নয়াদিল্লি: দেশে না থাকলেও খবরের শিরোনামে কিংফিশার কর্তা বিজয় মাল্য। ঋণখেলাপি মামলায় দেশত্যাগী মাল্যর একটি সাক্ষাৎকার নিয়ে জোর চর্চা এই মুহূর্তে। কারণ ওই সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, দেশ ছাড়ার আগে তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলিকে জানিয়েছিলেন তিনি। কিংফিশার যখন ধুঁকতে শুরু করে, সেই নিয়ে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও কথা হয়েছিল বলে দাবি করেছেন মাল্য। আর সেই নিয়েই এখন সরগরম জাতীয় রাজনীতি। (Vijay Mallya)
দেশত্যাগী হওয়ার পর থেকে কুখ্যাতির কারণেই বার বার খবরে উঠে এসেছেন মাল্য। কিন্তু এবার এক ইউটিউবারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে যে মন্তব্য করেছেন মাল্য, তা নিয়ে শোরগোল পড়ে গিয়েছে। মাল্যর সাফ বক্তব্য, "আমাকে পলাতক বলতে পারেন, কিন্তু চোর বলবেন না।" এমনকি ঋণ খেলাপ করে তিনি বিদেশে পালিয়ে গিয়েছেন বলে যে অভিযোগ, তা-ও খারিজ করে দিয়েছেন মাল্য। (Vijay Mallya Podcast)
২০১৬ সালে দেশ ছাড়ার পর এতদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় মুখ খুললেও, এই প্রথম জনসমক্ষে নিজের অবস্থান জানালেন মাল্য। ইউটিউবার রাজ শামানির পডকাস্টে জানালেন, তিনি জালিয়াতি করেননি। ঋণ শোধ করতেই চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়, খলনায়ক হিসেবে তুলে ধরা হয় তাঁকে। আর সেই প্রসঙ্গেই জেটলি ও প্রণবের কথা তুলে ধরেছেন মাল্য।
ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া বিপুল পরিমাণ ঋণ শোধ না করে দেশ ছাড়া নিয়ে মাল্য বলেন, "বিমানবন্দরে যাওয়ার আগে অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলিকে জানিয়েছিলাম আমরা। এর পর দিল্লি থেকে লন্ডন যাই। সেই খবর সংবাদমাধ্যমে পৌঁছতেই শোরগোল পড়ে যায়। সকলে জেটলির কাছে ছুটে যাচ্ছিলেন। তিনি আমার সঙ্গে সাক্ষাতের কথা অস্বীকার করেন। কংগ্রেসের এক সাংসদ আমাদের দেখেছিলেন, তিনিই বলেন যে, "আমি ওদের দেখেছি"। জেটলিকে নিজের মন্তব্য থেকে সরতে হয়। জানান, হাঁটতে হাঁটতে আমার সঙ্গে কথা হয়েছে---একটি ক্ষণস্থায়ী সাক্ষাৎ'।"
জেটলির দফতরে গিয়ে সরকারি ভাবে কিছু জানাননি, কিন্তু তিনি যে আলোচনায় বসে ঋণে এবং খেলাপের বিষয়টি মিটিয়ে নিতে চান, সেকথা জানান মাল্য। বলেন, "আমি জেটলিকে বলেছিলাম যে, লন্ডন যাচ্ছি। সেখান থেকে জেনিভায় যাব। মিটিং রয়েছে সেখানে। সব সেরে ফিরব দেশে। ব্যাঙ্কগুলিকে বলুন আমার সঙ্গে আলোচনায় বসতে, যাত সমাধান সূত্র বের করা যায়। এক বাক্যে এটা বলতে আর কতক্ষণ সময় লাগে? উনি প্রথমে অস্বীকার করেন। কংগ্রেস সাংসদ দেখেছেন বলায় সাক্ষাতের কথা মেনে নেন। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যম মনগড়া গল্প বানিয়ে, সবকিছু ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখায়। ওদের ব্যবসার জন্য অবশ্যই ভাল, করতে দিন।"
কিংফিশার যখন প্রথম সমস্যায় পড়ে, সেই সময় তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী প্রণবের কাছেও ছুটে গিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন মাল্য। তিনি জানান, ২০০৮ সালে বৈশ্বিক মন্দা শুরু হলে কিংফিশারও সমস্যায় পড়ে। টাকা আসা বন্ধ হয়ে যায়, একেবারে হাত ফাঁকা হয়ে যায়। সেই সময় টাকার দরও তলানিতে এসে ঠেকে। মাল্যর বক্তব্য, "আমি প্রণব মুখোপাধ্য়ায়ের কাছে যাই। জানাই, আমি সমস্যায় পড়েছি। কিংফিশারকে ছোট করতে হবে। বিমানের সংখ্য়া কমাতে হবে, চাকরি থেকে ছাঁটতে হবে কিছু কর্মীকে। অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে এভাবে সব কিছু চালাতে পারব না। কিন্তু আমার আবেদন খারিজ করে দেওয়া হয়। বলা হয়, "সংস্থা ছোট করা যাবে না। আপনি কাজ চালিয়ে যান, ব্যাঙ্কের তরফে সাহায্য করা হবে আপনাকে"। এভাবেই সবকিছুর সূচনা হয়েছিল।"
মাল্য জানিয়েছেন, এত আশ্বাসের পরও অর্থনৈতিক সঙ্কট নেমে আসে। একে একে উড়ান বন্ধ করে দিতে হয় কিংফিশারকে। এর পরও ব্যাঙ্কগুলিকে চারবার প্রস্তাব পাঠান তিনি। জানান, ঋণ শোধ করতে প্রস্তুত ছিলেন তিনি। তাঁর প্রস্তাব খারিজ করে দেওয়া হয়। ব্যাঙ্কের কাজকর্মে স্বচ্ছতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে বলেও জানান মাল্য। ১৫ বার অনুরোধ পাঠানো সত্ত্বেও অ্যাকাউন্টের কোনও স্টেটমেন্ট দেওয়া হয়নি তাঁকে। সংসদে অর্থমন্ত্রী ১৪ হাজার ১৩১ কোটি টাকার কথা বললেই ঋণের অঙ্কের কথা জানতে পারেন বলে দাবি মাল্যর।
মাল্য জানিয়েছেন, সংবাদমাধ্যমে ৯ হাজার কোটি টাকার কথা বলা হলেও, ১১.৫ শতাংশ সুদ-সহ খাতায় কলমে ৬ হাজার ২০৩ কোটি ৩৫ লক্ষ টাকাই ঋণ ছিল। কিন্তু তাঁর সম্পত্তি বেচে সরকার ১৪ হাজার ১০০ কোটি টাকা তুলেছে বলে দাবি মাল্যর। সেই নিয়ে আদালতে আইনি লড়াইও চলছে। মাল্য়র বক্তব্য, "২০১৬-র পর ভারতে ফিরে যাইনি। তাই আমাকে পলাতক বলতে পারেন। কিন্তু আমি পালিয়ে আসিনি। নির্ধারিত সূচি ধরেই বেরিয়েছিলাম। কিন্তু বৈধ কারণেই আর ফিরিনি। আমাকে পলাতক বলতে পারেন। কিন্তু চোর বলা হচ্ছে কেন? কোথায় চুরি হয়েছে? ঋণখেলাপি তাকে বলা হয়, যে টাকা থাকা সত্ত্বেও ধার শোধ করে না। আমি চার বার সেটলমেন্টের প্রস্তাব দিয়েছিলাম। ওরা রাজি হয়নি। এটা কেউ জানে না। হায়দরাবাদ গিয়ে SBI চেয়ারম্যানের সঙ্গেও দেখা করি। ধার শোধ করব না, একবারও বলেনি। ওরা হয়ত ১৪ হাজার ১০০ কোটিই চেয়েছিল। তাই রাজি মীমাংসায় রাজি হয়নি। আমার প্রস্তাব গ্রহণ করলে তো ৫০০০ টাকাই পেত! সুপ্রিম কোর্টের রেকর্ডে এর প্রমাণ রয়েছে।"
মাল্য জানান, ঋণের টাকার চেয়েও বেশি টাকা শোধ করেছেন তিনি। তার পরও 'চোর' বলা হচ্ছে তাঁকে। তিনি বলেন, “ডেট রিকভারি ট্রাইব্যুনাল জানিয়েছে, ঋণ ছিল ৬২০৩ কোটি ৩৫ লক্ষ ৩ হাজার ৮৭৯ টাকা ৪২ পয়সা। তাহলে ৯ হাজারের গল্প এল কোথা থেকে? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, ‘উনি ৯০০০ কোটি টাকা ঋণখেলাপ করেন। সরকার ১৪ হাজার টাকা আদায় করে’। ব্যাঙ্ক আমাকে স্টেটমেন্ট দেয়নি আজও। আমাকে চোর বলছেন আজ। আড়াই গুণ বেশি টাকা মেটানোর পরও আমাকে চোর বলা হচ্ছে।”
আর মাল্যর এই সাক্ষাৎকার সামনে আসতেই জাতীয় রাজনীতিতে তরজা শুরু হয়েছে। কেন্দ্রে তক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারকে তীব্র আক্রমণ করেছে কংগ্রেস। দলের নেতা পবন খেরা Operation Sindoor-এর সঙ্গে মাল্য ও জেটলির সাক্ষাৎকে জুড়ে দিয়েছেন। পবনের বক্তব্য, "পাকিস্তানকে জানিয়ে আক্রমণ করেন বিদেশমন্ত্রী। ঋণ খেলাপিরা অর্থমন্ত্রীকে জানিয়ে দেশ ছাড়েন। নরেন্দ্রর (মোদি) হাতে গোটা শাসনব্যবস্থাটাই আত্মসমর্পিত।" তদন্ত চলাকালীন মাল্য কোনও রকম বাধা বিপত্তি ছাড়াই কী করে দেশ ছাড়লেন, তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলছেন অন্য বিরোধী দলগুলিও।