কলকাতা: মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষণা মতো রাজ্য বিধানসভায় পেশ হল ধর্ষণবিরোধী বিল। বিধানসভায় ধর্ষণবিরোধী বিল পেশ করলেন রাজ্যের মন্ত্রী মলয় ঘটক। এই বিলে  ধর্ষণ করে খুনের মতো ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডের নিদান রয়েছে। ধর্ষণ ও গণধর্ষণের ক্ষেত্রে ন্যূনতম আমৃত্যু কারাদণ্ডের সাজা রয়েছে, এমনকি মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে।  সঙ্গে প্রতিটি ক্ষেত্রেই জরিমানার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। দ্রুত বিচার পর্ব শেষ করা ও ধর্ষণের ক্ষেত্রে কড়া শাস্তিই এই বিলের লক্ষ্য। (Anti Rape Bill)


আর জি কর মেডিক্য়ালে তরুণী চিকিৎসক পড়ুয়াকে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার প্রেক্ষাপটে রাজ্যে পৃথক ধর্ষণবিরোধী বিল আনার ঘোষণা করেছিলেন মমতা। সেই মতো আজ বিধানসভায় ধর্ষণবিরোধী বিল পেশ হল। দ্রুত বিচার পর্ব শেষ করা ও ধর্ষণের ক্ষেত্রে কড়া শাস্তিই এই বিলের লক্ষ্য। বেলা ১২টা নাগাদ বিধানসভার বিশেষ অধিবেশনে বিল পেশ করেন আইনমন্ত্রী মলয়। বিলের নাম রাখা হয়েছে, অপরাজিতা উইমেন অ্যান্ড চাইল্ড (ওয়েস্ট বেঙ্গল ক্রিমিনাল ল অ্য়ামেন্ডমেন্ট) বিল ২০২৪। (West Bengal Assembly)


এদিন বিলটি নিয়ে বলতে ওঠেন ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ির বিজেপি বিধায়ক শিখা চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, "এই বিলে আমার সবাই খুশি। আমরা প্রত্যেকেই চাই, দোষীদের শাস্তি হোক। শুধু আমরা নয়, গোটা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ দোষীদের শাস্তির দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। আমাদের যে ন্যায় সংহিতা বিল রয়েছে, সেই নিয়ে আলোচনাও হয়েছিল এখানে। ওই বিলে কঠোর থেকে কঠোরতম শাস্তির বিল রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ ওই বিল নিয়ে কোনও রকম গা করেনি। গোটা দেশের যে আইন রয়েছে, তাতে দণ্ড দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকার সেটা নিয়ে উচ্চবাচ্য করেনি।"


আর জি কর কাণ্ডে কেন্দ্রীয় আইন কেন প্রয়োগ করল না রাজ্য সরকার, প্রশ্ন তোলেন শিখা। পাশাপাশি, ২০ বছরের সাজার বিধান নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। শিখার মতে, যাবজ্জীবনের অর্থ ১৪-১৫ বছরে সাজা কাটিয়ে বেরিয়ে যায় কয়েদিরা। এখানে তার ব্যতিক্রম হবে কি না, তা অস্পষ্ট। পুলিশের ভূমিকা নিয়েও রাজ্য পরিষ্কার করে কিছু বলেনি বলে মন্তব্য করেন শিখা। আর জি করের ঘটনায় কলকাতা পুলিশের কমিশনার ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। এত বড় ঘটনার পরও সন্দীপ ঘোষকে কোন যুক্তিতে ন্যাশনাল মেডিক্য়ালের দায়িত্ব দেওয়া হল, সরাসরি মমতাকে প্রশ্ন করেন তিনি।



বিজেপি বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পাল বলেন, "বিলটা পড়তে গিয়ে সুকুমার রায়ের হ য ব র ল-র কথা মেন পড়ে গেল। রাজ্য সরকারের এই বিলটিকে সমর্থন করছি। কিন্তু একজন মহিলা হিসেবে, মা হিসেবে, স্ত্রী হিসেবে, বিধায়িকা হিসেবে এবং রাজ্যের নাগরিক হিসেবে কিছু কথা বলতে হচ্ছে। আজ যে বিল আনা হল, কোথাও আমার মনে হল, সরকার পক্ষ বোধহয় অভয়াকে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে। কারণ অভয়া শুধু গণধর্ষিতা, খুন হননি, এই যে অত্যাচার, অনাচার, পুলিশের অপশাসন, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মুখ। আজ একটা অভয়া মারা গিয়েছে, শুধু পশ্চিমবঙ্গ, ভারত নয়, গোটা পৃথিবীর অভয়ারা পথে নেমেছে। রাত দখল করে সুরক্ষা চাইছেন।"


অগ্নিমিত্রার দাবি, ভয় পেয়েই রাজ্য সরকার এই বিল আনতে বাধ্য হয়েছে। এক মাস আগেই মোদি সরকার ন্যায় সংহিতা এনেছে। অথচ সেই ন্যায় সংহিতার বিরোধিতা করে প্রস্তাব আনে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। মধ্যযুগীয় বলে সেই সময় বিরোধিতা করা হয়, আর আজ আবার রাজ্য সরকার ফাঁসির কথা বলছে। দেরিতে বিচার যেমন কাম্য নয়, তেমনই তাড়াহুড়ো করে বিচারও কাম্য নয় বলে মত অগ্নিমিত্রার। 


আজ বিলটিকে সমর্থন করেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীও। তাঁর বক্তব্য, "আমি এই বিলের প্রেক্ষিতে সাতটি সংশোধনের প্রস্তাব জমা দিয়েছি। প্রথমত, এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ, অর্থপূর্ণ, সংবেদনশীল বিল আনার ক্ষেত্রে যে প্রক্রিয়া, পদ্ধতি, ভূমিকা এবং সংবিধান মানা হয়েছে কি না, তা জানা নেই আমার। এ নিয়ে প্রশ্নও করতে চাই না। কিন্তু যারা এনেছে, এই বিলকে আইনে পরিণত করার দায়িত্ব পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এবং যিনি বিল পেশ করেছেন, সেই আইন মন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রীকে নিতে হবে। আমরা তার জন্য অপেক্ষায় থাকব। যে কবে এই বিল আইনে পরিণত হবে। দ্বিতীয়ত, তাড়াহুড়ো করে এই বিল এনেছেন আপনারা। চাইলে আমরা বলতে পারতাম, বিলটি আইন বা বিচার বিভাগে গিয়েছে কি না, সংসদীয় নীতি অনুযআয়ী সিলেক্ট কমিটিতে পাঠান। আমরা তা বলছি না। কিন্তু এই বিলটি অবিলম্বে কার্যকর করার কথা বলছি। আমরা রেজাল্ট চাইছি। আমরা সম্পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছি, কোনও ভোটাভুটি চাইব না। কিন্তু এই বিল অবিলম্বে কার্যকর করতে হবে।" আজও বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি করেন শুভেন্দু। বলেন, "দফা এক, দাবি এক, মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ।"


যে সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছেন শুভেন্দু, সেগুলি হল,



  • থানায় এফআইআর নিতে অস্বীকার করলে, বিলম্ব করলে, পুলিশ আধিকারিকদের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান রাখতে হবে

  • বিধিসম্মত মেডিক্যাল পরীক্ষা বা ময়নাতদন্তের ক্ষেত্রে বিলম্ব বা অবহেলা করলে স্বাস্থ্য আধিকারিকের বিরুদ্ধে চডূড়ান্ত শআস্তি

  • তথ্যপ্রমাণ লোপাটে শাস্তি হোক

  • সাক্ষ্যপ্রদানের সময় গুরুতর অসুস্থতা ছাড়া দিন পরিবর্তন নয়

  • তদন্তকারী পুলিশ আধিকারিক, স্বাস্থ্য আধিকারিকের বয়ান বদলেও শাস্তি হোক

  • নির্যাতিতার পরিবারেক পূর্ণ নিরাপত্তা

  • বিচারপ্রক্রিয়া ৩০ দিনের মধ্যে শেষ করে শাস্তি দিতে হবে


যদিও বিলটি নিয়ে কথা বলতে উঠে রাজ্যের মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় বলেন, "সিবিআই-তে গিয়ে কোন সুবিধা হল আমাদের? সিবিআই কি অভিমুখ সরিয়ে দেওয়ার কাজ করছে? খুনি, ধর্ষককে বার করা কাজ ছিল তাদের। তা না করে আজ যা হচ্ছে...সিবিআই-এর দফতরে অভিযান হচ্ছে না, নবান্ন, লালবাজার, মুখ্যমন্ত্রীর হাড়িতে অভিযান হচ্ছে। কিন্তু যারা বিচার দেবে, যে বিচার মনা পেয়ে এত রাগ...কিন্তু অভিমুখটাই সরে যাচ্ছে। খুনি, ধর্ষককে খুঁজে বার করা থেকে দুর্নীতির দিকে সরে যাচ্ছে অভিমুখটা। তার জন্য অনেক সময় পাবেন। ধর্ষণ গোটা দেশের সমস্যা।"