নয়া দিল্লি: ভারতের বাজেট অধিবেশনের দিকে কেবল দেশবাসীর লক্ষ্য থাকে তা নয়, নজর থাকে গোটা বিশ্বের। পয়লা ফেব্রুয়ারি চলতি বছরের (২০২২-২৩) বাজেট পেশ করতে চলেছেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ। করোনাকালে দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা করতে মোদি সরকার কোন পথে হাঁটে তার উত্তর যেমন এই অধিবেশনে পাওয়া যাবে, তেমনই ২০২২-এ পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের আগে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণের বাজেটে কোনও চমক থাকে কিনা, সেটাও দেখার। বহিখাতা থেকে বাজেটের ধরন, প্রাক বাজেট হালুয়া উৎসব- বেশ কিছু বদল এসেছে বাজেট পেশের অনুষ্ঠানে। 


১৮৬০ সালের ৭ এপ্রিল ভারতের প্রথম বাজেট পেশ করা হয়েছিল।  প্রথম বাজেট পেশকারী ফিনান্স মেম্বার ছিলেন জেমস উইলসন। এরপরে অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্য জনাব লিয়াকত আলি খান ১৯৪৭-৪৮ সালের বাজেট পেশ করেন। তবে ১৯৪৭-এ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাজেট পেশ করার পদ্ধতি, সময়, তারিখ এবং ভাষাতে অনেক আকর্ষণীয় ও ঐতিহাসিক পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে সংসদে বাজেট পেশ করেন তিনি। শরণার্থী সঙ্কটের কথা মাথায় রেখে খাদ্যশস্যের জোগান বাড়ানোর উপর জোর দেন তিনি।                                                                   



এরপর ১৯৫১-৫৭ সালে অর্থমন্ত্রকের দায়িত্ব নেওয়া রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রথম ভারতীয় গভর্নর সিডি দেশমুখ পেশ করেছিলেন বাজেট। তিনি  প্রথমবারের জন্য হিন্দি ভাষায় ছাপিয়েছিলেন সেই বাজেট। তিনি বাজেটের পদ্ধতি ও লক্ষ্যে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছিলেন। তার আমলেই দেশে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা শুরু হয় এবং কালো টাকা ফাঁস করার পরিকল্পনাও আনা হয়। এরপর জওহরলাল নেহরুর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত টিটি কৃষ্ণমাচারি দু’বার অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলেছেন। প্রথম বার ১৯৫৭ সালে বাজেট পেশ করেন তিনি। প্রথম তিনিই সম্পত্তি কর এবং রিয়েল এস্টেট শুল্ক চালু করেন।                                                    


এরপর স্বাধীনতা সংগ্রামী মোরারজি দেশাই ১৮৫৮ থেকে ১৯৬৩ এবং ১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯, দু’দফায় অর্থমন্ত্রী ছিলেন। সবমিলিয়ে ১০টি বাজেট পেশ করেন তিনি। ১৯৬৮ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি মোরারজি দেশাইয়ের পেশ করা বাজেটকে 'জনগণের বাজেট' নাম দেওয়া হয়েছিল। যদিও ১৯৬৯ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী উপ-প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের কাছ থেকে অর্থ মন্ত্রকের দায়িত্ব নিয়ে নেন এবং অর্থমন্ত্রী হন জওহরলাল-কন্যা। এই ঘটনার পর ইন্দিরার মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন মোরারজি দেশাই। বর্তমানে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ বাজেট পেশ করলেও দেশে প্রথম মহিলা অর্থমন্ত্রী হিসেবে বাজেট পেশ করেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। ১৯৭০ সালে একাধারে দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং আরেক দিকে অর্থমন্ত্রী হিসেবে বাজেট পেশ করেন তিনি। 


মোরারজি দেশাইয়ের পর ভারতে এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বেশিবার বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম ন'টি বাজেট পেশ করেন। অন্যদিকে এবং প্রণব মুখোপাাধ্যায় আটটি বাজেট পেশ করেছিলেন। 


বাজেট পেশের সময় পরিবর্তন হয়েছিল কবে? ভারতে বাজেট পেশের প্রবণতা ব্রিটিশ আমলে শুরু হয়েছিল। দেশের পার্লামেন্ট অনুযায়ী ভারতীয় সংসদে বাজেট পেশ করার সময়ও ঠিক করে দিয়েছিল ব্রিটিশরাই।  ব্রিটিশ শাসনকালে বিকেল ৫টায় ভারতের সংসদে বাজেট পেশ করা হত। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বহু দশক ধরে লোকসভায় বাজেট পেশ করা হয় সন্ধ্যা ৫টায়। তবে অটল বিহারী বাজপেয়ীর সরকারের সময় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী যশবন্ত সিনহা বাজেট পেশের সময় পরিবর্তন করে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিকেল ৫টার পরিবর্তে সকাল ১১টায় বাজেট পেশ করেন। এরপর থেকে সেই ঐতিহ্যই বহন করে আসছেন দেশের বাকি সব প্রধানমন্ত্রী। তবে ২০১৭ সালে তৎকালীন (প্রয়াত) অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি ফেব্রুয়ারির প্রথম দিনে সংসদে বাজেট পেশ করেন। জেটলির আমলে ৯ দশক ধরে চলে আসা ঐতিহ্যের অবসান ঘটিয়ে সাধারণ বাজেটে রেলওয়ে বাজেটও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।


আরেকটি পরিবর্তন হয় বহিখাতায়। ব্রিটিশ যুগে ব্রিফকেস বা স্যুটকেসে নিয়ে আসা হত বাজেটপত্র। ২০১৯ সালে বদল এল সেই নিয়মে। অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ ব্রিফকেসের পরিবর্তে লাল কাপড়ের একটি ব্যাগে বাজেটপত্র নিয়ে আসেন। আর ২০২১ সালে করোনা আবহে সম্পূর্ণ কাগজবিহীন ডিজিটাল বাজেট পেশ করা হয়েছিল। এ বছর বাজেট কপি ছাপানোর রেওয়াজও বন্ধ হয়েছে। নির্মলা সীতারমণ দেশের প্রথম অর্থমন্ত্রী যিনি বই এবং কাগজের পরিবর্তে ট্যাবে বাজেট পেশ করেছিলেন। এমনকী এ বছর প্রথমবারের মতো বাতিল হয়েছে ঐতিহ্যবাহী 'হালুয়া অনুষ্ঠান'ও। এবার হালুয়ার পরিবর্তে কর্মচারীদের মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছে। বাজেট পেশ করার ইতিহাসে এখন পর্যন্ত দীর্ঘতম বক্তৃতা দেওয়ার রেকর্ড করেছেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন। ২০২০ সালে লোকসভায় ২ ঘণ্টা ৪১ মিনিটের বাজেট পেশ করেছিলেন তিনি।