প্রিয়াঙ্কা দত্ত, কলকাতা: তৌসিফ রহমানের (Mohammad Tauseef Rahman) অবাক জলপানের গল্প। যা হইচই ফেলে দিয়েছে শহরে। বৃষ্টির ছিঁটেফোঁটা রেশের দেখা মিললেও এখনও প্রচণ্ড গরমে যখন পুড়ছে গোটা রাজ্য, ৪০ ডিগ্রি ছুঁই ছুঁই কলকাতার তাপমাত্রা। ঠিক তখনই কার্যত ফেরেস্তা হয়ে এলাকাবাসীর তৃষ্ণা নিবারণে হাজির বছর ২৯-এর যুবক।
৩০/৭ আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের (Alimuddin Street) মহঃ তৌসিফ রহমান। বিনামূল্যে ঠান্ডা জল বিতরণ করে সংবাদের শিরোনামে সে। রাস্তার পাশে রাখা ফ্রিজ। যা থেকে ইচ্ছে মতো পিপাসা মিটিয়ে নিতে পারবেন পথ চলতি মানুষ। ফ্রিজ বা ঠান্ডা জলের সামর্থ্য নেই যাঁদের তাঁরাও গলা ভিজিয়ে নিতে পারবেন অনায়াসেই। এই জল তাঁদের প্রত্যেকের জন্য।
এই প্রচণ্ড দাবহাদের সময়ে পথচলতি মানুষের তৃষ্ণা মেটানোর পরিকল্পনা দেয় তৌসিফেরই (Mohammad Tauseef Rahman) এক বন্ধু। যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সমস্ত ব্যবস্থা করে ফেলে তৌসিফ। আনা হয় ফ্রিজ। নিজের বাড়ি থেকেই বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যবস্থা করেন তিনি। আর এর পরেই তৌসিফের রুটিনে যোগ হয় আরও একটা নতুন কাজ। প্রতিদিন সকালে জলের বোতল কিনে ফ্রিজে রেখে দেন তিনি। শুরুটা তৌসিফ করলেও তাঁর পদক্ষেপে সামিল এলাকাবাসীও। সাধ্যমতো সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন তাঁরাও। নিজেদের বাড়ি থেকে আনা জল ভর্তি বোতল রেখে যান এলাকার বাসিন্দারাও। জল ফুরালেও ফের ভর্তিও হয় যায় সময় মতো। কেউ না কেউ ঠিক ফাঁকা জায়গা ভরে দেন সুযোগ বুঝে। আর দিনভর এভাবেই চলে এই কর্মকাণ্ড।
খোলা রাস্তায় বসানো ফ্রিজ। অথচ চুরির ভয় নেই, নষ্ট হওয়ারও আশঙ্কা নেই বিন্দুমাত্র। এও কি সম্ভব? তৌসিফ বলছেন, 'এলাকার মানুষ গরিব হতে পারেন, তবে লোভী নন।' তৌসিফের দৃঢ় বিশ্বাস সজ্ঞানে ফ্রিজের অনিষ্ট করবেন না কেউ বরং দায়িত্ব নিয়েই চলবে ফ্রিজের দেখভাল। যা নিজে থেকেই কাঁধে তুলে নিয়েছেন এলাকাবাসী। আর এই বিশ্বাসের ওপরেই ভর করেই তো দিব্যি দাঁড়িয়ে থেকে অসহায় মানুষের তেষ্টা মেটাচ্ছে ফ্রিজটি। আর এতেই খুশি স্থানীয়রা। তৌসিফের এক কাজকে সাধুবাত জানিয়ে তাঁরাও যে সামিল হয়েছে এই কাজে।
শুরু কীভাবে? চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোমেই বিশ্বাসী বছর ২৯-এর তৌসিফ রহমান। তাঁর কথায়, 'সবটাই শিখেছি বাবা-মায়ের থেকে। ছোট থেকেই মা কে দেখেছি অসহায় মানুষের পাশে থাকতে। আমাকেও এই শিক্ষাতেই বড় করেছেন। শিখিয়েছে কীভাবে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হয়।
ঠিক কবে থেকে সামাজিক কাজের শুরু এখন আর স্পষ্ট মনে করতে পারে না সে। তবে স্মৃতির পাতা হাতরে তৌসিফ বলতে থাকে, 'কখনও নিজের বাড়ির রেশন, চাল, ডাল, সবজি। কখনও জামা কাপড়, কখনও খাবার দিয়েছি। পরবর্তীকালে কখনও স্যানিটারি ন্যাপকিন বিলি, কখনও শৌচালয় তৈরি করে, কখনও ছোটদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করার মতো একাধিক কাজ চলতেই থেকেছে। তৌসিফের কথায় আমি কিছুই করি না, 'পরিস্থিতিই আমায় যা করায় আমি সেটাই করি।'
'দেখা হয়নি চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে দু-পা ফেলিয়া', তৌসিফের বলছেন, 'মানুষের পাশে থাকতে দূরে গিয়ে হাজার হাজার টাকা খরচের প্রয়োজন নেই। সামান্য টাকা দিয়েই সাহায্যের হাত বাড়ানো সম্ভব। বাড়ির আশেপাশের অসহায় মানুষকে জল-খাবার-জামাকাপড় দিয়ে পাশে থাকা যায়।'
সবিলিয়ে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের ছবিটাই কেমন যেন বদলে গেছে হঠাৎ। এই ফ্রিজের জল খেয়েই রোজা ভাঙছেন মানুষ, কেউ আবার মন্দিরে যাওয়ার পথেই জলে গলা ভেজাচ্ছেন এই জলেই। স্কুল ফিরতি বাচ্চা থেকে বিশেষভাবে সক্ষম যুবক সকলেরই তৃষ্ণা মেটাচ্ছে এই ফ্রিজ। আর ধর্ম-বর্ণ জাত-পাত মিলেমিশে একাকার হয়েছে ঠিক এইখানেই।
তবে যে কাজ নিয়ে আজ এত হই হই কাণ্ড। তা নিয়েই হাসির খোরাক হতে হয়েছিল তৌসিফকে। 'অনেকই আমার কাজ নিয়ে ঠাট্টা করেছে, হেসেছে, পাবলিসিটি স্টান্ট বলেও তোপের মুখে পড়তে হয়েছে বহুবার।' তবু পিছ পা হয়নি তৌসিফ বরং আরও বৃহৎ পরিসরে ভাবছে সে। শুধু বিনামূল্যে ঠান্ডা জল নয়, ফুড ব্যাঙ্কের ভাবনাও রয়েছে তাঁর। তৌসিফের সিন্ধুসম গল্পে বিনামূল্যে ঠান্ডাজলের ফ্রিজ আর জলপানের গল্প বিন্দুমাত্র।