নয়াদিল্লি: শেয়ার বাজারে রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে গিয়েছে। দেশের অর্থনীতিতেও প্রভাব পড়ার আশঙ্কা। আমেরিকার ‘শুল্ক শাস্তি’ নিয়ে তাই বাড়ছে উদ্বেগ। সেই আবহে মুখ খুললেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর, অর্থনীতিবিদ রঘুরাম রাজন। তাঁর মতে, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের উপর যে ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপিয়েছেন, তার নেপথ্যে বৃহত্তর কৌশল রয়েছে। শুধুমাত্র ব্যবসা-বাণিজ্যের মধ্যে সীমিত নয় বিষয়টি। (US Tariff on India)
একটি সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমে মুখ খুলেছেন রাজন। ভারতের উপর একেবারে ৫০ শতাংশ শুল্ক কেন চাপালেন ট্রাম্প, তা নিয়ে নিজের মতামত জানান তিনি। বলেন, “আমার মনে হয়, বাণিজ্যখাতে ঘাটতি দেখে, কারেন্ট অ্যাকাউন্টে ঘাটতি দেখে ওঁর (ডোনাল্ড ট্রাম্প) মনে হয়েছে, অন্য দেশগুলি আমেরিকার উদারতার সুযোগ নিচ্ছে। আমেরিকার সাধারণ নাগরিকরা উপকৃত হন, তেমন দামে পণ্য রফতানি করছে না কেউ।” (Raghuram Rajan)
রাজনের মতে সেই আটের দশক থেকেই এই ধারণা বদ্ধমূল ট্রাম্পের মনে। যে কারণে সেই সময় জাপানের সমালোচনায় সরব ছিলেন তিনি। বাণিজ্যক্ষেত্রে কে কত বড় খেলোয়াড়, তা শুল্কের মাধ্যমেই ঠিক হয় বলে মনে করেন ট্রাম্প।
ভারতের উপর ৫০ শতাংশ হারে শুল্ক চাপানোর নেপথ্যে আর একটি কারণ দেখছেন রাজন। তাঁর দাবি, শুল্ককে কেবলমাত্র বাণিজ্যনীতির অংশ মনে করেন না ট্রাম্প। বরং বহিরাগতদের থেকে কর আদায়ের মাধ্যম বলে গণ্য করেন। শুল্কের মাধ্যমে আসলে রাজস্ব আদায় করতে চাইছেন। সম্প্রতি বেশ কিছু ক্ষেত্রে করছাড়ের ঘোষণা করেছেন ট্রাম্প। চড়া শুল্কের মাধ্যমে সেই ঘাটতি পোষাতে চাইছেন। রাজন জানিয়েছেন, সেনার সাহায্য ছাড়া, অন্য দেশের উপর চাপসৃষ্টি করতেও শুল্ক ট্রাম্পের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। এতে ‘অন্য’ দেশেটিরই ক্ষতি।
রাশিয়ার থেকে অন্য একাধিক দেশই তেল কেনে। সেই তালিকায় রয়েছে চিনও। কিন্তু বেছে বেছে ভারতেরই প্রতিই ট্রাম্পের আচরণ কঠোর কেন, জানতে চাওয়া হয় রাজনের কাছে। তিনি জানান, এশিয়ার অন্য দেশগুলির তুলনায় ভারতের উপরই বেশি শুল্ক চাপানো হয়েছে। তুরস্ক এমনকি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের থেকেও ভারতের শুল্ক বেশি। এতে ভারতই সঙ্কটে বলে মত রাজনের। তাঁর কথায়, “সম্পর্ক যে ভেঙে গিয়েছে, তা স্পষ্ট।”
ভারতের প্রতি ট্রাম্পের এই আচরণ কি শুধুমাত্র রাশিয়ার থেকে তেল কেনার জন্য? রাজন বলেন, “বিষয়টি ন্যায়-অন্যায়ের ঊর্ধ্বে চলে গিয়েছে। এখন যে পরিস্থিতি, তাতে শক্তি প্রদর্শন চলছে। ট্রাম্পের ধারণা ভারত নিয়ম মানছে না। তাই উদাহর তৈরি করছেন।”
শুল্ক নিয়ে এই টানাপোড়েনের মধ্য়ে লাগাতার ভারতকে আক্রমণ করে চলেছে আমেরিকা। ট্রাম্পের সহযোগী পিচার নেভারো ভারতকে তীব্র আক্রমণ করেছেন। চিন এবং রাশিয়ার সঙ্গে সখ্য বাড়িয়ে ভারত আসলে ‘স্বৈরাচারীর শয্যাসঙ্গী’ হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। রাজনের মতে, উপরমহলের অনুমতি ছাড়া এই ধরনের মন্তব্য করতে পারেন না পিটার। অর্থাৎ তাঁকে সমর্থন জোগানো হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে ভারতের কী করণীয়, তাও বাতলে দিয়েছেন রাজন। রাশিয়ার থেকে তেল কিনে আসলে কার লাভ হচ্ছে, আর চড়া শুল্কে কার ক্ষতি হচ্ছে, তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা উচিত দিল্লির। রাজন বলেন, “আসলে তৈল শোধনাগারগুলির বাড়তি লাভ হচ্ছে। তারা কি এখনও বাড়তি লাভ করছে? তাদের ওই মুনাফা থেকে আমরা কি কিছু পেতে পারি, যাতে ক্ষতিগ্রস্ত রফতানিকারীদের কিছু সুরাহা হয়? রাশিয়ার থেকে তেল কেনার জন্যই তো তাঁদের ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে!”
এমন পরিস্থিতিতে কী করণীয়, তা নিয়ে রাজন বলেন, "ভারতের জন্য এটা Wake-Up Call.কোন একটি দেশের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকলে চলবে না। পূর্ব দিকে তাকাতে হবে, ইউরোপ, আফ্রিকার দিকে তাকাতে হবেস পাশাপাশি, সম্পর্ক থাক আমেরিকার সঙ্গেও। সংস্কার প্রয়োজন, যাতে বৃদ্ধির হার হয় ৮-৮.৫ শতাংশ, যুবসমাজের কর্মসংস্থান হয়।"
রাশিয়ার থেকে তেল কেনার জন্য আমেরিকা কড়া কথা শোনালেও, দিল্লির দাবি, কার কাছ থেকে কী কিনবে, তা ঠিক করার অধিকার রয়েছে ভারতের। ভারতে সার্বভৌমত্বের উপর কেউ ছড়ি ঘোরাতে পারে না। কিন্তু রাজনের মতে, এক্ষেত্রে সার্বভৌমত্ব, ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্ন জড়িয়ে থাকলেও, তা মূল সমস্যা নয়। ক্ষমতাপ্রদর্শনই এখানে মূল আলোচ্য বিষয়।