভিশন চ্যানেলের ক্যামেরার সামনে পৌঁছল - সে এক নাটকীয় গল্প ! আনন্দবাজার পত্রিকায় বেশ কয়েক বছর আগে রবিবাসরীয়র পাতায় সেই কাহিনী বিস্তারিতভাবে প্রকাশিত হয়েছে - পরে কখনও এখানে আবার বলা যাবে। কিন্তু, এই শুরুর স্বীকারোক্তির কারণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। যে ভূতের গল্পটি বাংলা সাহিত্যের অতি-সমৃদ্ধ স্বর্ণখনি থেকে আমি পড়েছিলাম পাক্কা পাঁচ বছর আগে এবং জীবনে প্রথমবার আপনাদের সামনে আজ রাখলাম, তার প্রত্যেকটা শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে ভয়ংকর একটা সময় ! যে সময়ে মোমবাতির আলোয় ভূত-বিলাসের কোনও পরিস্থিতি ছিল না, বরঞ্চ জীবন এবং মৃত্যু এত কাছাকাছি চলে এসেছিল যে প্রতি মুহূর্তে আক্ষরিক অর্থেই হাড়-হিম করা বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হচ্ছিল গোটা মানবসভ্যতাকে !
কোভিড-কাল। করোনা মহামারী তখন তুঙ্গ মুহূর্তে ! পেশাগত কারণে প্রতিমুহূর্তে শুধু দুঃসংবাদের মধ্যে দিয়ে কাটছিল সময়টা। কখনও ব্যক্তিগত স্বজন-বিয়োগের, কখনও বা বৃহত্তর বিপদের। প্রতিদিন নানা গুজব পল্লবিত হয়ে একদিকে মানুষের আশঙ্কা বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে নানাদিক থেকে এগিয়ে থাকা পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তের মুশকিল-আসানদেরও সমান বিভ্রান্ত মনে হচ্ছে। হাসপাতালে বেড নেই , আরোগ্যের আশাও কখনও-কখনও সঠিক ভ্যাকসিন পাওয়ার মতোই ক্ষীণ মনে হচ্ছে ! আর প্রতি সন্ধ্যেবেলা শুধু আরেকটু ভালো থাকার চেষ্টায় প্রতিদিন আঁতিপাঁতি খুঁজছি আপনাদের দেওয়ার মত কিছু ভালো খবর, অথচ বেশিরভাগ সময়েই ব্যর্থ হচ্ছি এবং শেষপর্যন্ত খারাপ খবরগুলোকেই আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে হচ্ছে পেশাগত দায়বদ্ধতার কারণে !
বহুবার দেখেছি, এইরকম অন্ধকার সময়গুলোতে আশ্রয় দিতে পারে একমাত্র বই। মনে হচ্ছিল প্রতিদিনকার এই দুঃস্বপ্ন-যাপনের মাঝখানে আরও আঁকড়ে ধরি ছাপার অক্ষরগুলোকে। আর সেই বইয়ের দীর্ঘ তালিকায় অবশ্যই স্বমহিমায় ছিলেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় , আমার সবচেয়ে প্রিয় লেখকদের অন্যতম। আমাদের ছোটবেলার লালশালুতে বাঁধানো বারো খণ্ডের শরদিন্দু রচনাবলী (যার শেষ দুটো খণ্ডে ব্যোমকেশের কাহিনীগুলি ছিল) তা কিছুটা পাল্টেছে তাও বেশ কয়েক বছর হল। আনন্দ পাবলিশার্স থেকে ২০১৭ সালে ‘অলৌকিক গল্পসমগ্র‘ আলাদা করে প্রকাশিত হয়েছে। সেই বইটাই পড়তে-পড়তে হঠাৎ কী খেয়াল হল ফোনটা হাতে নিয়ে ভয়েস রেকর্ডারটা অন করে দিলাম আর শরদিন্দুর অনুকরণীয় ভাষায় আমার অন্যতম প্রিয় একটা গল্প বেশ জোরেই পড়তে শুরু করলাম। ছোটবেলায় মা বহু বকাবকি করেও জোরে-জোরে পড়া মুখস্থ করাতে পারেনি। কিন্তু সেদিন ঘোর কোভিডকালে হঠাৎ কী খেয়াল চেপেছিল কে জানে ! তবে এটুকু বলে আপনাদের আশ্বস্ত করতে পারি যে তারপরে আর কোনওদিন এমন ইচ্ছে আমার হয়নি !
সেই সময়ে দুঃসংবাদ এবং দুর্ঘটনার দৈনন্দিন ঘনঘটা এতটাই প্রগাঢ় ছিল যে তার অভিঘাতে সেই অডিও-ফাইলটার কথা পরের দিন সকালে আর মনেই ছিল না ! ভাগ্যিস রেকর্ডিংটা শেষ করেই আমার ভ্রাতৃপ্রতিম সহকর্মী সুমন্তকে শুনতে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম ফাইলটা। আর কপিরাইট সংক্রান্ত নানা প্রশ্ন নিয়ে সেদিন রাতেই ফোন করেছিলাম আমার সবসময়ের শুভাকাঙ্ক্ষী সুবীরদাকে (আনন্দ পাবলিশার্সের স্তম্ভ সুবীর মিত্র)। সুবীরদা আশ্বস্ত করার পর ভেবেছিলাম আপনাদের সঙ্গে তখনই ভাগ করে নেব, কিন্তু দুঃসময়ের প্রাবল্যে তা আর হয়ে ওঠেনি !
আজ হঠাৎ মোবাইলের ‘স্বয়ংক্রিয় স্মৃতি‘র কল্যাণে ফিরে এল প্রায় পাঁচ বছর আগে রেকর্ড করা সেই গল্পের পাঠটা ! তাও আবার ভূত চতুর্দশীর দিনে !
কে বলে শুধু সমুদ্রদেবই নাকি যা নেন, সবকিছু আবার ফিরিয়ে দেন ? এই ঘোর কলিকালে এআই-এর ডানায় ভর করে মুঠোফোনও তাই দেয় দেখছি !
ভূত চতুর্দশীর এই আধিভৌতিক উপহার কেমন লাগলো বলবেন ...
আরও পড়ুন : Suman De's Blog : ফিরে আসছি বিরতির পর ...